Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্রতিশোধ কাউকে পথ দেখায় না

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিশোধ কাউকে পথ দেখায় না

প্রায় তিন বছর আগে এক রাতে সিএনজি স্কুটারে বাসায় ফেরার পথে একজন মধ্যবয়সি চালক কী প্রসঙ্গে যেন মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন, ‘এই সরকার (হাসিনা সরকার) পল্টি খাইলে কী অইব, জানেন?’ তিনি অনেক কথাই বলেছিলেন সেদিন; দিয়েছিলেন প্রতিহিংসার এক ভয়াল বর্ণনা। তার পুরোটা বলতে গেলে নিবন্ধের শুরুটা বেশি দীর্ঘ হয়ে যাবে। আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ওই বর্ণনার পুরোটা এখানে তুলে ধরা দায়িত্বশীল কাজ হবে না। তবে আলোচনায় ঢোকার স্বার্থে শুধু এটুকু বলি-সেই স্কুটারচালক বলেছিলেন, ‘দেশে তখন কোনো পুলিশ থাকব না। পলানোর কোনো জায়গা পাইব না!’

দেশে কিন্তু অবিকল সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনে দলীয় গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়ার পর আবার পুলিশের (সঙ্গে বিজিবি) চূড়ান্ত অপব্যবহার করে যেভাবে রক্ত ঝরানো হয়েছে, তাতে পুলিশের ওপর জনতার ক্রোধ বেড়েছে আরও। বলতে হয়, মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তাতে কত জায়গায় কত ভয়াবহ প্রতিশোধের ঘটনা যে ঘটে গেছে, তা সবাই জানে। এখন তো আর তথ্য গোপনের সময় নয়। অনেক তথ্য গোপন করা হয়েছে এতদিন। তথ্য বিকৃত করেও প্রচার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জঘন্য মিথ্যাচার করে আবার বলা হয়েছে ‘গুজব’ প্রতিরোধের কথা। তাতে পালটা এ গুজবটাই লোকে বেশি করে বিশ্বাস করেছে যে, পুলিশের পোশাক পরে ছাত্রলীগ নেমেছে এভাবে গুলি করে আন্দোলন দমনে। এমন আশ্চর্যজনক গুজবও মানুষ বিশ্বাস করেছে যে, ভিনদেশি লোকজন পুলিশ ও বিজিবির পোশাক পরে নির্বিচারে গুলি করছে। আর র‌্যাব তো আগে থেকেই বিতর্কিত। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা এ বাহিনীর লোকদের আবার পুলিশের আইজি বানানোর একটা প্রক্রিয়া চলছিল! ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে র‌্যাবের হেলিকপ্টার উড়িয়ে তা থেকে করা হচ্ছিল গুলি। মনে হচ্ছিল, দেশে কোনো শত্রুবাহিনী ঢুকে পড়েছে! একপর্যায়ে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামিয়েও যখন পরিস্থিতি শান্ত করা যাচ্ছিল না, তখন নতুন করে আবার নামানো হয় ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র লোকদের। যথারীতি তাদের সহায়তায় থাকে পুলিশ। সেদিন সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল, যার সরাসরি দায় পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর। সেদিন কিছু পুলিশকেও ভয়াবহভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সিরাজগঞ্জে। আন্দোলন ঠেকাতে নেমে ক্ষমতাসীন দলের অনেকেও নিহত হয় সেদিন। তবে ছাত্র-জনতাই বেশি নিহত হয়েছিল নতুন করে। ‘রক্তের বন্যা’ বলতে যা বোঝায়, সেটাই যেন বইয়ে দেওয়া হয় দেশে। এর কোনো প্রয়োজন ছিল কি?

হাসিনা সরকারের বিদায়টা যদি এত রক্ত না ঝরিয়ে হতো আর পুলিশ এতে নিকৃষ্টভাবে ব্যবহৃত না হতো, তাহলে এ বাহিনীকে হয়তো এতটা খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতো না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণকারীরা দেরিতে হলেও পুলিশপ্রধানকে সরিয়েছেন। র‌্যাবপ্রধানকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে এ নিবন্ধ লেখার সময় খবর পেলাম। সেনাবাহিনীর ভেতরও শুরু হয়েছে জরুরি সংস্কার। পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো একটা খাতকেও নিয়মশৃঙ্খলায় রাখেনি হাসিনা সরকার। এ নিয়ে প্রকাশ্যে ঠিকমতো আলোচনাও করা যেত না। আলোচনা যাতে না হয়, সেজন্য সবকিছু করা হয়েছিল। মেয়াদের পর মেয়াদ তামাশার নির্বাচন করে এ প্রক্রিয়াকে করা হচ্ছিল আরও মজবুত। এর পরিণতিটা কার জন্য ভালো হলো? পুলিশ পথঘাট থেকে উধাও হয়ে গেছে। উধাও হয়েছে এদের সব অপকর্মে চোখ বুজে থেকে কথিত উন্নয়নের সাফাই গাওয়া ‘সহমত ভাই’রা। প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আন্দোলন দমনের নামে হত্যাযজ্ঞ চালানোর সময়টায়ও এদের একাংশ গিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে একতরফা বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। এসবের পরও শেষদিন নতুন করে রক্ত না ঝরিয়ে তিনবারের অগ্রহণযোগ্য ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী যদি পদত্যাগ করে জেলে যেতেন, তাহলেও মনে হয় না গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো।

প্রেক্ষাপট যা-ই হোক, অরাজকতাকে তো সমর্থন করা যায় না। এর যত ‘যৌক্তিকতা’ই থাকুক, থাকুক অন্যান্য দেশে যত পূর্ব-উদাহরণ-এটা অবশ্যই থামাতে হবে। পুলিশের পাশাপাশি সদ্য ক্ষমতা হারানো দলটির নেতাকর্মীদের একাংশও ভয়ানক প্রতিশোধের মুখে পড়েছে। ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’রা অনেক স্থানে বিপদগ্রস্ত কিংবা চাপের মুখে। অনেক নিরীহ লোকজনও আক্রান্ত হচ্ছে নিশ্চয়। পুলিশের নির্বিচার গুলিতেও যেমন ঘরের মধ্যে, এমনকি ছাদে নিহত হয়েছে অবোধ শিশুরা। এদের করুণ মৃত্যুর ঘটনাগুলো আলাদা করে তুলে ধরায় ইউনিসেফের ওপরও চটেছিল হাসিনা সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়। এর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, যত গুলি আছে তা পাঁচ বছর ব্যবহার করলেও ফুরাবে না! অবৈধভাবে প্রাপ্ত ক্ষমতায় দিশেহারা হয়ে করা এসব মন্তব্য সাধারণ মানুষকেও বিস্মিত করেছিল। তাদের একাংশ আন্দোলনের শেষদিকে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেমে এসেছিল রাজপথে। ভয়াবহ এ পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে তারা ‘সেনাবাহিনীর সরকার চাই’ বলেও তুলেছিল দাবি।

এ প্রেক্ষাপট মনে রেখেই এখনকার অরাজকতা নিয়ে আলাপটা করতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই, এর বিরোধিতা করতে হবে আমাদের। এটা বন্ধের আওয়াজ তুলতে হবে যতটা প্রবলভাবে সম্ভব। কেননা প্রতিশোধ কাউকে পথ দেখায় না। হাসিনা সরকারের প্রায় অবিশ্বাস্য পতন এর সাক্ষাৎ প্রমাণ। তারাও কমপক্ষে এক যুগ বিভাজন ও প্রতিশোধ গ্রহণের রাজনীতিটাই করে গেছেন। আর সেটাকে জায়েজ করতে চেয়েছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে। ভয়ানক ক্ষতিকর এ বয়ানের বিরোধিতাকারীদের দমনেও তারা ব্যবহার করে গেছেন বেচারা পুলিশকে। একটা সময়ে এসে পুলিশ আর ছাত্রলীগে কোনো তফাত খুঁজে পায়নি মানুষ।

পুলিশের কিছু দায়িত্ব পালনে অবশেষে নিয়োগ দিতে হয়েছে আনসারকে। পথে পথে ট্রাফিক পুলিশও উধাও। এ অবস্থায় আন্দোলনকারী ছাত্রদের মধ্যে যারা হতাহত না হয়ে এখনো ঠিকঠাক আছে, তাদের দেখা যাচ্ছে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে। গণভবন থেকে ‘লুণ্ঠিত’ মালপত্র অনেকে ফেরত দিয়ে যাচ্ছে ছাত্রদেরই আহ্বানে। লুটে নেওয়া অর্থকড়ি উদ্ধার করে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনীকে। অরাজকতার শিকার সংসদ ভবন চত্বর সাফ করে রাতে মোমবাতির আলোয় তারা স্থাপন করেছে বয়স্কদের পাপ মুছে দিতে চাওয়া শহিদদের ছবি। আরও কত নাম না জানা শহিদ যে রয়েছে! তাদের সবার লাশ আর নামধাম নিশ্চয় খুঁজে বের করতে হবে। আর গণহত্যার দায় নিয়ে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসককেও ছাড় দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাকে তোলা যায় কি না, সে প্রয়াস জারি রাখতে হবে। এমন স্বৈরশাসকের উত্থান যাতে আর কখনো না ঘটতে পারে, সেজন্য সংস্কারও শুরু করতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরপরই। ওয়ান-ইলেভেনের পরও এমন একটি সুযোগ এলেও তা কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি। তখন অনেকেই বলেছিলেন, এর ফল ভয়াবহ হবে। সেটাই হয়েছে। তবে এবার যেহেতু একটা অসাধারণ আন্দোলনে দেশের ঘৃণ্যতম শাসকের পতন ঘটেছে, তাই পরিস্থিতিটা ভিন্ন। আন্দোলনকারীদের চাপ জারি রাখতে হবে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য। জনপ্রত্যাশার চাপ আরও বাড়াতে হবে। আমরা নিশ্চয়ই চাইব না বারবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল স্বাধীনতা লাভকারী এ জাতির। তারা নিশ্চয় কিছু ভালো অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে চায়।

নিবন্ধটি ছাপা হতে হতে সম্ভবত নতুন সরকার গঠিত হয়ে যাবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর প্রধান হবেন, এটা জেনে গেছি আমরা। দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তার রয়েছে অসাধারণ প্রভাব। এটা কাজে লাগাতে হবে। এ সরকারে অন্তর্ভুক্ত অন্য উপদেষ্টাদেরও দাঁতে দাঁত কামড়ে কাজ করতে হবে হতভাগ্য এ জাতির পক্ষে। দুঃশাসনের সঙ্গে যারা অপরাধে জড়িত ছিল, তাদের অবশ্য অধিকার রয়েছে ন্যায়বিচার পাওয়ার। অন্যায়ভাবে আক্রান্ত না হওয়ার অধিকার তো বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। সে কারণে শুরুতেই এ সরকারকে যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে অরাজকতা। আন্দোলনে যারা গ্রেফতার হয়েছিল, তাদের সবাইকে মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে স্বভাবতই। সরকারের পতন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে যারা অরাজকতায় মেতেছে, তাদের ক্ষেত্রে কী করা হবে, সেটা অবশ্য জানি না। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো, এসব ঘটনা রোধে সেনাসদস্যদের সময়মতো এগিয়ে না আসা। তবে শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ সবকিছু এত দ্রুততার সঙ্গে ঘটেছে যে, একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বয়েরও ছিল অভাব। আর রাষ্ট্রপতিসহ সবকিছু তো হাসিনা সরকারেরই সাজিয়ে যাওয়া। অবনতিশীল পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের নিয়েই হয়তো বেশি চিন্তিত ছিলেন।

যা হোক, আশা করা যায় পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যেহেতু পুলিশের, তাই তাদের পুনর্গঠন করে দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে কাজে। সেনাবাহিনী কোন ক্ষেত্রে কতটা দায়িত্ব পালন করবে, সেটাও নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। দেশরক্ষায় এ বাহিনীতেও পেশাদারি ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে জনগণ এর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে পারে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সেনাবাহিনীই কিন্তু এগিয়ে এসেছে গণভবনের পথে ধাবমান বিপুল ছাত্র-জনতাকে সুখবরটি দিতে। তাদের সমর্থন ও সুরক্ষা দিয়ে যেতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। পুলিশকেও নজিরবিহীন জনসেবা দিয়ে ভয়াবহভাবে হারানো তাদের ভাবমূর্তি যথাসম্ভব উজ্জ্বল করতে হবে। আরও অনেক বিভাগের নিশ্চয় অনেক কিছু করার রয়েছে। সেগুলোও পর্যায়ক্রমে আনতে হবে আলোচনায়।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম