ছবি: সংগৃহীত
একটানা ৩৭ দিন বন্ধ থাকার পর মেট্রোরেল আবার চালু হয়েছে রোববার সকাল থেকে। ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল এখন চলছে নতুন নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী। এ রুটে স্টেশন রয়েছে ১৬টি। কিন্তু মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে আপাতত মেট্রোরেল থামবে না এবং এ দুটিতে যাত্রীসেবা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে পুলিশ বক্সে আগুন লাগানো হয়। ওইদিনই বিকাল ৫টায় কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেলের চলাচল বন্ধ করে দেয়। এর পরদিন মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর করা হয়। হামলার কারণে স্টেশন দুটির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ সে সময় বলেছিল, বিধ্বস্ত স্টেশন দুটি সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করতে এক বছর সময় লাগবে। এজন্য খরচ হবে পাঁচশ কোটি টাকা। এখন অবশ্য বলা হচ্ছে, খরচ অতটা হবে না, কিন্তু সংস্কার কাজের জন্য সময় এক বছরই লাগবে।
যা হোক, বিধ্বস্ত স্টেশন দুটি বাদে বাকি ১৪ স্টেশনে যাত্রীসেবা দিয়ে মেট্রোরেল এখন চলছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেট্রোরেল উত্তরা-মতিঝিল রুটে চলাচল করছে। এ রুটে যাত্রীর সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় তিন লাখ। এ বিপুলসংখ্যক মানুষ ৩৭ দিন প্রতীক্ষায় ছিলেন-কবে মেট্রোরেল আবার চালু হবে। এখন তাদের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে, সবাই স্বস্তিতে আছেন।
১৮ জুলাই মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৭ আগস্ট থেকে মেট্রোরেল আবার চলাচল করবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জানায়, প্রয়োজনীয় কিছু কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি থাকায় ১৭ আগস্ট মেট্রোরেল চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার দোহাই দিলেও মেট্রোরেল চালু না হওয়ার আসল কারণ ছিল ভিন্ন। কোম্পানির নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীদের কর্মবিরতিই ছিল আসল কারণ। কর্মচারীরা কোম্পানির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার কথা উল্লেখ করে অভিযোগ করেন, তাদের অনেক বেশি হারে বেতন দেওয়া হচ্ছে। ফলে নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বৈষম্য দূর করে যুক্তিসংগত হারে বেতন-ভাতা নির্ধারণের দাবিতে কর্মবিরতি শুরু হয়। ফলে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ থাকে। পরে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে কর্মচারীরা কাজে যোগ দেন এবং মেট্রোরেল চালু হয়।
মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর এর চলাচল শুরু হয় দুই পর্বে। প্রথম পর্বে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় পর্বে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয় ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর। এভাবেই উত্তরা-মতিঝিল রুটের ২১ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল চলেছে ১৮ জুলাই পর্যন্ত। তারপরেই এ আধুনিক গণপরিবহণের যাত্রা বিঘ্নিত হয় রাজনৈতিক কারণে।
মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ যখন চলছিল, সে সময় অনেকের মধ্যেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল-নতুন এ গণপরিবহণ যাত্রীদের জন্য স্বস্তিকর হবে তো? যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত ভাড়াও একটু বেশি মনে হয়েছে অনেকের কাছে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর দেখা গেল এটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। উত্তরা থেকে মতিঝিলের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে মাত্র ৩১ মিনিট সময় লাগে। এটি সবার কাছেই অকল্পনীয় ছিল। বাস কিংবা অন্য পরিবহণে উত্তরা থেকে মতিঝিল অথবা মতিঝিল থেকে উত্তরা যেতে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা। সময়ের সাশ্রয়ের কারণে বেশি ভাড়া তখন যাত্রীদের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। মেট্রোরেল এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, বেশির ভাগ যাত্রীই বসার আসন পান না, দাঁড়িয়ে যেতে হয়।
উত্তরা-মতিঝিল এবং মতিঝিল-উত্তরা রুটে একবারের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। এছাড়া নিম্নতম ভাড়া ২০ টাকা। এ ভাড়া যাত্রীরা মেনে নিয়েছেন সময়-সাশ্রয় এবং সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যাত্রার স্বাচ্ছন্দ বিবেচনা করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মেট্রোরেলের ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এতে ভাড়া বেড়ে যেত। কিন্তু বিভিন্ন মহলের প্রবল আপত্তির কারণে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত এখনো স্থগিত আছে। ভ্যাট আরোপ না করাই ভালো। যাত্রীরা একটু স্বস্তিতে থাকলে সরকারের বিরাট কোনো ক্ষতি হবে না।
সবকিছুই ঠিকমতো চলছিল। তিন লাখ যাত্রী যানজটের শহর ঢাকায় স্বচ্ছন্দে চলাচল করছিলেন। কিন্তু ১৮ জুলাই সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। একটানা ৩৭ দিন মেট্রোরেল বন্ধ থাকল। এজন্য দায়ী কে বা কারা? দুটি স্টেশন ভাঙচুর করে বিধ্বস্ত করল কারা? আন্দোলনরত ছাত্ররা এ ঘটনা ঘটাননি। তারা এ হামলার দায়িত্ব অস্বীকার করছেন শুরু থেকেই। তাহলে যেসব দুষ্কৃতকারী এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না কেন? স্থানীয় লোকজন দেখেছেন স্টেশনে হামলা চালিয়েছিল কারা। সিসিটিভি ও সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ছবি ও ফুটেজ আছে। এর সাহায্যে এবং স্থানীয় এলাকাবাসীর সাক্ষ্য নিয়ে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করা কঠিন কিছু নয়। আশা করি, তা করা হবে এবং দায়ী ব্যক্তিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে।
মেট্রোরেল কোনো ব্যক্তি বা দলের সম্পত্তি নয়। এটি রাষ্ট্র তথা জনগণের সম্পদ। জনগণের সম্পদ যারা ধ্বংস করেছে, তারা কোনোভাবেই ক্ষমা পেতে পারে না। ছাত্রদের আন্দোলনের সময় আরও কিছু রাষ্ট্রীয় সম্পদ, যেমন বিটিভি ভবন এবং আরও অনেক সরকারি ভবন ও স্থাপনা বিধ্বস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এসব ঘটনার দায়িত্ব আন্দোলনরত ছাত্ররা নেয়নি। তাহলে কারা এসব করল? অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব ধ্বংসযজ্ঞের তদন্ত করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থেই এটি করা জরুরি।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com