Logo
Logo
×

পঁচিশে যুগান্তর

ঢাকেশ্বরী কটন মিল ও একজন সূর্য্যকুমার বসু

Icon

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকেশ্বরী কটন মিল ও একজন সূর্য্যকুমার বসু

বাংলার সব রকমের হস্তশিল্পের মধ্যে কার্পাসশিল্প ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রোমান সাম্রাজ্যের আমলে বিত্তশালী রোমান মহিলাদের কাছে ভারতীয় মসলিন ছিল গভীর অনুরাগের বস্তু। ভারত ভ্রমণকারী র‌্যালফ ফিৎসের মতে, ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তেরো মাইল দূরে অবস্থিত সোনারগাঁ ছিল এমন একটি শহর যেখানে সমগ্র ভারতের মধ্যে সবচেয়ে মিহি কাপড় তৈরি করা হতো।

কোম্পানি ও ব্রিটিশ আমলজুড়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার আরোপিত নানাবিধ বাধা এবং ব্রিটেন হতে আমদানিকৃত যন্ত্রে সস্তা কাপড় জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টার কারণে ঢাকার তাঁতিদের চরমভাবে মূল্য দিতে হয়। ১৮৪৪ সালে ঢাকার ডিভিশনাল কমিশনার জন ডানবার ঢাকার বস্ত্রশিল্পের ওপর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, সে বছরে ঢাকা থেকে রপ্তানিকৃত সুতি বস্ত্রের মোট মূল্য ছিল ৯,৩৬,০০০ টাকা, যা ছিল ১৭৪৭ সালের রপ্তানি মূল্যের এক-তৃতীয়াংশ।

ডানবার আরও বলেন, এখন আর কোনো সুতি বস্ত্র ঢাকা থেকে ইউরোপে রপ্তানি করা হয় না। অধিকন্তু সুতাকাটা যদিও শিল্প হিসাবে এখনো টিকে আছে তবে তা বিলেত থেকে আমদানিকৃত সুতার কাছে ভীষণভাবে মার খাচ্ছে। সুতাকাটা যা এক সময় বহু লোকের কর্মসংস্থান জোগাত, বিলেত থেকে আমদানিকৃত সুতার জন্য তা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে কেননা বিলেত থেকে আনা সুতা অনুরূপ মানের স্থানীয়ভাবে তৈরি সুতা থেকে অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। কিন্তু এ অবস্থা পালটে যেতে থাকে বিশ শতকের গোড়াতে, যখন স্বদেশি আন্দোলনের উদ্দীপনায় স্থানীয়ভাবে হস্তচালিত তাঁতে তৈরি মোটা কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায় এবং এর ফলে উৎপাদনও বাড়ে।

‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়

মাথায় তুলে নেরে ভাই;

দীন দুঃখিনী মা যে মোদের

তার বেশি আর সাধ্য নাই।’

সূর্য্যকুমার বসু, মোহিনী মোহন চক্রবর্তী, রমেশচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখকে এ দেশাত্মবোধক সংগীত বোধকরি উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। বিশ শতকের প্রথম দশকে স্বদেশি আন্দোলন চলাকালে আধুনিক ধারায় শিল্প স্থাপনের প্রচেষ্টা বাঙালি শিল্পোদ্যোগের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিদেশি পণ্য বর্জন আন্দোলনের ফলে তাঁতের কাপড়ের নতুন চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় হস্তচালিত তাঁতশিল্প চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মূল্যবোধ কোনো একটি খাতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কীভাবে উৎসাহিত করতে পারে তার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় স্বদেশি যুগে। ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ সালে স্বদেশি ভাবাদর্শের প্রভাব বাংলার তাঁতশিল্পের বিকাশে খুবই সহায়ক হয়েছিল। সুতিবস্ত্র খাতে স্বদেশি উদ্যোগের মধ্যে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল (১৯০৬), কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল (১৯০৮), বেঙ্গল হোসিয়ারি কোং (১৯০৮) এবং আরও কয়েকটি ক্ষুদ্রায়তন সুতাবয়ন প্রতিষ্ঠান। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল কম। তখন বস্ত্রশিল্পে বোম্বাইওয়ালাদের একচেটিয়া বাজার। বোম্বাইওয়ালাদের দুর্গম দুর্ভেদ্য বৃত্ত ভেদ করতে পারে এমন বাঙালি তখন কমই ছিল। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে একজন বাঙালি শিল্পোদ্যোগী পুরুষের আবির্ভাব হয়। তিনি ছিলেন সূর্য্যকুমার বসু। এস. কে. বোস নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন।

দীননাথ সেনের জীবনীতে উঠে এসেছে, সূর্য্যকুমার বসুর কথা। শ্রী আদিনাথ সেন লিখেছেন, ‘সোনারং-এর নিকটবর্তী রাউৎভোগ নিবাসী সূর্য্যকুমার বসুর মহৎকীর্তি ঢাকেশ্বরী কটন মিল। কষ্টের সহিত উচ্চ বিদ্যা লাভ করিয়া আমেদাবাদে বস্ত্র শিল্পের মিলে কাজ শিখিয়া বঙ্গলক্ষী কটন মিলে ১২ বৎসর কাজ করেন। পরে ময়মনসিংহের বিখ্যাত উকীল অনাথ বন্ধু গুহের পুত্র অখিল বন্ধু গুহের এবং মানিকগঞ্জের খ্যাতনামা মোক্তার রজনী বসাকের সহিত মিলিত হইয়া ঢাকেশ্বরী কটন মিল স্থাপন করেন। সূর্য্যকুমার একজন অতিশয় পরোপকারী ও কর্মঠ লোক। ঢাকা হিন্দুমহাসভার সভাপতি ছিলেন এবং তাঁহার প্রভাব অনেক রাজনৈতিক কার্যে প্রতিফলিত হইয়াছে।’ ১৯২২ সালে ‘দি ঢাকেশ্বরী কটন মিল’ রেজিস্ট্রেশন লাভ করে। ১৯২৭ সালে শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে গোদনাইলে শীতলক্ষ্যার মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ঢাকেশ্বরী মিলের বয়ন কাজ আরম্ভ হয়। ঢাকেশ্বরী মিলের লভ্যাংশ দিয়ে ১৯৩৭ সালে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের দ্বিতীয় ইউনিট প্রতিষ্ঠা হয়। বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সার্ভে কমিটির তথ্য মোতাবেক, কার্যকরীভাবে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি কটন মিলের কমপক্ষে ৫০০টি তাঁত, ১৭,৫০০টি টাকু এবং ২০ লাখ রুপি মূলধন আবশ্যক ছিল। ১৯৩৭ সালে বেঙ্গল কটন মিলের বিশ্লেষণে দেখা যায় ঢাকেশ্বরী, বেঙ্গল লক্ষ্মী, বাউড়িয়া, কেশোরাম, মোহিনী এবং শ্রী রাধা কৃষ্ণ-শুধু এই ৬টি মিলেরই প্রয়োজনীয় সংখ্যক তাঁত ও টাকু ছিল। তবে এদের মধ্যে ঢাকেশ্বরী, কেশোরাম এবং শ্রী রাধা কৃষ্ণ মিল-এ তিনটি মিলই শুধু ২০ লাখ রুপির বেশি মূলধন বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিল। ঢাকেশ্বরী কটন মিলে নিযুক্ত ছিল ২,৫০০ জনেরও বেশি শ্রমিক।

সূর্য্যকুমার বসুর পরিশ্রমের তুলনা হয় না। তিনি মহাজনদের ঘরে ঘরে গিয়ে কাপড় দিয়ে আসতেন। ঢাকেশ্বরী মিলে প্রস্তুত দেশবন্ধু ধুতি ও যমুনা শাড়ির জন্য কলকাতার বাজারে কাপড়ের দোকানগুলোতে বেশ ভিড় হতো। পূর্ববঙ্গ ও আসামেই ঢাকেশ্বরী কাপড়ের এত কাটতি ছিল যে, কলকাতার বাজারে পর্যাপ্ত জোগান দেওয়া যেত না। ১৯৪৭ সালে বিদ্যমান ১২টি সুতি বস্ত্র মিলের মধ্যে বৃহত্তর ৩টির মালিক ছিলেন সূর্য্যকুমার বসু।

এগুলো হচ্ছে ঢাকেশ্বরী কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল এবং লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিল। বোস গ্লাস ওয়ার্কস এবং আরও একাধিক প্রতিষ্ঠানেরও মালিক ছিলেন সূর্য্যকুমার। দি আদর্শ কটন স্পিনিং অ্যান্ড উইভিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও দি কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালকও ছিলেন সূর্য্যকুমার। এছাড়া বেঙ্গল মিল পার্টনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল কটন কানট্রির সভাপতি ও ঢাকা জেলা ন্যাশনাল চেম্বার্স অব কমার্সের সভাপতি ছিলেন তিনি।

১৯৩০ দশকের শেষ নাগাদ ঢাকেশ্বরী কটন মিল বাংলার সবচেয়ে লাভজনক মিলগুলোর অন্যতম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকেশ্বরী কটন মিলকে বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্পের পথপ্রদর্শক হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এ মিলের সঙ্গে জুট প্রেসগুলো মিলে এমন একটি শিল্প পরিবেশ গড়ে ওঠে যার ফলে হস্তচালিত তাঁতশিল্পের যেমন বিকাশ ঘটে, তেমনি নানা আনুষঙ্গিক শিল্পও গড়ে ওঠে।

ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ব্যবসায়িক সাফল্যের অন্যতম একটি কারণ ছিল উৎকৃষ্ট মানের কার্পাসের সরবরাহ। এ কার্পাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়, প্রবাসীতে (জৈষ্ঠ্য ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত শ্রী সুবিনয় ভট্টাচার্যের লেখা বঙ্গে কার্পাস-চাষ নিবন্ধ থেকে। নিবন্ধে সুবিনয় লিখেছেন, ‘ঢাকেশ্বরী কটন মিলের প্রচেষ্টা সকল দিক দিয়া অতীব সন্তোষজনক বলা চলে। উক্ত মিলের কার্পাস-চাষ-বিশেষজ্ঞ কর্মচারী শ্রীযুক্ত সারদাচরণ চক্রবর্ত্তী ঢাকায় এক প্রকার তুলা উৎপন্ন করিয়াছেন যাহার সূক্ষ্ম শক্ত আঁশ ১ ইঞ্চি লম্বা।

বাংলা কেন সারা ভারতবর্ষের কোথাও এরূপ উৎকৃষ্ট তুলা হইতে পারে বলিয়া কাহারও ধারণা ছিল না। ঢাকেশ্বরী মিলে গত তিন বৎসর যাবৎ যে তুলা উৎপন্ন হইতেছে ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের তুলনায় তাহার ফলন যেমন অধিক, তাহার উৎকর্ষতাও বিশেষজ্ঞদের মতে যে দেশের বীজ হইতে ঐ তুলা উৎপন্ন হইয়াছে তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী। ঢাকেশ্বরী কটন মিলের সাফল্যে ও উৎসাহে বঙ্গীয় মিল-মালিক-সমিতি বঙ্গীয় গভর্নমেন্টের কৃষি-বিভাগের সহিত সম্মিলিতভাবে গত বৎসর একটি তুলা-চাষের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করিয়াছেন।’

ঢাকেশ্বরী কটন মিল সম্পর্কিত নানা তথ্যের খোঁজ পাওয়া যায় মিলটির বিভিন্ন বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন ও কার্যবিবরণী থেকে। ঢাকেশ্বরী কটন মিলস লিমিটেডের পঞ্চদশ বার্ষিক প্রতিবেদন (১৯৩৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ও হিসাবের শুরুতেই লেখা, ‘বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্পের ভবিষ্যৎ যে নৈরাশ্যজনক নহে, কাপড়ের কলের শেয়ার ক্রয় করা যে একটি লাভজনক লগ্নীর কারবার, কটন মিল পরিচালনায় যে এ দুর্দিনের বাজারেও বাঙালি বোম্বাই আহমেদাবাদের সহিত প্রতিযোগিতা করিতে পারে, ঢাকেশ্বরীর এই রিপোর্ট ও হিসাব তাহাই প্রমাণ করিতেছে।’ ১৯৩৭ সালে মিলটির মোট লাভ হয় ৮,৮৭,২১৪ টাকা, যেখানে ১৯৩৬ সালে মোট লাভ ছিল ৭,৮৭,৪৫২ টাকা। ১৯৩৭ সালে নিট লাভ হয় ৫,১৪,২৫৪ টাকা।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের খোঁজ পাওয়া যায় এ প্রতিবেদনে- ‘ইস্টবেঙ্গল জুট অ্যান্ড কটন মিলের সহিত ঢাকেশ্বরীর মিলিত হইবার প্রস্তাব পূর্ব্ব হইতেই চলিতেছিল। আলোচ্য বৎসরে ২৫-৪-৩৭ তারিখ হইতে ঢাকেশ্বরী কটন মিল ইষ্টবেঙ্গল জুট এন্ড কটন মিলের সহিত যুক্ত হইয়া গিয়াছে। ৫৬০০ ঘোড়ার শক্তিবিশিষ্ট বিরাট আকারের একটি ষ্টিম টার্বাইন যন্ত্রের সাহায্যে এই নতুন মিল পরিচালিত হইবে। এই টারবাইন যন্ত্রে যে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্ন হইবে তাহার দ্বারা দুইটি মিলই চালান যাইতে পারে। এই দুইটি মিল শীতলাক্ষীর পূর্ব্ব ও পশ্চিম তীরে অবস্থিত, সুতরাং ২নং মিল হইতে তড়িৎশক্তি বহন করিয়া ঢাকেশ্বরী কটন মিলে নিবার জন্য নদীর মধ্য দিয়া মোটা তার (পধনষব) বসান হইবে। সম্প্রতি শক্তি উৎপাদনের ষ্টীম, টারবাইন, ২১২৮০ টাকু এবং ৫০০ তাঁতের অর্ডার দেওয়া হইয়া গিয়াছে।... আশা করা যায় আগামী জুলাই মাসের মধ্যে নূতন মিল চালু হইবে।... এক সময় শ্রীরামপুরকে কেন্দ্র করিয়া যেমন গঙ্গার দুই ধারে এবং কলিকাতার নিকটবর্ত্তী স্থানে কাপড়ের কল, কাগজের কল, পাটের কল প্রভৃতি গড়িয়া উঠিয়াছিল;-বর্ত্তমান সময়ে তেমনি পূর্ব্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জকে কেন্দ্র করিয়া শীতলাক্ষীর উভয় তীরে এবং সেকালের মসলিনের জন্মভূমি ঢাকা শহরের নিকটবর্ত্তী স্থানে কাপড়ের কল,-একটি পর একটি ক্রমশঃ গড়িয়া উঠিতেছে।’

ঢাকেশ্বরী কটন মিলের আরেকটি ব্যতিক্রমী দিক ছিল, যখন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই কোনো না কোনো ম্যানেজিং এজেন্ট দ্বারা পরিচালিত হতো তেমন একটি সময়ে তারা নিজেরাই নিজেদের ম্যানেজিং এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন এবং স্বীয় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ক্যাপিটাল পরিপূর্ণভাবে বাড়াতে পেরেছেন। ১৯৩৭ সালের প্রতিবেদনটিতে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ম্যানেজিং এজেন্টস হিসাবে শ্রীযুক্ত অখিলবন্ধু গুহ, রজনীমোহন বসাক এবং শ্রীসূর্য্যকুমার বসুর নাম উল্লেখ রয়েছে।

ঢাকেশ্বরী কটন মিলের মামলা

১৯৩৪ সালের ৮ এপ্রিল ঢাকেশ্বরী কটন মিলের পরিচালকদের সভায় ১৯৩৩ সালের ড্রাফট ব্যালেন্স শিট পাশ হয়। সেখানে নরেন্দ্রনাথ বসাক নামে একজন পরিচালকের কিছু আপত্তি ছিল। একই বছরের ৮ মে চারুচন্দ্র গুহ নামক কোম্পানির আরেকজন পরিচালক কোম্পানির হিসাবপত্রে অনেক গলদ আছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ১৯৩৪ সালের ১৫ মে নৃপেন্দ্র মোহন ঘোষাল নামক ঢাকেশ্বরী কটন মিলের একজন অংশীদার এ মর্মে অভিযোগ করেন যে, ‘ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ম্যানেজিং ডাইরেক্টররা (শ্রীযুক্ত অখিলবন্ধু গুহ, শ্রীযুক্ত রজনীমোহন বসাক এবং শ্রীযুক্ত সূর্য্যকুমার বসু) ১৯৩৩ সালের ব্যালেন্স শিটে জ্ঞাতসারে এবং ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা হিসাব দিয়াছেন।’ এটি ছিল কোম্পানি আইনের ২৮২ ধারার মামলা। যা সে সময় দেশব্যাপী বেশ আলোড়ন তুলেছিল। ১৯৩৫ সালের ২৯ মার্চ মামলার শুনানি আরম্ভ হয়। আসামিপক্ষে ১৩ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়।

ঢাকেশ্বরী কটন মিলের তহবিল থেকে ঋণ অথবা ওভার ড্রাফট হিসাবে ইস্টবেঙ্গল জুট অ্যান্ড কটন মিলকে যে আর্থিক সাহায্য করা হয়েছিল তা ব্যালেন্স শিটে পৃথকভাবে দেখান হয়নি বলে কোম্পানি আইন অনুসারে দূষণীয় বলে সাব্যস্ত হয়। ঢাকা সেশন জজের বিচারে অভিযুক্ত ম্যানেজিং ডিরেক্টররা খালাস পান। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে তাদের তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়। পরে অভিযুক্তরা গভর্নরের কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন জানান। সেকালের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ আবেদনে সমর্থন জানান। ব্যক্তিত্রয়ের সাময়িক অভাবে উদীয়মান ঢাকেশ্বরী মিল ক্ষতিগ্রস্ত হবে মর্মে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

কারাদণ্ডের পরিবর্তে গভর্নর জরিমানা সাব্যস্ত করে শাস্তি লাঘব করেন। এ বিষয়ে গভর্নরের মন্তব্য ছিল, ‘এই মোকদ্দমায় জন সাধারণের স্বার্থের পক্ষে এমন কতকগুলি বিবেচ্য বিষয় আছে যাহা কোর্ট কর্তৃক বিবেচিত হয় নাই বা কোর্টের বিবেচনাধীনে আসে নাই; যথা-উক্ত মিলের যে তিনজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর সেই তিনজনই একসঙ্গে এতদিনের জন্য জেলে গেলে মিলটির ভবিষ্যৎ কি হইবে? আমার নিকট যে আবেদন করা হইয়াছে তাহার সত্যতার সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নাই। ঢাকেশ্বরী কটন মিল যে দীর্ঘকাল ধরিয়া খুব কৃতিত্ব এবং সাফল্যের সহিত পরিচালিত হইতেছে ইহা সত্য এবং এ মিলে বহুসংখ্যক লোক জীবিকার্জন করিয়া খাইতেছে ইহাও সত্য। আজ একসঙ্গে যদি তিনজন পরিচালকই জেলে আবদ্ধ হন তবে মিলটি এবং মিলের সংশ্লিষ্ট অসংখ্য লোক পথে বসিবে।

সুতরাং আবেদনকারীগণের এই নিবেদনের সমীচীনতা সম্বন্ধে যে যথেষ্ট ভিত্তি আছে তদ্বিষয়ে গভর্নমেন্ট সন্দিহান নহেন। ...এই সমুদয় বিবেচনা করিয়া সপরিষদ মহামান্য গভর্নর বাহাদুর জেলের পরিবর্তে ডিরেক্টরদিগের প্রত্যেককে আরও ৫০০ টাকা জরিমানা করাই সাব্যস্ত করিলেন এবং তাহা হইলে সাধারণের স্বার্থ এবং আইনের মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে অক্ষুণ্ন্ন থাকিবে।’ মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায় যে, মামলার ফরিয়াদী অভিযোগকারী নৃপেন্দ্র মোহন ঘোষাল ছিলেন দশ টাকা মূল্যের একটি শেয়ারের মালিক মাত্র। মূলত নেপথ্যে কোম্পানির পরিচালক নরেন্দ্রনাথ বসাক ও চারুচন্দ্র গুহই এ মামলাটি পরিচালনা করেছেন। চারুচন্দ্র গুহ ছিলেন সেকালের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘ইস্টবেঙ্গল টাইমস’-এর সম্পাদক। পত্রিকাটিতে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের মামলার বিষয়ে নিয়মিত খবর প্রকাশ পেত। ধারণা করা হয়, ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত এ মামলা রুজু করা হয়েছিল।

ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ১৯৩৯ সালের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, এ বছর নানা প্রতিকূল অবস্থার মাঝে পড়তে হয় মিলটিকে। তারপরও ঢাকেশ্বরীর দুটি মিলের নিট লাভ ছিল ৩,০৩,৭৯৩ টাকা। সাধারণ অংশীদারদের আয়কর বর্জিত শতকরা বার্ষিক দশ টাকা হারে এবং প্রেফারেন্স শেয়ার হোল্ডারদের শতকরা বার্ষিক ছয় টাকা হারে লভ্যাংশ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন পরিচালকরা। ১৯৪৭ সালের ১০ নভেম্বর ‘আর্থিক জগৎ’ পত্রিকায় ঢাকেশ্বরী কটন মিলের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানের খবর প্রকাশিত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ কোম্পানির ২৪তম বার্ষিক সাধারণ সভায় ঢাকেশ্বরীর উৎপত্তি সম্বন্ধে আলোচনা হয়। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সূর্য্যকুমার বসু কটন মিলটির ১৯৪৬ সালের কার‌্যাবলির বিস্তারিত বিবরণ দেন। অস্বাভাবিক প্রতিকূল অবস্থাতেও এ বছর কোম্পানির নিট লাভ হয় ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৫৯ টাকা ৯ আনা ৮ পাই।

ঢাকেশ্বরী কটন মিলে যেমন বস্ত্র তৈরি হতো, কাপড় বয়নের সামগ্রী সুতাও তৈরি হতো। এ সুতা ব্যবহার করত হস্তচালিত তাঁতের তাঁতশিল্পীরা। ব্যবসায়ীরা এসব মিলের তৈরি কাপড় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করত। হাতের কাছেই সুতারং পাওয়া যাচ্ছে বিধায় আরও তাঁতিদের আরও নতুন তাঁত বসাতে প্রেরণা দেয়। তদপূর্বে এরা দিনমজুর হিসাবে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। বৃহৎ সুতাকল ও বয়নশিল্প বিকাশের কারণে ডাইং, ওয়াশিং ও প্যাকেজিং শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে। নারায়ণগঞ্জ কার্যত নানা শিল্পের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর শিল্পবান্ধব পরিবেশের অভাবে উদ্যোক্তা শ্রেণির একটা বড় অংশ তাদের মূলধন নিয়ে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করলেও সূর্য্যকুমার বসু ছিলেন ব্যতিক্রম। ১৯৫০ সালে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের জীর্ণ স্পিন্ডলগুলো পালটাতে আর সেই সঙ্গে এটিকে কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলে আধুনিকীকরণ করতে বেশকিছু সংস্কার ও পুনঃবিনিয়োগ করেন। স্পিনিং-এর জন্য স্পিন্ডল (টাকু) এবং বুননের জন্য তাঁতের সংখ্যা যথাক্রমে ২৮,৫০০ ও ৭৮০-তে উন্নীত করা হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ঢাকেশ্বরী কটন মিলস, লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলস, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ও আদর্শ কটন মিল শত্রু সম্পত্তি হিসাবে পরিগণিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এসব মিল রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। শিল্পবিপ্লবের এসব উদ্যোগ আজ শুধুই ইতিহাস।

লেখক : গবেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম