মিঠে কড়া সংলাপ
সবাইকে সবসময় বোকা বানানো যায় না
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষ ভারতে গিয়ে সেখানকার বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিং গ্রহণের মাধ্যমে পাক আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। আর এ বিষয়ে আমার বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলাই আজকের লেখাটির মূল লক্ষ্য। প্রথমেই আমি মুক্তিযুদ্ধকালে আমার ভারতে অবস্থানকালীন কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে চাই।
১৯৭১ সালের মে মাসে সীমান্ত অতিক্রম করে এক সন্ধ্যায় আমরা ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছাই। অতঃপর রাত ১০টা নাগাদ আমাদের পাবনা জেলার আরও অনেকে সেখানে উপস্থিত হন, যাদের মধ্যে গোপাল নামক একজন হিন্দু যুবক ছিলেন। এ অবস্থায় গোপালকে দেখে ক্যাম্প ইনচার্জসহ তার সঙ্গী দু-একজন কানাঘুষা শুরু করে দেন। কারণ গোপাল পাবনা জেলা হোসিয়ারি শ্রমিক সংগঠনের একজন সদস্য ছিলেন। আর এ সংগঠনটির নেতৃত্বপ্রদানকারী প্রায় সবাই ভাসানী-ন্যাপের নেতাকর্মী ছিলেন। গোপাল ছিলেন এসব নেতার একজন সক্রিয় কর্মী। হোসিয়ারি শ্রমিক সংগঠনটির কোনো সভা-সমাবেশের প্রাক্কালে একটি রিকশার হুডের সঙ্গে মাইক লাগিয়ে গোপাল সেই সভার প্রচারণা চালাতেন। সে অবস্থায় গোপালকে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে দেখে ক্যাম্প ইনচার্জ এবং আরও দুজন তাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন এবং একপর্যায়ে তাকে পার্শ্ববর্তী শুকনো খালের মধ্যে নিয়ে গিয়ে জবাই করে হত্যা করেন। কিছুটা দূর থেকে সে দৃশ্য দেখতে পেয়ে আমার গা শিউরে উঠল। রাতে কিছু খেতে পারলাম না এবং সারা রাত ঘুমও হলো না। শেষ রাতে গায়ে জ্বর এলো এবং সেই সঙ্গে চোখওঠা (ভাইরাস) রোগে আক্রান্ত হলাম। সে সময়ে ক্যাম্পের আরও কয়েকজন চোখওঠা রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রোগটিকে স্থানীয়ভাবে ‘জয়বাংলা রোগ’ নাম দেওয়া হয়েছিল; কারণ রোগটি বেশ বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে অবস্থায় পরদিন জ্বর কিছুটা কমে এলেও ভাইরাসআক্রান্ত আমার চোখ দুটি আরও বেশি করে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠায় অবশেষে ক্যাম্প ইনচার্জকে বলে চোখের চিকিৎসার জন্য আমি কলকাতা চলে যাই। সেদিন আমরা দুজন কেচুয়াডাঙ্গা থেকে একটা লরিতে প্রথমে কৃষ্ণনগর পৌঁছে, পরে কলকাতাগামী একটা ট্রেনে চেপে বসি। আর কলকাতা যাওয়ার পথে ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য ভারতীয় মুদ্রা না থাকায় বিনা টিকিটেই যাত্রা শুরু করি। তাছাড়া শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে আসা বাংলাদেশিদের টিকিট ছাড়াই ভ্রমণ করতে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিধি বাম! চেকার এসে টিকিট চাওয়ায় টিকিট নেই বলায় তিনি খিস্তিখেউড় শুরু করে দিলেন। গায়ের কাপড়-চোপড় এবং কথা শুনে বুঝে ফেলে বললেন, ‘ও, জয় বাংলা থেকে এসেছ, এখানে কী করতে এসেছ?’ মুক্তিযুদ্ধ করতে এসেছি বলায় তিনি গলা আরও এক ডিগ্রি চড়িয়ে বললেন, ‘তো এখানে এসেছ কেন, যাও দেশে যাও, সেখানে থেকে যুদ্ধ করো। ইন্ডিয়া এসেছ, ইন্ডিয়ার সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ করলে পরে বুঝবে ইন্ডিয়া কী চিজ, যাও দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ করো।’ উল্লেখ্য, তার বক্তব্যের আরও কিছু অংশ অশালীন ছিল বিধায় এখানে তা বাদ দেওয়া হলো।
অতঃপর টিকিট চেকার চলে গেলে ভোরবেলা আমরা শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে সোজা প্রিন্সেভ স্ট্রিটের বাংলাদেশ মিশন অফিসে গিয়ে দেখি একজন পিওন বা চৌকিদার গোছের লোক ছাড়া অত সকালে সেখানে কেউ নেই। অন্তত ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে বলে অগত্যা সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি কটি টাকা ভাঙিয়ে ইন্ডিয়ান রুপি করে নাস্তা সেরে আট আনার আঙুর কিনে পাশের ছোট্ট একটি পার্কে গিয়ে বসলাম। সেখানে বসে আঙুর খাওয়া অবস্থায় প্রায় ত্রিশ বছর বয়সি একটি যুবক আমাদের দিকে এগিয়ে এলে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় বিনিময়ে জানতে পারলাম তিনি সিপিআইএমের একজন কর্মী বা স্থানীয় নেতা গোছের কেউ। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমরা মুক্তিযুদ্ধে এসেছি শুনে তিনিও সেই টিটি সাহেবের মতো একই সুরে বললেন, নিজ ভূমিতে থেকেই আমাদের মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহত রাখা উচিত। আর কারণ হিসাবে তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহায্য করার পেছনে একটি বিরাট উদ্দেশ্য আছে; এটি ভারতের একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। তিনি আরও অনেক কথাই বললেন, যা শুনে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না।
এ ঘটনার পর সেদিন আরও একটু এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে আবারও বাংলাদেশ হাইকমিশনে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পাবনার এম মনসুর আলী, যিনি আমাদের সবার প্রিয় মনসুর চাচা, তার সাক্ষাৎ পেলে চোখের চিকিৎসার জন্য তার কাছে কিছু টাকা চাওয়ায় তিনি আমার চোখের অবস্থা দেখে কিছু টাকা দিলে আমি চোখের ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি আমাকে একটি মলম ও আইড্রপ দেন। অতঃপর সেসব ওষুধ ব্যবহারে আস্তে আস্তে আমার চোখও ভালো হয়ে যায়। কলকাতা পৌঁছানোর পরদিনই আমরা আবার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ফিরে আসি এবং এবারে শিকারপুরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে একদিন থেকে পরদিনই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। তারপর এক রাত সীমান্তের একজন কৃষকের বাড়িতে অবস্থান করে পাবনা চলে আসি।
পাবনা এসে দেখতে পাই সেখানকার অবস্থা খুব খারাপ; ইতোমধ্যে পাক আর্মি অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে; অনেককে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে; আমাদের পাশের বাড়ির এক গৃহবধূকে ধর্ষণও করা হয়েছে। এসব দেখেশুনে মনের আগুন আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল! সে অবস্থায় পরদিন সকালে পাক আর্মি হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করল এবং আমাদের বাড়ির পাশে কালীবাড়ি নামক স্থানে হেলিকপ্টারের গুলিতে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হলেন। তাছাড়া হেলিকপ্টারের গুলিতে আমাদের বাড়ির আশপাশের কারও কারও ঘরের টিনের চালা ভেদ করতে থাকায় আমরা সপরিবারে চরঘোষপুরে আমাদের এক পরিচিত ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং সেদিন শেষ রাতেই পাক আর্মিকে ধ্বংস করার দৃঢ় মনোবল ধারণ করে আবারও শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে যোগদান করি। শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মূলত গেরিলা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দেওয়া হতো, যাতে করে ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাক আর্মিদের নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে। শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পের কমান্ডে ছিলেন ঈশ্বরদীর প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা জসীমউদ্দিন মণ্ডল। সেখানে ট্রেনিং গ্রহণকালীন একদিন আমাদের পাবনার মকবুল হোসেন সন্টু শিকারপুর ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে আমাকে একটু ফাঁকা জায়গায় ডেকে নিয়ে বললেন, কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সে অবস্থায় তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে এখানে চলে এসেছেন। তিনি একথাও বললেন, তার শিকারপুর অবস্থানের কথা কেউ যেন জানতে না পারে। উল্লেখ্য, মকবুল হোসেন সন্টু বয়সে আমার চেয়ে প্রায় সাত-আট বছরের বড় এবং তিনি ছাত্র ইউনিয়নের একজন বড় নেতা, তথা ন্যাপ-ভাসানীর একজন কর্মী ছিলেন। সে অবস্থায় আমি নিজে তাকে তিন দিন আমাদের ক্যাম্পে প্রায় গোপন অবস্থায় রাখার পর তিনি উচ্চতর ট্রেনিং গ্রহণের জন্য অন্যত্র চলে যান। অতঃপর আমি স্বল্পকালীন গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ শেষে পাঁচজনের একটা দল নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে সীমান্ত এলাকায় একজন শেল্টার মাস্টারের বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করি।
আমাদের শেল্টার মাস্টার ছিলেন সামান্য একজন কৃষক, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আমাদের সাধ্যমতো খাবার খাওয়াতেন, আদর যত্ন করতেন। তাছাড়া সীমান্ত এলাকায় আমরা একবার একজন লোহা পেটানো কামারের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করলে তিনি আমাদের দুধ, রুটি, মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়াতেন এবং বলতেন, ‘আপনারা দেশের মুক্তি আনতি যাচ্ছেন, আপনাদের খাওয়ানো-দাওয়ানো যত্ন-আত্তি করতে পারা তো গর্বের বিষয়।’
সীমান্ত এলাকায় থাকা অবস্থায় আমরা একবার পাক আর্মির সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলাম এবং একজন কৃষক আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন। পাশের রাস্তায় পাক আর্মির আগমন আমরা টের না পাওয়ায় কৃষক লোকটি হাতের নিড়ানির মাধ্যমে ইশারা দিয়ে আমাদের পাক আর্মির অবস্থান বুঝিয়ে দেওয়ায় তাড়াতাড়ি আমরা একটি আখ খেতের ভেতর ঢুকে পাশের খালের মধ্যে অবস্থান নিয়ে ফায়ারিং শুরু করে দিয়েছিলাম এবং প্রায় আধা ঘণ্টা গোলাগুলির পর পাক আর্মি সে স্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। পরে আমরা সেখানে গিয়ে মাটিতে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছিলাম এবং সেদিন হয়তো তাদের কেউ আহত হয়েছিল বলে আমরা ধারণা করেছিলাম। অতঃপর একদিন আমরা পোড়াদহ এবং ঈশ্বরদীর মাঝামাঝি স্থানে গোলবাথান নামক রেলস্টেশনের পাশে রেললাইনের একটি ফিশপ্লেট উড়িয়ে দিয়েছিলাম এবং সে ঘটনাতেও সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল। কারণ এক ব্যক্তি আগ থেকেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, কুষ্টিয়া থেকে ওই পথে পাক আর্মি ট্রেনে মুভ করবে। আবার ভেড়ামারা পাওয়ার স্টেশনের অদূরে একটি বৈদ্যুতিক টাওয়ার ধ্বংস করে দেওয়ার ঘটনাতেও বিদ্যুৎ বিভাগের এক ব্যক্তি তথ্য দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এ টাওয়ারটি ধ্বংস করতে পারলে গোটা কুষ্টিয়া অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে এবং পাক আর্মি ভয় পেয়ে যাবে!
আজকের লেখায় মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত কিছু বাস্তব ঘটনা তুলে ধরার উদ্দেশ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে সর্বজনীন একটি যুদ্ধ ছিল, সেই কথাটি প্রমাণ করা; অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং আশা করি, কেউ ভুল বুঝবেন না। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একটি গণযুদ্ধ হলেও একটি দল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষিগত করার জন্য স্বাধীনতার পর থেকেই বগল বাজানো শুরু করে অদ্যাবধি তা বহাল রেখেছে। সেখানে অন্য কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিরও যে অবদান আছে, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে একটিবারের জন্যও তারা তা স্বীকার করেননি বা স্বীকার করতে চাননি। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধকেও তারা দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন।
আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর অবদান আছে। আমি নিজেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধের জন্য ভারতে চলে গিয়েছিলাম। কাজেই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের লোক ছাড়া অন্য কোনো দল বা ব্যক্তির মুক্তিযুদ্ধে অবদান নেই, এমন কথা বা এমন মানসিকতা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং তা হয়ওনি। যুগ যুগ ধরে আমি, আমরা, আমাদের দল যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছি, এমন প্রচার-প্রচারণা যে সফল হয়নি, সে কথাটিও সময়ই প্রমাণ করে দিয়েছে। অন্যথায় স্বাধীনতা যুদ্ধকে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধেও যেভাবে আমিত্বের অহংকার ঢুকে পড়েছিল, সেসব ঘটনা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। কারণ অবস্থা এমন স্থানে পৌঁছে গিয়েছিল যে, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, যিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, সেই বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের খেতাব এবং সনদ বাতিলের জন্য পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। আর এসব কাজের নাটের গুরু ছিলেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যিনি কিনা মন্ত্রিপরিষদের অনুষ্ঠিত সভাগুলোয় প্রধানমন্ত্রীর ঠিক পাশের চেয়ারটিতেই উপবেশন করতেন! এতে প্রমাণিত হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের লোক ছিলেন। ফলে ২০১৬, ১৭, ১৮ সালে নতুন করে অনলাইনে এবং হার্ড কপিতে দরখাস্ত গ্রহণ করে অনায়াসেই তিনি হাজার হাজার নতুন মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করেছিলেন, যাদের অনেকেই অত্যন্ত কম বয়সি! পক্ষান্তরে যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি বা তার নিজের লোকেরা পছন্দ করতেন না, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত গ্রহণ করে এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধার সনদ তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন স্কুলশিক্ষক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে তাকে বিপদগ্রস্ত তথা অসম্মানিত করায় বিষয়টি নিয়ে তিনি আমাকে একটা কিছু লেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। অতঃপর মামলা করে উচ্চ আদালত বা আপিল, দরখাস্ত ইত্যাদির মাধ্যমে অনেক ভোগান্তির পর তিনি তার হৃতমর্যাদা আবারও উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। আমার কাছে এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সনদও বাতিল করে দিয়েছিলেন, যাদের অনেককে অনেক ভোগান্তির পর সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ শেষে তিনি নিজেই আবার তাদের মুক্তিযোদ্ধা মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেসব মুক্তিযোদ্ধার অশেষ ভোগান্তিও হয়েছিল। তাছাড়া এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে উচ্চ আদালতে মামলা করেও আদালতের রায়ের মাধ্যমে তাদের হৃতমর্যাদা আবারও উদ্ধার করতে হয়েছিল। আর এসব মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করে আবারও তা ফিরিয়ে দিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের যেভাবে নাজেহাল করেছে, তজ্জন্যও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রীর বিচার ও শাস্তি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তাছাড়া নতুন করে ফরম পূরণ করিয়ে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাকেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে গেছেন বিধায় এ বিষয়েও তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রীর এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলা বা লেখার উদ্দেশ্য হলো, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রীও বিগত সরকারের ভরাডুবিতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। সারা দেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকায় ডেকে এনে যাচাই-বাছাইয়ের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি এবং সম্মানহানি করায় সারা দেশেই তার অপকর্মের বিরুদ্ধে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে এবং এসব কারণেও শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়েছে। কারণ সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী যাকে অপছন্দ করতেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হলেও তার সনদ বাতিল এবং নতুন করে দরখাস্ত পেলে মুক্তিযোদ্ধা না হলেও সেই অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে গেছেন। আর নতুন করে বানানো এসব কম বয়সি অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা যাতে ভবিষ্যতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান, তজ্জন্যই তিনি এসব করে গিয়েছেন। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রীর এসব অপকর্মের ঘটনাও ছাত্র আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
লেখাটি আর দীর্ঘায়িত না করে বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিসংক্রান্ত যে জিকির, যে স্লোগান দিনরাত তারা জারি রেখেছিলেন, সেসব বিষয়ে কিছু বলেই শেষ করতে চাই। বিগত সরকারের একটা স্লোগান বা বুলি ছিল ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’! বলা বাহুল্য, তাদের এ জিকিরও দেশের জনগণ গ্রহণ করেননি। কারণ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো শক্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কোনো শিশু, বালক, যুবক, বৃদ্ধ এমন কাউকেই এদেশে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি বা যারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী কোনো পাগলকেও এদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ সাবেক সরকারপ্রধান এবং তার আশপাশের লোকজন দিনরাত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির জিকির তুলে দেশবাসীকে বোকা বানানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু দেশের মানুষ যে বোকা নন, সে কথাটিও তারা প্রমাণ করে দিয়েছেন। কারণ সরকারের অপছন্দের কোনো ব্যক্তি বা বিরোধীদলীয় যে কাউকেই তারা স্বাধীনতাবিরোধী তকমা লাগিয়ে দিতেন!
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই ভিন্নমতের কাউকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধা প্রদান, ভিন্নমতের রাজনীতিক ধারার লোকজনকে কথায় কথায় রাজাকার বলা, জিয়াউর রহমানের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও খেতাব বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি অনেক ঘটনাই স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং স্বাধীনতার পর থেকেই এজন্য দল ও সরকারকে খেসারত দিতে হয়েছে। আর দেশের মানুষ বারবার আওয়ামী লীগ সরকারকে চরমভাবে তা বুঝিয়েও দিয়েছে। একটি ইংরেজি প্রবচন আছে, ‘You can make fool some people for sometime, but you can't make fool all people for all time’. আশা করি, প্রবচনটির অর্থ সবারই জানা আছে, সেই সঙ্গে এ-ও আশা করি, অতঃপর দেশের সব রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা এবং সময়ে সময়ে যারা সরকার গঠন করেন, তাদের সবাই কথাটি যথাযথভাবে মেনে চলবেন।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা