Logo
Logo
×

বাতায়ন

দেশপ্রেমের চশমা

হাতুড়ে চিকিৎসায় কি জটিল রোগ সারে?

Icon

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাতুড়ে চিকিৎসায় কি জটিল রোগ সারে?

ফাইল ছবি

কোটা আন্দোলনের নামে যে ব্যাপক গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে দেশ চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বলা যায়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, আন্দোলন দমনে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছে। সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী, বিজিবি এবং সবশেষে সেনাবাহিনী পর্যন্ত নামাতে হয়েছে। আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়েছে। এতেও গণবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সরকারকে শেষ অস্ত্র হিসাবে করফিউ জারি করতে হয়েছে। এ থেকে সরকারের ওপর ছাত্রছাত্রী, যুবক ও জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের পরিমাণ আঁচ করা যায়।

সরকার যদি মনে করে, দমন-পীড়ন, গায়েবি মামলা ও জেল-জুলুমের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে, তাহলে সে সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক বা ভুল হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ ক্ষোভ যে শক্তি প্রয়োগ করে দমন করা যায় না, সে বিষয়টি বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বের অনেক দেশেই প্রমাণিত হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো একটি সাধারণ বিষয়কে আদালতের মাধ্যমে সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ভালো হয়নি। একটি নির্বাহী বিষয় কেন এবং কী প্রক্রিয়ায় বিচারিক বিষয়ে পরিণত হলো এবং এ ব্যাপারে কেনই বা গড়িমসি করা হলো, তার নির্মোহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। অনেকে বলেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ, সাবেক পুলিশ ও র‌্যাবপ্রধান বেনজীরসহ আরও যেসব প্রশাসনিক কর্মকর্তার মেগা দুর্নীতি উন্মোচিত হয়ে সরকারের ভাবমূর্তিকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছিল, এমন সময় সেদিক থেকে গণদৃষ্টি অন্যত্র ফেরাতে সরকার প্রথমদিকে কোটা আন্দোলন সমাধানে ত্বরিত মনোযোগ দেয়নি। তা না হলে মাননীয় সরকারপ্রধান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনের সূচনাকালে আলাপ-আলোচনা করে স্বল্প সময়ে সহজে এ বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে পারতেন। এর আগে আদালতের একটি খণ্ডিত ও বিতর্কিত রায়ের ওপর ভর করে এ সরকার যেভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিল, কোটা আন্দোলনে সেই একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা বিবেচনাপ্রসূত হয়েছে কিনা তা নিয়ে ভাবার আছে।

পরবর্তীকালে কারফিউয়ের মধ্যে আদালত বসিয়ে কোটা বিষয়ে আপিল বিভাগে শুনানি করে রায় দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারির পরও বিষয়টির চূড়ান্ত ফয়সালা হয়েছে ধরে নেওয়া যায় না। কারণ, ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ২৫ তারিখে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হতাহতদের তালিকা তৈরি করা, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টিসহ আটটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের শুনানি ও রায়ের পর সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করলে কোটা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হয়েছে বলে আন্দোলনকারীরা মনে করছেন না।

কোটা সংস্কার বিষয়ে আমি আগেও ২০১৮ ও ২০২৪ সালে কথা বলেছি ও লিখেছি। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ অন্যরকম। নিজের ব্যাখ্যায় আমি বলে থাকি : জনাব ‘ক’ যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধ করেন, তবে তার শাস্তি জনাব ‘ক’ পাবেন। তার সন্তান পাবেন না। একইভাবে জনাব ‘খ’ যদি কোনো প্রশংসনীয় কাজ করে থাকেন, তবে তার প্রশংসা বা পুরস্কার জনাব ‘খ’ পাবেন। তার সন্তানরা পাবেন না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা বিরাট গর্বের কাজ। জীবনবাজি রেখে এ কাজে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদেরকে নির্দ্বিধায় সর্বোচ্চ সম্মান ও পুরস্কার দেওয়া কাম্য। তবে এ সম্মান যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা অন্য কারও প্রাপ্য নয়। ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিরা তো আর যুদ্ধ করেননি। তারা কোন যুক্তিতে সে সম্মান দাবি করবেন? তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হওয়াও কি একেবারেই অস্বাভাবিক? কাজেই বাছবিচার না করে কেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতিপুতি হলেই তাদের সবাইকে চাকরিক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে সম্মানিত করা হবে, তা অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। এমন কাজ তো সরকারের সুযোগ্য ও পেশাদার প্রশাসন গড়ে তোলার অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সরকার যদি মনে করে, কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের জন্য তরুণ-যুবকরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাহলে ঠিক হবে না। একমাত্র কোটা সংস্কারের জন্যই সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আক্রমণ চালানো হয়েছে বললেও যথার্থ হবে কি? রাজনীতি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এ আন্দোলন ও সহিংসতাকে বিবেচনা করেন দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, সুশাসনের অনুপস্থিতি, নিত্যপণ্যের অস্বভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটবাজি রোধে সরকারি ব্যর্থতা, ব্যাপক দুর্নীতি বৃদ্ধি, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা, প্রশাসনিক সেবাদানের মান নিুগামী হওয়া ও নির্বাচনি ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার কারণে জনমনে ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের এক মহাবিস্ফোরণ হিসাবে। আলাপ-আলোচনা ও সংলাপ ছাড়া এমন গণবিক্ষোভ শক্তি প্রয়োগ করে দমন করার প্রচেষ্টাকে হাতুড়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন বলা অসংগত হবে কি?

বাংলাদশ স্বাধীন হয়েছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ ক্ষোভ যে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে দমন করা যায় না, সে বিষয়টি পাকিস্তানি শাসক ও সেনা সদস্যরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু এ দেশের মানুষ উন্নয়নের দাবি আদায়ের জন্য করেননি। তারা তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য ওই যুদ্ধ করেছিলেন। সে কারণেই এদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উন্নয়নের কথা লেখা নেই। লেখা আছে সাম্য, মানবিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা। গণতন্ত্র না থাকলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতন্ত্র চর্চার ঘাটতি রয়েছে। গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা নির্বাচন আজ প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা নেই। এ কারণে তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না। একতরফাভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নির্বাচনি বিজয় অর্জন করতে কষ্ট হয় না। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও এমপিরা ক্ষমতায় থেকে, সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করার খেসারত আজও জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। ছাত্র-যুবকরা এসব যে বোঝেন না, এমন নয়। ভোটার হওয়ার পর কোটি কোটি তরুণ ও যুবক ভোট দিতে পারেননি। এ বিষয়টি তাদের মনে ক্ষোভ তৈরি করেছে। সরকার এসব বিষয়ে সংস্কার করে গণক্ষোভ প্রশমনের কথা বলছে না।

এসব কারণে একটি ঐতিহ্যবাহী দল হওয়া সত্ত্বেও সরকারি দল এখন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। যেসব দলকে ‘হাঁটুভাঙা’, ‘মাজাভাঙা’ দল বলে বিদ্রুপ করা হয়েছে, ওই দলগুলোকে এখন সরকারি দলের চেয়ে শক্তিশালী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের যে একক আধিপত্য ও দখলদারত্ব বজায় ছিল, তা কতটা বজায় আছে বা থাকবে সে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। কারণ, সাংগঠনিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে লাঠি আর হেলমেট দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন সাধারণ ছাত্রসমাজের মধ্যে যে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিয়মিতভাবে ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়ায় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির কোনো গঠনমূলক উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞ ও চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকারি দল, পুলিশ ও প্রশাসনকে একটি বড় রকমের ধাক্কা দিলেও কারও কারও উপকারও করেছে। যেমন-ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে সাবেক পুলিশ ও র‌্যাবপ্রধান বেনজীর এবং সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ, ছাগলকাণ্ডখ্যাত মতিউরসহ আরও অনেক দুর্নীতির রাঘববোয়াল এ আন্দোলনে উপকৃত হয়েছেন। তাদের অপকর্ম ও দুর্নীতি নিয়ে এখন আর আলোচনা হচ্ছে না। কোটা আন্দোলনের ব্যাপকতায় সেসব কুকর্ম চাপা পড়ে গেছে। হয়তো তারা এবং অন্য যাদের দুর্নীতি পর্যায়ক্রমে উন্মোচিত করতে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই কার্যক্রম শ্লথ করে কোটা আন্দোলন দমনে মনোযোগী হয়েছে। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ কারণে দুর্নীতির রাঘববোয়ালরা আন্তরিকভাবে চাইছে, কোটা আন্দোলন চলমান থাকুক।

একদিকে দেশের তরুণ সমাজের তীব্র চাপ এবং অন্যদিকে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপকে সরকার কি আমলে নেবে? নেবে কোনো সর্বদলীয় সংলাপের উদ্যোগ? এটিই এখন দেখার বিষয়। যদি সরকার এমন উদ্যোগ নেয়, তাহলে উত্তেজনা প্রশমিত করে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চলমান রাখার চেষ্টা করা যেতে পারে। আর তা না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার নীতি অবলম্বন ভালো ফল দেবে না। কারণ এ বিষয় দেশে দেশে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, মানুষ জেগে উঠলে তাদেরকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আনতে হয়। শক্তি প্রয়োগ করে স্থায়ীভাবে তাদের দমন করা যায় না। এদেশেও এ সত্য একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। জনগণ চাইছে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। দেশে শান্তি ফিরে আসুক।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : সাবেক সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম