আশেপাশে চারপাশে
ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সুসমন্বিত করতে হবে
চপল বাশার
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ খুব সহজ কাজ নয়। ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে দেখা যায়, এক ব্যক্তি বা পরিবার একাধিকবার ত্রাণসামগ্রী পেয়েছেন; আবার অনেকে একবারও পাননি। বিশেষ করে প্রত্যন্ত দুর্গত এলাকায় এমনটি ঘটে। তাই সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ খুব সহজ নয়। তবুও ত্রাণ বিতরণ আগের চেয়ে অনেক ভালোভাবে চলছে। এ কাজটি শতভাগ সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব, যদি সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতায় যথাযথ সমন্বয় থাকে।
ত্রাণ বিতরণের চেয়ে বন্যার্ত মানুষের পুনর্বাসন আরও কঠিন কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর দুর্গত মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ বসতভিটায় ফিরে দেখতে পান তাদের ঘর বন্যার পানিতে ভেসে গেছে অথবা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে। সামান্য জিনিসপত্র যা রেখে গিয়েছিলেন, যেটুকু ফসল গোলায় ছিল, সব ভেসে গেছে বন্যায়। মাথার উপর ছাদ নেই, রাত কাটানোর জায়গা নেই, বেঁচে থাকার মতো খাবার নেই-বন্যার্ত মানুষ সব হারিয়ে অসহায়। আশ্রয়কেন্দ্রে তবু মাথার উপর ছাদ ছিল, খাবার পাওয়া যেত, পানীয় জল ছিল; কিন্তু বন্যায় বিধ্বস্ত নিজ বসতভিটায় এসব কিছুই নেই। বন্যার্ত বিপন্ন মানুষ এখন যাবেন কোথায়? তাদের সার্বিক পুনর্বাসনের কাজটি কঠিন হলেও করতে হবে। এ দায়িত্ব রাষ্ট্র, সরকার ও দেশপ্রেমিক সব মানুষের।
দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলা এবার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। ২০ আগস্ট শুরু হওয়া বন্যায় প্লাবিত জেলাগুলো হচ্ছে-কুমিল্লা, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। বন্যায় আক্রান্ত হয় অর্ধকোটির বেশি মানুষ। ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে বন্যার পানি এখন নেমে যাচ্ছে। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে এখনো বন্যার পানি রয়েছে, নামছে ধীরগতিতে।
৩ সেপ্টেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগসংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যাকবলিত জেলাগুলো থেকে এ পর্যন্ত ৭১ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৫ পুরুষ, ৭ নারী ও ১৯টি শিশু। বন্যাদুর্গত এলাকায় এদের বেশিরভাগ মারা গেছেন পানিতে ডুবে, সাপের কামড়ে ও বন্যাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রোগে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ এখনো কিছু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে জানানো হয়, কয়েক লাখ পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে না গেলে তাদের দুর্দশা ঘুচবে না। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ৩ হাজার ৬১৫ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এগুলোতে ৩ লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়।
বিপুল ক্ষয়ক্ষতি
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন নিজ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। কিন্তু বসতভিটায় ফিরে কেউই নিজের ঘর অক্ষত পাননি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বলছেন, এমন ভয়াবহ বন্যা তারা আর দেখেননি। বাড়িঘরের ক্ষতি ছাড়াও কৃষির ক্ষতি বিপুল। মাঠের ফসল নষ্ট হয়েছে, পুকুর প্লাবিত হওয়ায় মাছের খামার ভেসে গেছে, হাঁস-মুরগির খামারের ক্ষয়ক্ষতিও ব্যাপক।
এটা ঠিক, দেশের পূর্বাঞ্চলে এবার যে বন্যা হলো, উপদ্রুত এলাকার মানুষের জন্য সেটা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এর চেয়ে ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার অভিজ্ঞতা দেশবাসীর আছে। প্রবীণ মানুষের এখনো মনে আছে ১৯৫৪ ও ৫৫ সালে পরপর ২ বছরের বন্যার কথা। এ দুই বন্যা ঢাকা শহরসহ সারা দেশ প্লাবিত করেছিল। ১৯৭৪ সালের বন্যাও দীর্ঘস্থায়ী ছিল এবং কৃষির ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। সে কারণে ওই বছর দেশে খাদ্যাভাব হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যার কথা সবার মনে আছে। রাজধানী ঢাকার প্রায় পুরো এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। বঙ্গভবন ও গুলশান-বারিধারা কূটনৈতিক এলাকার সবকটি দূতাবাসে বন্যার পানি ঢুকেছিল।
উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ তাদের অভিজ্ঞতায় এবার সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিলেন, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। তবে এ ক্ষতি আরও অনেক বেশি হতো, যদি বন্যা হতো দীর্ঘস্থায়ী। ২ সপ্তাহের মধ্যেই পানি নেমে গেছে বা নামতে শুরু করেছে। বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষকে এখন শক্তি ও সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এজন্য অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটাই এখন জরুরি।
প্রয়োজন সার্বিক পুনর্বাসন
বন্যার্ত মানুষদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা হতে হবে সার্বিক, কার্যকর ও ব্যতিক্রমী। কারণ এবারের বন্যাও ছিল ব্যতিক্রমী ও বিধ্বংসী। মাত্র ২-৩ দিনের মধ্যে উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢল ও তীব্র স্রোত সবকিছু ভেঙেচুরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। পানির ঢল যে কী তীব্রগতিতে এসেছে, তা টেলিভিশনের সংবাদ প্রতিবেদনে সবাই দেখেছেন। সব এলাকার কাঁচা রাস্তা তো গেছেই, পাকা রাস্তাও ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কাঁচা ঘরবাড়ি ও অন্যান্য অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত সেটা এখনই জানা যাচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে জরিপ করবেন। ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি, ফসল বিনষ্টের পরিমাণ, মাছের ঘের ও খামার, হাঁস-মুরগির খামার, গবাদিপশু-সবকিছুর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করবেন কর্মকর্তারা। তাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা ও ব্যয়-বরাদ্দ স্থির করা হবে। এতে অনেক সময় লেগে যাবে। সরকারি কর্মকর্তাদের জরিপ চলতে থাকুক। সরকারের উচিত হবে বন্যার পানি নেমে যাওয়া মাত্র প্রতিটি গ্রাম ও লোকালয়ের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।
বন্যার্ত মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রথম প্রয়োজন খাদ্য ও খাবার পানি। দ্বিতীয় প্রয়োজন মাথাগোঁজার ঠাঁই তথা বাসস্থান। ত্রাণকর্মীদের মাধ্যমে প্রতিটি দুর্গত পরিবারের কাছে খাদ্যসামগ্রী, খাবার পানি ও রান্নার উপকরণ পৌঁছাতে হবে যত শিগ্গির সম্ভব। এতে তারা প্রাণে বাঁচবেন। যাদের ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে বা পানিতে ভেসে গেছে, তাদের নতুন ঘর তৈরির জন্য অর্থ ও উপকরণ যেমন-টিন, বাঁশ, বেড়া ইত্যাদি দিতে হবে। যতদিন না ঘর তৈরি হচ্ছে, ততদিন অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য তাঁবু ও প্লাস্টিক শিট দিয়ে ছাউনি তৈরি করে দেওয়া যায়। যেসব ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো মেরামতের জন্য অর্থ ও বাঁশ, বেড়া ইত্যাদি উপকরণ দিলে দুর্গত মানুষ নিজেরাই নিজেদের ঘর মেরামত করতে পারবেন।
বন্যার্তদের পুনর্বাসনের জন্য এটাই প্রথম কাজ। এ কাজ দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে সরকারি তত্ত্বাবধানে। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব জনশক্তি ছাড়াও জেলা-উপজেলা প্রশাসনের জনবল এজন্য নিয়োগ করা যাবে। বেসরকারি খাতের ত্রাণ তৎপরতাকে সরকারি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত করলে অবশ্যই পুনর্বাসন কাজে গতি বাড়বে। শুরুতেই বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকতে হবে এবং সমন্বয়ের কাজ অবশ্যই জেলা-উপজেলা প্রশাসন করবে। তাহলে পুনর্বাসন কাজে শৃঙ্খলা থাকবে বলে আশা করা যায়।
বন্যার পানির ধাক্কায় উপদ্রুত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত কাঁচা ও পাকা রাস্তা যতটুকু সম্ভব মেরামত করতে হবে এখনই। রাস্তা চলাচলের উপযোগী না থাকলে মানুষ চলাচল করবেন কীভাবে? ত্রাণকর্মী ও তাদের যানবাহন কীভাবে চলবে? কাজেই বন্যার্ত মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী ও পুনর্বাসন উপকরণ পৌঁছানোর জন্য জরুরিভিত্তিতে বিধ্বস্ত রাস্তা মেরামত করা প্রয়োজন।
বাঁধ ভাঙল কেন
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে বলা হয়েছে, দুর্গত এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানির ধাক্কায় বিভিন্ন স্থানে ১৪ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে ভেসে গেছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে দ্রুত। এ ভাঙা বাঁধগুলো মেরামত করতে হবে জরুরিভিত্তিতে। না হলে আবার যদি বন্যা বা অতিবৃষ্টি হয়, তাহলে বন্যার্ত মানুষের দুর্দশা আরও বাড়বে।
এখানে পাউবোর কাছে প্রশ্ন, বাঁধগুলো ভাঙল কেন? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না জানি, তবে এটুকু বলা যায়, দীর্ঘকাল আগে নির্মিত বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামত কাজ ঠিকমতো হয়নি। এটি যে পাউবোর গাফিলতি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখন তারা জরুরিভিত্তিতে ভাঙা বাঁধ টেকসই করে মেরামত করলে জনগণ উপকৃত হবেন।
সুসমন্বিত ত্রাণ-পুনর্বাসন চাই
বন্যার্তদের জন্য সর্বত্র সুষ্ঠুভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও সার্বিক পুনর্বাসনের জন্য যা বলা হলো, সেসব করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন তৎপরতার জন্য অর্থ কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন স্তরের মানুষ সরকারি তহবিলে ও বেসরকারি সংগঠনকে চাঁদা ও অর্থ সাহায্য দিচ্ছেন। সরকারের নিজস্ব তহবিল তো রয়েছেই। অর্থের সমস্যা নেই, এখন প্রয়োজন প্রাপ্ত অর্থের যথাযথ ব্যবহার। অতএব, সরকারি-বেসরকারি খাতের সব ধরনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমকে সুসমন্বিত করতে হবে সরকারি উদ্যোগে। তাহলেই ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে বন্যার্ত মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারবেন।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com