জনআকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অন্ধ দলীয় আনুগত্যের বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে মানতেই হবে, গত ৫৩ বছরে দেশের রাজনীতিকরা মানুষকে শুধু হতাশই করেননি, একটি অপেক্ষাকৃত সরল সমাজকে নানাভাবে কুটিল ও ক্লেদাক্তও করে তুলেছেন। এ ধরনের অভিযোগ বিভিন্ন পক্ষের রাজনৈতিক শাসনামলে যখনই উত্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে, তখনই অনেক বিজ্ঞজন পরামর্শের ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছেন, প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ উত্থাপন করা হলে, তা একদিকে যেমন তৃতীয় শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দেবে, অন্যদিকে তেমনি তা দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে ফেলবে; তার চেয়ে বরং সংশ্লিষ্ট সবার উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে চিন্তা ও আচরণে ধীরে ধীরে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। আর সেখানে যুক্তি হিসাবে এটাও বলা হয়, ১৯৭১-এর আগে আর কখনোই এদেশের রাজনীতিকদের রাষ্ট্রপরিচালনার সুযোগ হয়নি। ফলে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবিহীন এ রাজনীতিকরা তাদের শাসনামলে কিছুটা অতিরিক্ত সময় পেতেই পারেন, যে সময়ের মধ্যে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের ক্রমান্বয়ে দক্ষ ও পরিপক্ব করে তুলতে সক্ষম হবেন। কিন্তু অত্যন্ত কষ্ট, হতাশা ও পরিতাপের বিষয়, গত পাঁচ দশকের অধিক সময়ের ব্যবধানেও সে দক্ষতা ও পরিপক্বতার ছিটেফোঁটা তারা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে ধার নিয়ে বলতেই হয়, ‘২৫ বছর অপেক্ষায় আছি... নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো?’ এবং অপেক্ষা করতে করতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, ৫৩ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ‘পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমরের খেলা’ দেখা দূরের কথা, ওই ‘তিন প্রহরের বিল’টিকেই অদ্যাবধি আমরা আবাদযোগ্য করে তুলতে পারলাম না।
৫৩ বছর পর হলেও সে সুযোগটি অর্থাৎ রাজনীতিকে কায়েমি ধারার স্বার্থান্ধতার বাইরে নিয়ে গিয়ে জনগণের স্বার্থের অনুগামী করে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে একটি বিকল্প রাজনৈতিক পথরেখা নির্মাণের সুযোগ দেশে এ মুহূর্তে তৈরি হয়েছে। আর সুখের বিষয়, সে ধরনের একটি বিকল্প রাজনৈতিক পথরেখা নির্মাণের কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছু ধারণাগত ও আদর্শিক সহায়ক উপকরণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ইতোমধ্যে তৈরি করে দিয়েছেন। তারা স্পষ্টতই বলেছেন, ‘শুধু ব্যক্তিকে সরালেই সমস্যার সমাধান হবে না, বরং যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়, সেই কাঠামোরও বিলোপ করে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমাদের করতে হবে’ (নাহিদ ইসলাম, সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, প্রথম আলো, ৬ আগস্ট ২০২৪)।
আর এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, দীর্ঘ দেড় দশকের একজন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাছে এ দেশের মানুষ দারুণভাবে ঋণী। তো এ ঋণের কথা যদি আমরা মন থেকে স্বীকার করি, তাহলে এ কথাও স্বীকার করা প্রয়োজন, তারা যে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপের কথা বলছেন, সে বিষয়েও আমাদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। আর সে উদ্যোগের অংশ হিসাবে দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যকার সচেতন নাগরিকদের উচিত হবে শুধু লেখালেখি ও বক্তব্য-বিবৃতির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে এখনই দেশে একটি বিকল্প ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি প্রবর্তনের পথ অনুসন্ধান করা। আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে বিষয়টি দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্যহীনতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নাগরিকদের একত্র হয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, যেটি গত ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশে বিরাজমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় ওই সংগঠনের আওতায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের লক্ষ্য নিয়ে এমনভাবে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে হবে, যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন অর্জন করা সম্ভব হয়। এবং সেটি যে খুবই সম্ভব, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় আম আদমি পার্টি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ (আম আদমি পার্টির আদর্শকে সমর্থন করার কথা বলা হচ্ছে না)। আর সেক্ষেত্রে সহযোগী শক্তি ও অংশীদার হিসাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের মধ্যকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে সঙ্গে পাওয়ার জন্যও প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ধারণা করা যায়, আদর্শিক জায়গা থেকে তাদের অনেকেই এ উদ্যোগে যুক্ত হতে আগ্রহী হবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ রাজনৈতিক উদ্যোগে জনসমর্থন পাওয়া যাবে কিনা বা তা পাওয়া গেলেও কতটা পাওয়া যাবে? এ বিষয়ে কষ্টমিশ্রিত ক্ষোভ থেকে বলি, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ, দক্ষতা, সামর্থ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে সাধারণ মানুষ রীতিমতো অতিষ্ঠ। এ দলগুলোর ভেতরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো চর্চা নেই। বড় দলগুলো তো বলতে গেলে পুরোপুরিই পারিবারিক একনায়কত্বাধীনে পরিচালিত, যেখানে দলগুলোর আত্মমর্যাদাবোধ না থাকা ব্যক্তিত্বহীন সদস্যরা তোষামোদিতায় মত্ত স্তাবক মাত্র (সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া)। বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোও নানাভাবে বিভক্ত ও অসংগঠিত। কিন্তু তারপরও সত্য, দেশের রাজনীতি তাদের ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। এর কারণ, জনগণের সামনে অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প নেই। আর যেহেতু তাদের সামনে অন্য কোনো বিকল্প নেই, সেহেতু জনগণ কর্তৃক ঘুরেফিরে তাদেরই কাউকে না কাউকে সমর্থন করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সমাজের অগ্রসর চিন্তার সচেতন মানুষ যদি সংগঠিত হয়ে প্রগতিশীল ধারার একটি গণমুখী বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠন করে বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য নিয়ে জনসমক্ষে হাজির হতে পারেন, তাহলে সেক্ষেত্রে জনসমর্থন না পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু কথা হচ্ছে, গত ৫ দশকেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে পেশিশক্তি ও কালোটাকা ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করার যে রেওয়াজ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেখান থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করা যাবে কীভাবে? এ ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, আদর্শবিবর্জিত রাজনীতিকরা এদেশে পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে চায় বলেই তাদের পোষার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। পেশিশক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন না হলে অর্থেরও প্রয়োজন হতো না। অতএব নতুন ধারার রাজনৈতিক সংগঠন যদি জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়, পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল রাজনীতি কোনোদিন জনগণের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, তাহলে জনগণ নিজ থেকেই তাদের (পেশিশক্তিধারীদের) প্রত্যাখ্যান করবে এবং নির্বাচনে অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। উপরন্তু জনগণকে এটাও বোঝাতে হবে, দেশ ও জনগণের কল্যাণ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মেধা ও দূরদৃষ্টি, আর তাই রাজনীতি ও নির্বাচনে মেধাবী মানুষকে সমর্থন করতে হবে-পেশিশক্তিধারী কালোটাকার মালিকদের নয়। আর এ ধারণা জনগণের চিন্তায় স্পষ্টভাবে প্রোথিত করতে হবে যে, সরকারের কাজ কোনো অবস্থাতেই জনগণকে নিয়ন্ত্রণ বা শাসন করা নয়, হয়রানি করা তো নয়ই।
নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে নির্বাচনি আচরণবিধিতেও উল্লেখযোগ্য পরিমার্জন, সংশোধন ও সংযোজন আনতে হবে। তবে তল্পিবাহক বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমনটি করতে উদ্যোগী হবে-তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ অবস্থায় বিদ্যমান নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও অন্য সদস্যদের জাতির স্বার্থে পদত্যাগ করতে হবে। আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন তা করতে সম্মত হবে বলেই আশা করা যায়। অবশ্য ন্যূনতম আত্মমর্যাদাবোধ থাকলে কমিশন সদস্যদের নিজেদেরই উচিত ছিল ইতোমধ্যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা। সে যাই হোক, প্রস্তাবিত নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজে হবে দেশে এমন একটি স্থায়ী নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা সরকার বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালটাতে হবে না। নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সব দল যাতে একই সমতলসম্পন্ন মাঠে (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) সমান রাষ্ট্রীয় আচরণের সুযোগ নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে পারে, সেটি অবশ্যই ওই নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য যদি তাদের কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয়, সেটিও করা যেতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এদেশে গত ৫৩ বছরেও একটি জবাবদিহিতাপূর্ণ দায়িত্বশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত না হওয়ার শূন্যতাকে পূরণ করার লক্ষ্যে অবিলম্বে দেশের সচেতন নাগরিকদের একটি নতুন উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নামতে হবে। আর সে উদ্যোগের অংশ হিসাবে গঠিতব্য নতুন রাজনৈতিক দলটি জীবন-জীবিকার সাধারণ জনআকাঙ্ক্ষাকেই শুধু পূরণ করবে না, বাংলাদেশকে বিশ্বমানচিত্রে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ ও নানা গৌরবময় কীর্তির অধিকারী নতুন জাতি-পরিচয়ে উদ্ভাসিত করে তুলবে। আশা করা যায়, এ সমাজের সব শ্রেণি, পেশা, অঞ্চল ও গোষ্ঠীর মানুষ অকুণ্ঠচিত্তে এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মেধাবী ও বিচক্ষণ শিক্ষার্থীদের সাহসী তৎপরতার মধ্য দিয়ে দেশ আজ যে নতুন সময়ে প্রবেশ করল, সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যদি সহসাই একটি তৃতীয় ধারার নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা যায়, তাহলে সেটিই হবে এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)