Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বপ্নের পথযাত্রায় অন্তর্বর্তী সরকার

Icon

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বপ্নের পথযাত্রায় অন্তর্বর্তী সরকার

গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। অফিসে, বিপণিবিতানে মানুষের পদচারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাস্তাঘাটে বাড়ছে যান চলাচল। গত কয়েক সপ্তাহের অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেয়ে এখন অনেকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে দেশের সাধারণ মানুষ। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম হ্রাস পাচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন ও নৈরাজ্য কমে গেছে। ক্রমে জননিরাপত্তার উন্নতি হচ্ছে। শান্তি ফিরে আসছে জনজীবনে।

মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান, শান্তি ও অর্থনৈতিক সুস্থিরতা এখন আমাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। দলমত, ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ভয় ও সামাজিক চাপমুক্ত একটি পরিবেশ গড়তে হবে। এখনো আমাদের পাড়া-মহল্লায় শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে পাহারা দিচ্ছে। পথের ময়লা পরিষ্কার করছে। রাজপথে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজার মনিটরিং করছে। এ অবস্থা হয়তো খুবই সাময়িক। অচিরেই অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন দায়িত্ব ছেড়ে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়ার টেবিলে ফিরে যাবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সামাজিক শৃঙ্খলা। ডাকাতি, নাশকতা, অতর্কিত আক্রমণের শঙ্কা থেকে মুক্তি পাবে সাধারণ মানুষ। যত তাড়াতাড়ি জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে, ততই সফল হবে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা।

অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে সূচিত হয়েছে স্বপ্নের এক নতুন অভিযাত্রা। ১৯৭১ সালের পর এত হত্যা, এত সম্পদহানি আর কখনো হয়নি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের বুক পেতে গুলি নেওয়ার দৃশ্য যেমন মানুষকে কাঁদিয়েছে, তেমনই তাদের উদ্দীপ্ত করেছে এবং প্রেরণা জুগিয়েছে সর্বাত্মক আন্দোলনে। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শাহাদতবরণ করে নিয়েছে শতশত ছাত্র-জনতা। মন্ত্রের সাধন করার জন্য তারা শরীরের পাতন ঘটিয়েছে। এটি এক বড় ধরনের অভ্যুত্থান। এবার সংঘটিত হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থান। অনেকে একে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা বলে আখ্যায়িত করছেন। গণ-অভ্যুত্থান অতীতে হয়েছে, এবারও হলো। তাতে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের নাম লেখা রবে অশ্রুতে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশে-বিদেশে তিনি একজন খ্যাতিমান মানুষ। তার খ্যাতির মতো কীর্তিও অনেক বেশি। বিগত সরকারের আমলে তিনি অনেক বিব্রত হয়েছেন, কষ্ট ভোগ করেছেন। এখন তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। তাকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়ে আসায় বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। তার উপদেষ্টা পরিষদে কয়েকজন মেধাবী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিও আছেন। সরকারের আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় তারা বেশ সহায়ক হবেন। নিঃসন্দেহে তারা সরকার পরিচালনায় অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। বিগত সরকারের আমলে সংসদে ও মন্ত্রিসভায় বহু সদস্য ছিলেন ব্যবসায়ী। তারা দায়িত্ব গ্রহণ করার পরও তাদের শ্রেণি চরিত্র বিসর্জন দিতে পারেননি। যে কারণে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। পরিণামে ভীষণ কষ্ট ভোগ করেছেন দেশের সাধারণ মানুষ। ফলে বিগত সরকারের প্রতি তাদের ক্ষোভ বেড়েছে। সেদিক থেকে বর্তমান উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে তাদের পক্ষে দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। দুবছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কাল অতিক্রম করে আসছে বাংলাদেশ। জুনে সমাপ্ত বছরের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় পৌনে ১০ শতাংশ। ইতোমধ্যে দেশের মুদ্রা ও রাজস্ব নীতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তাতে তেমন ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকগুলোর ওপর মানুষের আস্থা কমছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের কারণে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। ছোট আমানতকারীরা তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ছুটে বেড়াচ্ছেন এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে। সরকারের রাজস্ব আহরণের পরিমাণ কম। আর্থিক খাতের সংস্কার ও ভালো ব্যবস্থাপনা ছাড়া অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এ ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখার সুযোগ আছে।

আমাদের কলকারখানা ও কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি করা দরকার। দৈনন্দিন কাজে মানুষের আস্থা ও আগ্রহ ফিরিয়ে আনা দরকার। দুবছর ধরে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে তেমন সুখবর ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল কৃষি খাত। ক্রমাগত উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত ছিল। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হয়নি। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতনের কারণে অন্যান্য কৃষিপণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। ফলে বাজারে কিছুটা সরবরাহ সংকট এবং পণ্যমূল্য ভোক্তাদের ক্রয়সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে করপোরেট সংস্কৃতি ও বাজার সিন্ডিকেট মানুষকে অনেক ভোগান্তিতে ফেলেছে। সামনের দিনগুলোয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। এখন রোপা আমনের উৎপাদন মৌসুম চলছে। দেশে রাসায়নিক সার সংকট রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের সার কারখানাগুলোয় প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহের অভাবে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দ্রুত এসব সংকটের প্রতিকার দরকার। নতুবা বর্তমান আমন ও সামনের বোরো মৌসুমেও এর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে।

কৃষি ও শিল্প পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের আমদানি হ্রাস, রপ্তানি সম্প্রসারণ, রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পতন ঠেকানো এবং ক্রমাগতভাবে টাকার মানেয় অবচয় রোধ করা আমাদের আসন্ন অগ্রাধিকার। এর জন্য জনজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেশের জনগণের বাহিনী হিসাবে পাশে থাকা, বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করা এবং সরকারি কর্মচারীদের জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকার পরিবেশ তৈরি করার এখনই উপযুক্ত সময়। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সুশিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। নতুন সরকার দেশের জনগণের কল্যাণে ও কষ্ট লাঘবে পাশে থাকার ও জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করার দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রদর্শনে সক্ষম হলে আত্মসুখ অনুভব করবে দেশের সাধারণ মানুষ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এসেছে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক। সব ধরনের আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য পরিহার করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার জন্য যে সময় দরকার, তা এ সরকারের নেই। তবে তার শুভ সূচনা এখনই হতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষার্থীরা এক বড় পরিবর্তন সাধন করেছে। ভবিষ্যতে এর সুবিধাভোগী হবে তারাও। এ দেশ পরিচালিত হবে তাদেরই মাধ্যমে। এখন তাদের ফিরে যেতে হবে পড়ার টেবিলে। মেধা ও মননে তারা গড়ে উঠবে উত্তম নাগরিক হিসাবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা অতিদ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়েছিলাম। পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেছিলাম। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুথান শেষেও শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাদের শ্রেণিকক্ষে। তবে এত বড় পরিবর্তনের কারিগর যে শিক্ষার্থীরা, তারা সব সময়ই সরকারের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে উৎসুক ও সংশ্লিষ্ট থাকলে জনপ্রত্যাশা পূরণে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটাই আশা করা যায়। আশা করি দেশের জনগণ এবারের অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের অবদান যথার্থভাবে মূল্যায়ন করবে, প্রতিটি হত্যার বিচার হবে, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সুব্যবস্থা হবে। নিহত ও আহতদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটা জনপ্রত্যাশা।

আমরা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অনেক প্রতিশ্রুতি দিই। সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। প্রকৃতপক্ষে তার অনেকখানিই বাস্তবায়ন করতে পারি না। গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক কথা আমরা অহরহই শুনি, কিন্তু তার বাস্তব প্রতিফলন প্রায়ই দেখতে পাই না। গণতন্ত্রের লেবাস পরে এ দেশে অনেক সরকার এসেছে। কিন্তু কালক্রমে তা রূপ নিয়েছে স্বৈরতন্ত্রে। ক্ষমতার মোহ কোনো কোনো মানুষকে এতই আকর্ষণ করে যে, তা অনেকেই ছাড়তে চায় না। ছলে-বলে কৌশলে তা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। তার পরিণতি হয় দুঃখজনক। ক্রমেই সরকার জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তার সাজানো ক্ষমতার বলয় তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়। সম্প্রতি শেখ হাসিনার সরকারের পতন থেকে আমরা এ শিক্ষাই গ্রহণ করি।

আমাদের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত, তার চেয়েও সংক্ষিপ্ত আমাদের কর্মকাল। এ সময়ের মাঝে যত বেশি সম্ভব জনকল্যাণে কাজ করা উচিত। তাদের সুখ-শান্তির জন্য কাজ করে তাদের মাঝে নন্দিত হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।

বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মানুষকে রক্ষা করাই হবে তার সরকারের প্রধান কাজ। জনগণের পাশে থেকে তাদের সুখ-শান্তির জন্য কাজ করা এবং তাদের রক্ষা করার মতো বড় প্রতিশ্রুতি আর কিছুই হতে পারে না। তার সঙ্গে রয়েছে দেশের ১৮ কোটি মানুষ। আছে কোটি ছাত্র ও যুবক। এদের তিনি সংগঠিত করবেন। নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এক স্বপ্নের পথযাত্রায়। তাতে নাগরিক জীবনে উন্নতির ছোঁয়া লাগবে। সমৃদ্ধ হবে দেশ। নতুন সরকারের কাছে এই আমাদের প্রত্যাশা।

ড. জাহাঙ্গীর আলম : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম