গত সপ্তাহে এদেশের রাজনীতিতে যা ঘটে গেল, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অনেকবারই ক্ষমতার রদবদল হয়েছে, কিন্তু গত সপ্তাহে যা ঘটে গেল, তার তুলনা মেলা ভার। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৫ আগস্ট। এই ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ রক্তক্ষয় হয়েছে, তা ৫ দশকের যে কোনো সময়কে অতিক্রম করেছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর যেসব লুটপাট, রাহাজানি, ডাকাতি ও নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটেছে, তার তুলনাও অতীতকে হার মানিয়েছে। এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সামনে রেখেই গত ৮ আগস্ট রাত ৯টায় সম্পন্ন হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ। এ সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সঙ্গে রয়েছেন ১৬ জন উপদেষ্টা। কেমন করবে এ সরকার? মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটা সফল হবে অন্তর্বর্তী সরকার? এ প্রশ্নের যে কোনো উত্তর দেওয়াই হবে ‘খুব তাড়াতাড়ি’; প্রকৃত জবাবের জন্য সময় দিতে হবে। তবে সরকারকে যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে, তার কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। এর মধ্যে কিছু তাৎক্ষণিক এবং কিছু সময়সাপেক্ষ।
সবচেয়ে আগে ফিরিয়ে আনতে হবে সামাজিক শৃঙ্খলা। একথা মানতেই হবে, অন্তত ইতিহাস থেকে যে, যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদলের পরিবর্তে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন হয়, তাহলে শাসনতন্ত্রে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। এ শূন্যতা থেকে ফায়দা নেওয়ার জন্য নিয়োজিত থাকে একদল মানুষ। এই মানুষগুলোর কোনো নৈতিক দর্শন নেই, তারা ধারণ করে না কোনো মানবিক গুণাবলি। হাসিনা সরকার-পরবর্তী সময়টাতে আমরা সেই ধরনের মানুষ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। গোটা সমাজে ভয়াবহ রকমের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ মুহূর্তে সেই শূন্যতার অবসান হয়েছে নতুন সরকার আসায়। কাজেই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে এ মুহূর্তেই। দেশকে আইনশৃঙ্খলার আওতায় নিয়ে আসার কাজটি প্রথম এবং প্রধান। দ্বিতীয় কাজটি হলো বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এদেশের সাধারণ মানুষ গত কয়েক বছর ধরে ক্রমবর্ধমান বাজারমূল্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। প্রথাগত চাহিদা-সরবরাহের নীতিকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে বাজার সিন্ডিকেট। তারা সরবরাহ চেইনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সাধারণ মানুষের জীবনকে সহ্যসীমার বাইরে নিয়ে গেছে। পণ্যের বাজারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাহুমুক্ত করতে হবে; সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও দিতে হবে স্বস্তি।
এসব তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি রয়েছে আরও অনেক সমস্যা, যা সমাধান করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ। গত দেড় দশকে এমন কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নেই, যা দলীয় রাজনীতির অভিলাষমুক্ত। ফলে সব রকম সরকারি ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে; এমনকি নেই বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম হলো বিচার বিভাগ। বলা হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু আমরা মনে করি শাসকগোষ্ঠীর অনুমোদনসাপেক্ষে স্বাধীন। বিভিন্ন বিচারকার্য পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখেছি, শাসকরা যেভাবে চেয়েছে, বিচারকাজ অনেকটা সেভাবেই চলেছে। এখানে বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে। কাজটি খুব সহজ নয়, তবে তা অপরিহার্য। এর পরেই আসে প্রশাসন। দেশে প্রশাসন বলতে চলেছে বলা যায় দলীয় শাসন। আমলাদের পেশাগত চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আমলাদের পরিচয় ছিল সরকারের অনুগত গোষ্ঠী হিসাবে। অর্থাৎ খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলে তার কথামতো প্রশাসন কাজ করত, আবার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে হাসিনা সরকারের অনুগত থাকত। কিন্তু গত ১৫ বছরে তা পালটে গেছে। এ সময়ে তারা মনে করতেন তারা নিজেরাই আওয়ামী লীগ। ফলে একজন যুবলীগ কর্মী শেখ হাসিনার প্রতি যতটা না অনুগত ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘লেঠেল’ ছিল আমলারা। এখানে অনেক বড় কাজ করতে হবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। প্রশাসনকে মানতে বাধ্য করতে হবে যে, তারা কোনো দলের কর্মচারী নয়, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং জনগণের সেবা প্রদানই তাদের আবশ্যিক কর্তব্য।
আর্থিক খাত গত ১৫ বছরে প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি। এ খাতকে ধ্বংস করার জন্য যত অপকর্ম করা প্রয়োজন, তার সবটাই সম্পাদন করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে অর্থ পাচার। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি একটি গবেষণা সংস্থা। সংস্থাটি বিশ্বের সব দেশের আর্থিক অবৈধ লেনদেন নিয়ে গবেষণা করে এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। পরিমাণটা কত তা একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। গত সরকার আইএমএফের সঙ্গে একটি ঋণচুক্তি সম্পাদন করে। সাত কিস্তিতে আইএমএফ এই ঋণ দেবে। এ চুক্তিতে আইএমএফকে রাজি করানোর জন্য জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে অনেক শর্ত মেনে নেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় দেখার বিষয় ঋণের পরিমাণ। সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে মাত্র ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার পাচার বন্ধ না করে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার শর্তসাপেক্ষ ঋণ নেওয়া হয়েছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের আশঙ্কাজনক পরিণতি সামাল দিতে অর্থ পাচার রোধ করার কোনো বিকল্প নেই। আমি নিশ্চিত যে, অর্থ পাচার রোধ ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পারলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক শক্তিশালী হবে।
দীর্ঘদিন ব্যাংক খাতে লুটপাট চলেছে। এ খাত আজ বিপর্যস্ত, ভঙ্গুর। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ নিয়ে ব্যাংক খাতকে দেউলিয়া বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি হিসাবমতেই আজ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে হিসাবের কারসাজি আছে। প্রকৃত হিসাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকার কম নয়। যে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কেউ ২০ হাজার টাকা খেলাপি হলে তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই দেশে ২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি হয়েও অনেকে পাঁচতারা হোটেলে মন্ত্রীদের সঙ্গে নৈশভোজ করে। এই চরম অন্যায় দূর করতে হবে। খেলাপি হওয়া অর্থ উদ্ধার করে ব্যাংকগুলোতে থাকা সাধারণ মানুষের আমানতের নিরাপত্তা দিতে হবে।
বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত এবং সরকারের পক্ষ থেকে উপেক্ষিত বিষয়ের নাম দুর্নীতি। হাটবাজারের ইজারা থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত দুর্নীতি একটি নিত্যদিনের চর্চায় পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে উচ্চপদের বেনজীর-মতিউর যেমন আছে, তেমনি আছে নিুপদের আবেদ আলীরাও। সাবেক সরকারপ্রধানই বলেছেন, তার পিওন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। মুখে ‘জিরো টলারেন্স’ বললে তা কোনো কার্যকর ফল বয়ে আনবে না; থাকতে হবে আন্তরিক অঙ্গীকার।
এ সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, যা অবশ্যকর্তব্যও বটে, সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। এদেশের মানুষের ভাতের কষ্ট আছে, বাসস্থানের কষ্ট আছে, চিকিৎসার কষ্ট আছে, কথা বলতে না পারার কষ্ট আছে। কিন্তু সব দুঃখ-কষ্টকে ছাড়িয়ে গেছে ভোটাধিকার হারানোর কষ্ট, যা অপমানের চূড়ান্ত পর্ব। সবাই জানেন, ১৯৯১ সালে মানুষ বিএনপিকে জয়ী করেছিল, তবে আওয়ামী লীগ মরে যায়নি। তারা আবার জনসমর্থন নিয়ে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেছিল। ওই নির্বাচন শেষে বিএনপি মুছে যায়নি, বরং জনগণের আস্থা ও সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল ২০০১ সালে। শেখ হাসিনা নির্ভয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সেই মর্যাদা নিয়েই ২০০৮ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এভাবে ক্ষমতার পালাবদল হলে, জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটলে কী সমস্যা ছিল? না, তিনি ক্ষমতার পালাবদলের চেয়ে পছন্দ করলেন ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে প্রহসনমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেন, সৃষ্টি করলেন ভোটব্যবস্থার ওপর জনগণের শতভাগ অনাস্থা। এই শতভাগ অনাস্থার জায়গাটিকে শতভাগ আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারার সফলতাই হবে এ সরকারের মূল ও প্রধান সাফল্য।
সমস্যার কথা বলা যত সহজ, সমাধান করা তত নয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সময়ের একটি ভূমিকা রয়েছে। সচেতন নাগরিকদের কেউ কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আমার কথা হলো, অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগমন ও অর্পিত দায়িত্ব একরকম নয়। ১৯৯১-২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কাজ ছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা, যাকে আমরা বলি ‘রুটিন ওয়ার্ক’। কিন্তু বর্তমান সরকার এসেছে শাসনব্যবস্থায় আমূল সংস্কারের দায়িত্ব নিয়ে, সব অনিয়ম দূর করার প্রত্যয় নিয়ে। কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় সময় সরকারকে দিতে হবে। আমাদের সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। জনগণের কল্যাণে, জনগণের স্বার্থে সংবিধানের যোজন-বিয়োজন-সংশোধন সম্ভব।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়