Logo
Logo
×

বাতায়ন

অন্যের ব্যর্থতা বললে নিজের সফলতা বোঝায় না

Icon

ড. খুরশিদ আলম

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অন্যের ব্যর্থতা বললে নিজের সফলতা বোঝায় না

ফাইল ছবি

কিছুদিন আগে দেশে শিশুরা বিদ্রোহ করেছে। আমি গভীরভাবে লক্ষ করেছি, শিশুরা কথা বলা শুরু করার আগেই বিদ্রোহ করে। কথা বলতে শেখার আগে যদি সে কোনো কিছু হাত দিয়ে ধরে, তখন তার কাছ থেকে তা নেয়া যায় না। আবার সে যদি কিছু চায়, তা না দিলেও সে রাগ করে।

শিশুরা বিদ্রোহী হয়ে মায়ের কোলে বসে মাকেও খামচি দেয়। মা বুঝতে পারে, শিশুটি তার ওপর ভীষণ রাগ করেছে। একটু বড় হলে নানা-নানির কাছে মায়ের বিরুদ্ধে নালিশও দেয়। এভাবে ছোট থেকে বড় হতে থাকে আর তার বিদ্রোহ কমতে থাকে। কিন্তু যখন এই শিশুটি কচি কচি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কোনো কিছুর প্রতিবাদ করে এবং তা যদি সবাই মিলে রাস্তায় নেমে করে, তাহলে সে বিষয়ে যৌক্তিকতা খোঁজার আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

যে শিশুটিকে নিয়ম মানার জন্য দিনরাত কত কথা শুনতে হয়, সে শিশুটি যদি আমাদের নিয়ম মানার জন্য তাগিদ দেয়- তবে বুঝতে হবে, আমরা নিজেরাই নির্বোধ হয়ে গেছি নতুবা স্বজ্ঞানে নেই।

শিশুরা যে আন্দোলন রাস্তায় নেমে করেছে, তাকে বিদ্রোহ বলা যাবে কিনা, এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা তর্কাতর্কি করতে পারেন। কিন্তু তারা যে প্রতিবাদ করেছে এবং একসঙ্গে নিয়ম শিখিয়েছে, এটি পৃথিবীর আন্দোলনের ইতিহাসে আর কখনও কোথাও ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। বড়দের নিয়ম মানার জন্য ছোটদের বিদ্রোহ করতে হয়- এমনটি তেমন শোনা যায় না। মানব ইতিহাসের আড়াই হাজার বছরে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে কোথাও পড়িনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দেখতাম, ১২-১৫ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে কলাভবনের সামনে দিয়ে মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যেতে। তার বক্তৃতায় কখনও কোনো অশ্লীল বাক্য শুনিনি; স্লোগানে কোনো অশ্রাব্য কিছু ছিল না। অত্যন্ত শক্ত সামর্থ্য একজন মানুষ, ভালো ছাত্র ছিলেন। কিন্তু প্রায় দু’বছর আগে প্রথম বুঝতে পারি- তিনি যে পদ্ধতিতে এগোচ্ছেন, সে পদ্ধতিতে সফলতা অর্জন করা কঠিন।

তিনি মন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে ১৯৯০ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে প্রথম দু’বছর নিুপদস্থ কর্মকর্তাদের ধমকা-ধমকি করি। কিন্তু দেখি যে, তাতে পরিস্থিতির ১-২%-এর বেশি উন্নতি হয়নি। তখন বুঝতে পারি, আসলে দরকার সিস্টেম তৈরি করা। তাই পরবর্তীকালে সিস্টেম তৈরির প্রতি মনোযোগ দিই। বিভিন্ন রকমের গবেষণা করে সমস্যার সমাধান বের করি। পানি উন্নয়ন বোর্ডে খুব কম খরচে কম সময়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়।

এতে শুধু এডিপি বাস্তবায়নেই ৯৮-৯৯% সফলতা পাওয়া যায়। প্রকল্প এলাকায় বছরের মে মাসেই সব উন্নয়ন কাজ শেষ হয়ে যেত। এ ছাড়া যে নিয়মগুলো তৈরি করে দেয়া হয়েছে, যেসব সংস্কার করে দেয়া হয়েছে; তাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনেক উন্নতি হয়েছিল এবং তার অনেকগুলো এখনও বহাল আছে। বাকিগুলো উধাও হয়ে গেছে।

প্রথমে পানি উন্নয়ন বোর্ডে গিয়ে দেখি- এর নামের মধ্যেই গণ্ডগোল। পানি তো উন্নয়ন করা যায় না, পানি ব্যবস্থাপনা করতে হয়। ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইলাম। কিন্তু কেউ তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। তাই ১৯৯১ সালে প্রথমেই এটার নাম পরিবর্তন করার জন্য বলি।

এখন পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের নাম পরিবর্তন করে পানি ব্যবস্থাপনা বোর্ড করা হয়নি। ওই বিভাগে আগে-পরে অনেক সিএসপি অফিসার এসেছেন, গেছেন; ধমকা-ধমকি করেছেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেননি; সহকর্মীদের আস্থায় নিতে পারেননি।

আসলে আমাদের দেশে চলে ‘ম্যানেজমেন্ট বাই শাউটিং’ (ধমকা-ধমকির ব্যবস্থাপনা); অথচ দরকার ‘ম্যানেজমেন্ট বাই সিস্টেম’ (নিয়ম দিয়ে ব্যবস্থাপনা)। মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে সে সিস্টেম তৈরি করতে হবে। আর সে সিস্টেম চলছে কিনা- তার জন্য প্রতিদিন নয়, মাঝে মাঝে মাঠে গিয়ে দেখতে হবে।

যে কোনো সমস্যার সমাধান চাইলেই করা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য চাই একটি সিস্টেম তৈরি করা। ড্রাইভারদের জেল-জুলুম, ফাঁসি দিয়ে কোনো লাভ হবে না, তার আগে দরকার নিয়মটি ঠিক করা। এরপর তাদেরকে নিয়ম মানতে অনুপ্রাণিত করা এবং যারা মানবেন না, তাদের তখন শাস্তির ব্যবস্থা করা।

শিশুরা যে ৯ দফা দাবি দিয়েছে, তার যৌক্তিকতা বোঝানোর কোনো দরকার নেই। শিশুরা নিরাপদ সড়কের যে দাবি করেছে, তার জন্য বেশিকিছু করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। যেমন গোটা সড়ককে যদি একটা সিস্টেম ধরা হয়- তার দুটো দিক আছে; একটি হচ্ছে সিস্টেম ইউজার বা সড়ক ব্যবহারকারী, আরেকটি হচ্ছে সিস্টেম ম্যানেজার বা সড়ক ব্যবস্থাপক।

প্রথমে সড়ক ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। তার জন্য অল্প কিছু কাজ যেমন রাস্তার ডিজাইন ঠিক করা, জায়গার সংকট থাকলে ওয়ান ওয়ে করা; বিকল্প রাস্তা চিহ্নিত করা (সড়ক, নৌ ও রেলপথ), না করা পর্যন্ত ধীরে গাড়ি চালানোর জন্য ব্রেকারের ব্যবস্থা করা, জেব্রা ক্রসিং দেয়া, ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডার পাস যথাযথ নিয়মে এবং যথাস্থানে সঠিক ডিজাইনে নির্মাণ করা (বর্তমানে আশি ভাগই ঠিক নেই), গাড়ির ডিজাইন ঠিক করা, গাড়ির লাইসেন্স নিশ্চিত করা, গাড়ির ফিটনেস নিশ্চিত করা, গাড়ির চাহিদা কমানো ইত্যাদি।

আবার রাস্তা ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে চালকের লাইসেন্স নিশ্চিত করা, চালকের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, মালিক দ্বারা গাড়ির চালকের লাইসেন্স নিশ্চিত করা না হলে মালিকের জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি না থামালে জরিমানার ব্যবস্থা করা, ফ্র্যাঞ্চাইজ করা, লাইন ধরে গাড়িতে তোলা এবং নামানো, মহিলা-শিশু ও প্রতিবন্ধীর প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া ইত্যাদি।

পরিবর্তনের প্রয়োজনে দু-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এলজিইডিতে কাজ করার সময় রাস্তার ডিজাইন পর্যালোচনা করে সে প্রকল্পের সব কটি রাস্তার ডিজাইন পুনরায় ঠিক করার জন্য ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারকে বাধ্য করি; কারণ তাতে সড়ক নিরাপত্তার কথা সামান্যতমও বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড তার একটি বড় প্রমাণ। প্রথম যেদিন পার হলাম, সেদিন দেখেই বুঝলাম- এখানে প্রতিদিন দু-একটা দুর্ঘটনা ঘটবেই! আমার ড্রাইভারকেও তা বললাম। পরে পত্রিকায় পড়ি- প্রতি মাসে যমুনা সেতুর অ্যাপ্রোচ রোডে গড়ে প্রায় ৫ জন লোক মারা যায়।

অবশ্য এরপর কিছুটা পরিবর্তন সেখানে আনা হয়েছে। তবে তা এখনও নিরাপদ গাড়ি চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। চালকদের আগে মরণফাঁদ তৈরিকারী এসব রাস্তার ডিজাইনারের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখা দরকার। একটি অবকাঠামো তৈরিতে কী কী আর্থসামাজিক বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, তা আমাদের প্রকৌশল বিভাগগুলোতে ভালোভাবে পড়ানো দরকার।

আবার গাড়ির ফিটনেস না থাকলে সেটি চালাতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। চালক যদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হন, ড্রাগ গ্রহণকারী হন, ক্লান্ত বা শ্রান্ত হন, মালিকের লোভের টাকা জোগাড় করার জন্য অবিবেচক হয়ে ওঠেন, তাহলে কী ঘটবে; তা যে কারও পক্ষে অনুমেয়।

মালিক ও ড্রাইভারদের এ ধারণা দিতে হবে- তারা যাত্রীদের সেবা দিচ্ছেন। এ ধারণা আমি কোনো মালিক বা ড্রাইভারের মধ্যে দেখিনি। মালিক সমিতিকে এটি করতে খুব সহজে বাধ্য করা যায়। তাতে তাদেরও বোধোদয় হবে, শ্রমিকদেরও হবে।

সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে মালিকদের উদ্যোগ ও সহযোগিতা বেশি নিতে হবে; তাদের শত্রু ভাবলে চলবে না। রুট পারমিট দেয়ার আগে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ মালিক নিশ্চিত করেছেন কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৫ বছর ধরে গাড়ি চালায়, এমন যত ড্রাইভার পেয়েছি; তারা কেউ জানে না- রাস্তাটি কত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে সে দুর্ঘটনা ঘটাবেই। আবার পথচারীদের কিছু নিয়ম মানতে বাধ্য করতে হবে। পাশাপাশি জরিমানাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

সরকারের সব দায়িত্ববান মাননীয় মন্ত্রীদের আরও বেশি তৎপর হওয়া দরকার। সিস্টেম তৈরি করতে হবে, সবাইকে আস্থায় নিতে হবে। মাননীয় মন্ত্রীদের মনে রাখতে হবে, অন্যের ব্যর্থতা বললে নিজের সফলতা বোঝায় না। অন্যরা ফেল করেছে বললে নিজের পাস করা বোঝায় না।

সড়কের বেহাল দশা দূর করার জন্য সঠিক করণীয় ঠিক করতে হবে, যে বিষয়ে অনেক সুপারিশ সরকারের কাছে রয়েছে। সবাই মিলে তা বাস্তবায়ন করা দরকার। যারা এগুলো নিয়ে কাজ করছে তাদের সহযোগিতা করা দরকার। এটি করার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। বিদ্রোহ নয়, শিশুরা মূলত সেটিই নির্দেশ করেছে।

ড. খুরশিদ আলম : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট এবং সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক

khurshedbisr@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম