প্রতিবছরই বাজেট পেশের সময় এ আলাপ সামনে আসে যে, বিনিয়োগ পরিস্থিতি কেমন আর সামনে এর কতটা বৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হচ্ছে। বিনিয়োগ বলতে বেসরকারি বিনিয়োগকেই বোঝানো হয়ে থাকে মূলত; যদিও সরকারি বিনিয়োগ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকার মূলত এডিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করে থাকে। সম্প্রতি পেশকৃত বাজেটে এর আকার মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। পরে এটি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে হতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে। আকার শেষতক যা-ই দাঁড়াক, এডিপি বাস্তবায়নের মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থেকে যায়। এক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতির আশা কেউ করছে না। তবু এডিপির আওতায় অর্থ ব্যয় হলে তাতে কিছু খাতে ব্যবসা বাড়বে; কর্মসংস্থান হবে। এর আওতায় অবকাঠামো উন্নয়নসহ যেসব কাজ হয়, তাতে প্রত্যক্ষভাবেও কিছু কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়। তবে প্রক্রিয়াটি অনেক ক্ষেত্রেই ত্বরান্বিত হয় ধীরে।
দীর্ঘ সময় ধরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প থেকেও অনেক সময় প্রত্যাশিত সুফল পায় না বেসরকারি খাত। সাভারের হেমায়েতপুরে গড়ে তোলা চামড়া শিল্পনগরের কথা উদাহরণস্বরূপ বলা যায়। দেখা গেল, প্রায় ২০ বছরেও সুসম্পন্ন করে প্রত্যাশিতভাবে এটি চালু করতে পারেনি সরকার। এর একটি বড় কাজ কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগারটি চাহিদামাফিক চালু করতে না পারায় ওখানে যেসব ট্যানারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে জায়গামতো রপ্তানি করতে পারছে না। তাতে এ খাতে রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রবণতাই বরং দৃশ্যমান। বেশি মূল্য সংযোজনে সক্ষম এমন খাত থেকে রপ্তানি দ্রুত বাড়িয়ে তৈরি পোশাকের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার কথা কি তাহলে শুধু মুখেই বলা হচ্ছে? নইলে এত বছর ধরে একটি চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলার কাজ এমনিভাবে করা হচ্ছে কেন? এতে দুর্নীতির অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেউ কেউ সম্ভাবনাময় চামড়া খাতের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগও তুলছেন ঘটনাধারার দিকে তাকিয়ে।
এখন বলা হচ্ছে, ওটার পাশে আরেকটি চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলা হবে। আরও দুই জেলায় দুটি চামড়া শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথাও শোনা যায়। আমরা আশা করে থাকব, হেমায়েতপুর শিল্পনগরের অসম্পূর্ণতা আগে দূর করা হবে-যত দ্রুত সম্ভব। আর যেসব ট্যানারি নিজ উদ্যোগে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতাগোষ্ঠীর শর্ত পূরণ করে ‘কমপ্লায়েন্ট’ হতে চায়, তাদের সর্বাত্মক সহায়তা জোগাবে সরকার। দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানেও অনেক বেশি কমপ্লায়েন্ট ট্যানারি রয়েছে। এদিক দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গও আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। অথচ ট্যানারির প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে আমরা আছি ভালো অবস্থানে। পাকিস্তানের চেয়ে বেশি পশু এবার কুরবানি হয়েছে দেশে।
এ দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো এটা বলতে যে, সরকারি খাতে অর্থ ব্যয় মানেই ইতিবাচক কিছু নয়। বরং বলা যেতে পারে, চামড়া খাতে যে গোটাকতক প্রতিষ্ঠান ‘কমপ্লায়েন্ট’ হয়ে দেশে-বিদেশে ভালো ব্যবসা করছে, তারা নিজ বিনিয়োগেই অর্জন করেছে সেটা। এসব প্রতিষ্ঠান আবার রয়েছে হেমায়েতপুর শিল্পনগরের বাইরে, এমনকি চট্টগ্রামে। রাজধানীর হাজারীবাগে যারা এতদিন চামড়া প্রক্রিয়াকরণে নিয়োজিত ছিল, হেমায়েতপুরে স্থানান্তরসহ ঠিকমতো ব্যবসা করতে না পারায় সেগুলোর সিংহভাগ ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে বলেও বক্তব্য রয়েছে। বিসিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল চামড়া শিল্পনগরটি গড়ে তোলার। কিন্তু এটি সুসম্পাদনের গুরুত্ব তারা বোধহয় বুঝে উঠতে পারেননি। সেজন্য তাদের জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না!
সরকারি বিনিয়োগের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আরও কিছু প্রকল্পের কথা তোলা যায়। সে চেষ্টায় না গিয়ে এটা বলা জরুরি যে, বছরের পর বছর আমাদের বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়ছে না। এটি আটকে আছে বলা যায় জিডিপির ২৩-২৪ শতাংশে। প্রতিবারই এটাকে ২৭-২৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হলেও পরিস্থিতির উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরেও বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে জানানো হয়েছে। প্রায় ২৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চলতি অর্থবছরে এটা কোনোভাবেই জিডিপির ২৪ শতাংশের বেশি হচ্ছে না। সরকারি সংস্থা প্রদত্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আবার প্রশ্ন রয়েছে। জিডিপি, বেসরকারি বিনিয়োগের তথ্য নিয়েও থাকবে অনেকের সংশয়। এসব তথ্য আমলে নিয়ে আলোচনায় গিয়েও দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি হতাশাজনক। তবে বিনিয়োগের এ পরিস্থিতিই বিদ্যমান বাস্তবতায় স্বাভাবিক। প্রকৃত পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ হলেও অবাক হওয়া যাবে না। কারণ অর্থনীতি মন্দাবস্থায় চলে গেছে অনেকদিন হয়ে গেল। আর এর প্রমাণ মিলছে প্রবৃদ্ধি অনেকখানি কমে যাওয়ার স্বীকৃতিতে।
চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছিল। অর্থবছর শেষে দেখা যাচ্ছে, এটা নেমে যাবে ৬ শতাংশের নিচে। প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হয়ে গেলেও অবাক হওয়া যাবে না। কেননা কৃষি ছাড়া শিল্প ও সেবা খাত ঠিকমতো ‘পারফরম’ করতে পারছে না। অথচ এ দুটি খাতই অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ছিল দীর্ঘদিন। কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে এগুলোর ভূমিকাই বেশি। কৃষির বিকাশ অবশ্য ভেতর থেকে ধরে রাখে; বিশেষত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সংকটকালেও জোগায় জীবনীশক্তি। কৃষি যথারীতি এটি করে যাচ্ছে। কোভিডকালেও প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাওয়ার সময় কৃষি ভালো করছিল। নইলে ওই সময়ে বিপদে পড়তে হতো আমাদের। কোভিড উত্তরণের পর অবশ্য আবার শুরু হয়েছিল উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জন। সেটা ধীর হয়ে আসতেও সময় লাগেনি। এজন্য অনেকে ‘বহিঃস্থ কারণ’কে বেশি দায়ী করলেও ক্রমে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশের ভেতর থেকে নীতি আর ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতাও অর্থনীতিকে ফেলেছে সংকটে। বিদেশি মুদ্রার সন্তোষজনক রিজার্ভ কমে গিয়ে তলানিতে এসে ঠেকাটা এর জোরালো প্রমাণ। অব্যাহতভাবে অর্থ পাচারও যে এজন্য অনেকখানি দায়ী, তা এখন স্বীকার করা হচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রাকে ‘শক্তিশালী’ দেখাতে গিয়ে ডলারের দাম দীর্ঘদিন আটকে রাখার বাজারবিরোধী নীতিও সর্বনাশ ঘটিয়েছে বলে মনে করা হয়।
এখন আবার ডলারের দাম এমনভাবে বাড়তে দেওয়া হচ্ছে যে, এর চাপ গিয়ে পড়ছে ইতোমধ্যে উচ্চপর্যায়ে থাকা মূল্যস্ফীতিতে। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সেটা ঘটছে মূলত। এদিকে রিজার্ভ বাঁচাতে সরকারকে সব ধরনের পণ্য আমদানিই নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে এখনো। তাতে শিল্পের উপকরণ আমদানিও কমবেশি হ্রাসের ধারায় রয়েছে। এ অবস্থায় শিল্পোৎপাদন কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, আর সেটা যাচ্ছেও। প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকেও পড়ছে এর প্রভাব। মূল আমদানিকারক দেশগুলোয় মন্দাবস্থা ধীরে কাটছে বলেও এর রপ্তানি আশাব্যঞ্জকভাবে বাড়ছে না। এর সহায়ক টেক্সটাইল, স্পিনিং খাতও পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করতে পারছে না প্রধানত জ্বালানি সংকটে। নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকট তীব্র এবং এটা কাটার কোনো লক্ষণ নেই। অথচ গ্যাসের দাম এক লাফে দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানোর সময় উদ্যোক্তাদের বলা হয়েছিল ‘নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ’ জোগানোর কথা। এ মুহূর্তে গ্যাস সংকট আরও বেড়ে ওঠার খবর রয়েছে; কারণ ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত একটি এলএনজি টার্মিনাল সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মেরামতের জন্য। দেশের ভেতর থেকে গ্যাস সরবরাহ জরুরিভিত্তিতে বাড়ানোরও সুযোগ নেই।
মাঝে এ সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় অধিক উৎপাদনক্ষম একটিমাত্র সার কারখানা চালু রাখার খবরও মিলেছিল। সরকার অবশ্য যেভাবে হোক, সার সংকট হতে দেয়নি। এ মুহূর্তে আবার খবর রয়েছে, বিপিসি জ্বালানি তেল আনতে গিয়ে সংকটে পড়েছে, এমনকি বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পর্যাপ্ত ডলার নেই বলে। রিজার্ভ ভালো হলে এ অবস্থায় সহজেই এগিয়ে আসতে পারতো বাংলাদেশ ব্যাংক। তাকে তো আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী একটা ন্যূনতম বা ‘নিট রিজার্ভ’ ধরে রাখতে হচ্ছে। এমনিতেও একটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হলো অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ ধরে রাখা। আমাদের আমদানি ব্যয় অনেক কমিয়ে আনার পরও দেখা যাচ্ছে, ৩ মাসের ব্যয় মেটানোর অবস্থা এখন নেই। সামনে আমদানি ব্যয় সম্ভবত আরও কমিয়ে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে জ্বালানি, খাদ্যশস্য, সার ইত্যাদির আমদানি অব্যাহত রেখে শিল্প খাতের আমদানি হয়তো কমাতে হবে আরও। তাতে এ খাতে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ আরও কমবে; বিদ্যমান সক্ষমতা ব্যবহার করাটাও হয়ে উঠবে না। এতে আগামী অর্থবছরে জিডিপির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটা অর্জন করা তো যাবেই না; বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও অসম্ভব হয়ে উঠবে।
অথচ বেসরকারি খাতই আমাদের প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি এবং কাজের জোগানদাতা। সেক্ষেত্রে শ্রমবাজারে আসা নতুন মুখ তো কাজ পাবেই না; কাজে নিয়োজিতদেরও অনেকে ছিটকে পড়বে। দেশের প্রধান শিল্প খাতে এ প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই ক্রিয়াশীল বলছেন সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালে বাজারে কাজের সংকট বেড়ে উঠলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা সহজে অনুমেয়। মূল্যস্ফীতির চাপে অভ্যন্তরীণ পণ্যবাজার সংকুচিত হয়ে পড়ায়ও শিল্পোৎপাদন কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। মূল্যস্ফীতি কমাতে আবার সুদের হার বাড়তে দেওয়ার যে নীতি নেওয়া হয়েছে, তাতেও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমবে। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে বলেও বেসরকারি খাতের পক্ষে বেশি ঋণ গ্রহণ সম্ভব হবে না। এদিকে নতুন করে সংকটে পড়া শেয়ারবাজার থেকে তাদের পুঁজি সংগ্রহের সুযোগও সীমিত।
এ অবস্থায় প্রত্যাশিতভাবে রাজস্ব আহরণ কিংবা অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে অগত্যা এডিপি অনেক বেশি কমিয়ে ফেলতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ যাবে আরও কমে। বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতিও অনেকদিন ধরে খারাপ। হালে এর আরও খারাপ খবর পাওয়া গেল। ‘স্টার্টআপে’ও বিনিয়োগ কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। বিদেশে আমাদের উদ্যোক্তাদের নিট বিনিয়োগও হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে এখন নাকি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সময় নয়। অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার সময়। তাতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াটাই নাকি মেনে নিতে হবে। এ অবস্থায় দেশে কাজের সুযোগ না বাড়লে বিদেশে লোক পাঠানো কি বাড়ানো যাবে? দারিদ্র্য পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে সামাজিক সুরক্ষায় প্রকৃত ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারবে সরকার? প্রশাসন ও সরকার পরিচালনার বেড়ে চলা ব্যয় কি কমাতে পারবে?
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক