Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষা সমাজ দেশ

অপরাধের সুষ্ঠু বিচার কে না চায়!

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অপরাধের সুষ্ঠু বিচার কে না চায়!

ছোটবেলায় সম্ভবত প্রথম শেণিতে শিক্ষক আমাদের পড়িয়েছিলেন, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’। উপর ক্লাসে উঠে আরও শিখেছিলাম, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করো না’। যত বয়স হচ্ছে, শেখা কথাগুলোর সঙ্গে এদেশের বাস্তবতা ও সমাজের মানুষের কথার সঙ্গে মিল দেখছি না; বিশেষ করে রাজনীতিকদের কথা ও কাজের সঙ্গে তো বটেই। মাঝেমধ্যে সংশয় জাগে, বইয়ে পড়া কথাগুলো কি আমাদের ভুল শেখানো হয়েছিল, যা বাস্তবে ব্যবহার করতে গেলে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়?

পতিত সরকারের সময়ে এ কলামে সত্য লিখতে গিয়ে একচোখা অনেকেই আমাকে ‘বিরুদ্ধ দলের চামচা’ বলতেও দ্বিধা করেননি। ধন্যবাদ দিই পত্রিকা অফিসকে, আমার সত্য কথাগুলো বাদ না দিয়ে ছাপানোয়। পাঠকসমাজ আমাকে দলকানা হতে কোনোদিন দেখেনি। এখন তো নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অতীতের লেখা, কথা কিছুটা চর্বিত চর্বণ করি; সেই সঙ্গে এদেশের নিখাদ বাস্তবতার কিছু বর্ণনাও দিই, সাধারণ নাগরিক হিসাবে কথা বলার অধিকার আমাদের তো আছেই।

ভবিষ্যতে কোন দল এসে ক্ষমতায় বসে, আমার জানা নেই। তাদের সব কাজের সঙ্গে একমত হব না; আমি নিশ্চিত। ফলে ফুটবলের মতো দুই বিপরীত গোলপোস্টের দিকে আমাকে সবাই ঠেলে দেয়। আবার তো সেই অতীত অভিধা কপালে জুটবে। এদেশের রাজনীতির পরিবেশ, কেন জানি না, বইয়ে পড়া নীতিকথার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলে। রাজনীতিতে নীতিকথা, দেশপ্রেম, সমাজসেবা, জনসেবা, সুশিক্ষা, মানবতাবোধ, লোকলজ্জা ইত্যাদির কোনো চিহ্ন নেই। এদেশের রাজনীতি মানে জলজ্যান্ত মিথ্যার বেসাতি; যেমন: একটা উদাহরণ ‘গায়েবি মামলা’। এ জীবনে যে ভাঁওতাবাজির আরও কত কিছু দেখতে হবে! এমনই শত শত আজব কাণ্ড এদেশের ‘চির মহান’ রাজনীতিকদের বদৌলতে হজম করতে হচ্ছে। কেউ কম, কেউ বেশি, কেউবা অত্যধিক বেশি। সামাজিক এ অবক্ষয়, দুর্নমিত যথেচ্ছাচার ও দুর্দমনীয় অনাচার-শুধু নির্বাচন সুষ্ঠু করে এ অধঃপতন থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে না। জনগোষ্ঠীকে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মতলববাজ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। সে কারণেই গত লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কার’।

কয়েক বছর ধরে ও এখনো যে অভিযোগগুলো করে চলেছি, সেগুলো হলো-ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট, দিনে দুপুরে ডাকাতি, বেপরোয়া মিথ্যাচার, গৃহপালিত চাটুকার সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে ভিন্নমতাবলম্বী সম্মানিত মানুষের বিরুদ্ধে মনগড়া দুর্নাম রটিয়ে জনসমক্ষে নাজেহাল করা (যেমন জনাব ফরহাদ মজহারের ঘটনা), ব্যাংকের অর্থ লোপাট, প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, গায়েবি মামলা (নতুন আবিষ্কার), নিজের বাহিনী দিয়ে মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করে অন্তর্দ্বন্দ্বের গোলাগুলিতে মারা গেছে বলে উলটো খুনের মামলা দায়ের করে মিছিলকারীদের ঘরছাড়া ও কেস-বাণিজ্য করা, যাকে-তাকে ভুয়া মামলায় আটক, দেশব্যাপী অফিস-সেক্টর-বিভাগে খোলা দুর্নীতি, প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতি, কাঁড়ি কাঁড়ি অবৈধ টাকা বিদেশে পাচারে সহযোগিতা, জনগোষ্ঠীর সুপরিকল্পিত বিভাজন, শিক্ষার মানহীনতা, রাজনৈতিক কারণে মানুষ হত্যা-গুম, দেশব্যাপী নৈরাজ্য ও অরাজকতা; নেতা-নেত্রীদের হাজার হাজার কোটি টাকার ঘুস-বাণিজ্য, সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করা। কটার কথা বলব। এ যেন এক আরব্য রজনির কেচ্ছা। বলে শেষ করা যায় না। আমার শুধু খোলা মাঠের মধ্যে গিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছা করে : ‘কত রঙের পিরিতি তুমি জানো রে বন্ধু, কত রঙের...’। ‘বন্ধু’ বলছি এ কারণে যে, স্বাধীনতার আগে আমি এদের বন্ধু ছিলাম, মিছিলে যেতাম, তাদের আশাজাগানিয়া কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম ও বিশ্বাস করতাম। স্বাধীনতার পরপরই সব আশা ভেস্তে গেল; অন্য কোনো দলে যোগ দিতে পারিনি। হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছি। ভাগ্যিস এদেশের ছাত্র-জনতা ‘এই মগের মুল্লুক’কে আমার জীবদ্দশায় আবার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বাংলাদেশ নামের সার্বভৌম দেশে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে এবং আমি আবার আশাবাদী হয়ে উঠেছি।

এদেশের সাধারণ মানুষ দলমতনির্বিশেষে এসব দেশবিধ্বংসী অপকর্মের সুষ্ঠু বিচার চায়। অপরাধীদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। প্রত্যেক অন্যায়কারী, খুনি, অপরাধীকে দ্রুত গ্রেফতার দেখাতে হবে। যথাযথ আদালতে দ্রুত তাদের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার হতে হবে। এসব দেখার জন্য এদেশের কোটি কোটি ছাত্র-জনতা, ভুক্তভোগী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরও অনেক কাজ আছে। সেগুলোও করার পর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। সে কাজ বেশ কষ্টকর, সময়সাপেক্ষ এবং এখনো অনেক দেরি। আমি এ আন্দোলনকে ছাত্র-জনতার ‘গণবিপ্লব’ বলে অভিহিত করি। আইনের কোনো ধারা-উপধারা খোঁজার আগ্রহ আমার কম। গণভোটের আয়োজন করে সংবিধান পরিবর্তন সময়ের দাবি।

এতক্ষণ প্রথম করণীয়র কথা বললাম। এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আমি একজন সাধারণ মাস্টারসাহেব এবং একজন পেশাদার ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্টও বটে। সেই সঙ্গে এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক। এদেশের জনসাধারণের টাকায় লেখাপড়া করেছি। জনসাধারণের পক্ষে নিজের মনের কথা প্রকাশের অধিকার আমার আছে। সে অধিকার নিয়েই আরও কিছু কথা বলতে হবে।

একটা সৃষ্টিদর্শন তত্ত্ব বলি। মানুষ যত্ন করে উদ্ভিদজগৎ টিকিয়ে রেখেছে নিজ স্বার্থে-অক্সিজেন, ফল ও কাঠ পাওয়ার জন্য। অক্সিজেন ও ফল না পেলে জীব বাঁচবে কীভাবে! উদ্ভিদজগৎও নিজে টিকে থাকার জন্য মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টিকে টিকিয়ে রেখেছে প্রতিদানে ক্ষুধা মেটানোর সুধা দিয়ে। একে বলে পারস্পরিক টিকে থাকা। উইন-উইন সহাবস্থান, গূঢ়তত্ত্ব। এটা সৃষ্টির পজিটিভ দিক। এ তত্ত্ব ব্যবহারের নেগেটিভ দিকও আছে। পতিত সরকার এ তত্ত্বের নেগেটিভ দিকের আবিষ্কারক। সরকারের প্রতিটি বিভাগ, প্রতিটি পেশার কিছু চিহ্নিত দলবাজ লোক, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, কোনো নির্দিষ্ট জেলাবাসী, পুলিশ বিভাগসহ অগণিত বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় সংস্থা, করপোরেশন, দপ্তর-পরিদপ্তরে কর্মরত অসংখ্য ‘মানব-আপদ’, গ্রামগঞ্জের সুবিধাবাদী জনগোষ্ঠীর একটা অংশ এই একটা ডকট্রিনের ওপর ভিত্তি করে গত পনেরো বছর চলেছে-‘যত পারিস দেশ লুটেপুটে খা, শুধু আমার টিকিয়ে রাখার কাজে মত্ত হ, আমার নামে জয়-কীর্তন গা, বেগতিক দেখলে পালিয়ে যা-কোনো বাধা নেই, আজীবন তোদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাব, তুইও টিকে থাক, আমাকেও টিকিয়ে রাখ।’ একই তত্ত্বের ভিত্তিতে বেনজীর, ছাগলকাণ্ডের মতিউর রহমান, এমপি আনারের মতো শত শত গং এদেশে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহক হয়ে বিশাল অবৈধ ধন-সম্পদের মালিক হয়েছে। পতিত সরকারের নিজের গোষ্ঠীর লোকজনও চৌদ্দপুরুষ চলার মতো কামিয়েছে। পতিত সরকারকেও এরা এতদিন টিকিয়ে রেখেছিল। ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ উপহার দিয়েছিল কমপক্ষে পনেরো লাখ কোটি টাকা বিদেশি ঋণের বিনিময়ে। পতিত সরকারপ্রধানের নিজের মুখে শুনেছি তার পিওনের চারশ কোটি টাকার মালিক হওয়ার গল্প।

প্রথমেই বিচার বিভাগকে পুনর্গঠন করতে হবে। বিচারক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলপুষ্ট বিচার বিভাগের কর্মকর্তা, দলবাজ-দুর্নীতিবাজ আইনজীবী যেন বিচার বিভাগের বিচারক হিসাবে কোনোভাবে ঢুকতে না পারে। এদেশের পতিত সরকার বিচার বিভাগকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি ও সরকারকে বিষয়গুলো দেখার অনুরোধ করছি। পুলিশ বিভাগের শুধু পুনর্গঠন নয়, খোলনলচে বদলের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাহী বিভাগসহ সব বিভাগ এই পনেরো বছর ধরে শুধু দলীয় বিবেচনায় ও আনুগত্য দেখে সাজানো হয়েছে। এর মূলোৎপাটন করতে হবে। খুন, ক্রসফায়ার, গুমের সঙ্গে জড়িত ও হুকুমদাতাসহ প্রত্যেককে প্রথমেই আটক করতে হবে। অতঃপর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর খুন ও গুমের কোনো তালিকা তৈরি হয়নি। এবার কিন্তু খুন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তালিকা তৈরি করতেই হবে। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হবে। জাতিসংঘের তদন্ত টিম আসবে শুনলাম। শুধু শেখ হাসিনার বিচার করলে হবে না, তাকে ঘিরে থাকা অপরাধগোষ্ঠীরও বিচার এদেশের বিশেষ আদালতে করতে হবে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়া অনুচরদের পাচারকৃত টাকাসহ ফেরত আনতে হবে।

পতিত সরকার স্বাধীনতার পর থেকেই কয়েকটা কার্ড পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করে আসছে। সবই আমার নিজ চোখে দেখা। এখনো প্রত্যেক সংকটময় মুহূর্তে তারা এ কার্ডগুলো ব্যবহার করে। এবারও কয়েকটি কার্ড ব্যবহার করেও সফল হয়নি। তারা চতুর বানরের মতো নিজে দই খেয়ে ধাড়ি-ছাগলের মুখে হাত মুছে দেয়, যাতে যত দোষ ধাড়ি-ছাগলের ওপর বর্তায়। নিজেদের লোক দিয়ে গাড়ি পোড়াবে, বিল্ডিংয়ে আগুন দেবে, পূজার মূর্তি ভাঙবে, শহিদ মিনার ভাঙবে, হিন্দুদের সম্পদ ও জমি দখল করে ভারতে তাড়াবে; দোষ চাপাবে বিরোধী পক্ষের ঘাড়ে। দ্বিতীয়টা হচ্ছে সংখ্যালঘু নির্যাতন কার্ড। এতে তারা বারবার সফল হয়। আরেকটা হচ্ছে পাইকারি হারে ‘রাজাকার’ বলার প্রচলন এবং কথায় কথায় পাকিস্তানে চলে যাওয়ার নুসকা বাতলানো। সব গোলযোগেই পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার গন্ধ খোঁজা। শেষটা হলো ‘জঙ্গি দমন’ কার্ড। পতিত সরকারের লোকজন ছাড়া যেন সবাই জঙ্গি! কখনো কখনো জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করার কথাও শোনা গেছে। বিদেশিদের বুঝ দেওয়ার জন্য এ কার্ডটা বড়ই ধন্বন্তরি ওষুধ।

এবারের কাজ আগে অপরাধীদের ন্যায্য বিচার, তারপর নষ্ট-পচা ও বিষাক্ত সবকিছুকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া, আবার নতুন করে সুশিক্ষিত মানুষ, সমাজ ও দেশ গড়া। ‘ওগো সাথী এখনো পথ বহুদূর যেতে হবে, ধু-ধু মরুময় মাঠ, প্রখর সূর্য পেরিয়ে তারপর সবুজের ছায়া, বনাঞ্চল।’

ড. হাসনান আহমেদ এফসিএমএ : অধ্যাপক, ইউআইইউ; সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম