দুর্নীতির লাগাম কে টেনে ধরবে?
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের দেশে সরকার-পক্ষ ও বিরোধী-পক্ষের রাজনীতিকরা বরাবরই পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা দোষারোপ করে প্রতিদিন বক্তব্য দিয়ে থাকেন। প্রায় একই বক্তব্য দিতে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা এবং ক্লান্তি কাজ করে না। রাজনীতির খেলায় বা বাস্তব ময়দানে না জিতলেও কোনো পক্ষ কণ্ঠশীলনে জিততে চায়। আগে ভাবতাম নিজ নিজ দলের কর্মীদের চাঙা রাখতে আর সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তারা এসব বলেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা সাধারণ মানুষকে বোকা ভাবেন বলেই নিজেরা চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা ভাবেন না, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে যাত্রা করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ দিকে হাঁটা ‘জনগণ’ আর এখন অত বোকা নন। সুতরাং সাতপুরোনো সব ঝগরাটে বক্তব্য বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে কি না তা ভাবা প্রয়োজন। সরকারি ও বিরোধীপক্ষের নেতাদের অতীতে এবং কারও বর্তমানে দুর্নীতির গন্ধ ছড়ালেও উভয়পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে দুর্নীতিগ্রস্ততার অভিযোগ আনছে প্রতিদিন।
আওয়ামী লীগপক্ষ বহুবার বিএনপি শাসনামলকে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল বলে অভিযোগ করেছে। দুর্নীতিতে তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কুখ্যাতির কথাও বলেছে, এখনো বলছে। এ বক্তব্য তথ্যভিত্তিক। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রের বরাতে আওয়ামী লীগ নেতারা জোর গলায় অভিযোগ আনতে পারছেন। বিএনপি নেতারাও একই কারণে তেমনভাবে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেরই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি প্রকাশ্যে আসায় অভিযোগের সত্যতা মানুষের সামনে প্রকাশিত হয়েছে। তবু একবারের জন্যও বর্তমানের নেতারা দুঃখপ্রকাশ করেননি। তাহলে কোন নৈতিক শক্তিতে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন?
আওয়ামী লীগ সরকার অনেক চমক লাগানো উন্নয়ন করলেও এ সময় সরকারি বা দলীয় প্রশ্রয়ে দুর্নীতিও বেড়েছে। কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির সূচক নিয়ে কোনো সরকারকে চ্যাম্পিয়ন বলে মেডেল দিল কী দিল না, তা বড় কোনো বিষয় নয়। এ দেশের ভুক্তভোগী মানুষ প্রতিদিনই বাড়বাড়ন্ত দুর্নীতির চেহারা দেখছে। আর ছোট দেশ বলে কাছে থেকে দুর্নীতিবাজদের কর্মকাণ্ড সবিস্তারে দেখছে। তাই উভয় পক্ষের দুর্নীতিবিরোধী কথা শুনে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ শুনতে শুনতে মানুষ ক্লান্ত এখন। আগে এসব বক্তব্য শুনে কৌতুকের আনন্দ লাভ করলেও এখন বিরক্তি প্রকাশ করছে।
এক সময় অনেকে বলতেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার প্রয়োজন কী? রাজাকারের তালিকা করাটা সহজ। রাজাকার-আলবদরদের বাইরে এ দেশের সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযোদ্ধা। একইভাবে এখন বলতে হবে এ দেশের সৎ মানুষের ছোট্ট তালিকা করলেই কাজ ছোট হয়ে যায়, বাকি সব দুর্নীতিবাজ। কেউ প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতি করছে, কেউ পরোক্ষভাবে।
এই যে এখন সাবেক পুলিশ-র্যাব প্রধান বেনজীর আহমদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হিমালয়সমান সম্পদের কথা গণমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে; একে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? অবশ্য বিচারের আগে এ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত বলতে চাই না। তবে কতগুলো প্রশ্ন তো সামনে চলেই আসে। আমাদের মতো ছা-পোষা যারা-যারা গোয়েন্দা নই, রাজনীতিক নই তারাও তো অনেকদিন থেকে বেনজীর আহমেদের নানা কীর্তি-কলাপের কথা শুনে আসছি। আদালতের নির্দেশে বেনজীর আহমেদের কয়েক গণ্ডা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলেও নির্দেশ পালনে বিলম্ব করা হয়েছে, পর্বতসমান সম্পত্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্রোক করা হয়েছে, বিদেশে বাড়ি-ফ্ল্যাট থাকার কথা দুদক জানতে পেরেছে। তিনি শতকোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। আবার এত ডামাডোলের ভেতর এমন অভিযুক্ত ব্যক্তি গা ঢাকাও দিয়েছেন।
তাহলে কি বলা যাবে, একটি জাতীয় দৈনিকে বেনজীর উপাখ্যান প্রকাশিত না হলে, ব্যারিস্টার সুমন হইচই না বাধালে এসব আমাদের জানতে আরও দেরি হতো? একদিনে তো তিনি এমন সাগরচুরি করেননি। তাহলে দুদক কেন এতদিন টের পেল না? গোয়েন্দারা কি শীতঘুম দিয়েছিলেন?
রাজনীতিকদের বক্তৃতাবাজিতে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। তাদের কথায় মনে হয়, এদেশের প্রাজ্ঞ-জ্ঞানী-গুণী তারাই। কোনো পক্ষ কি বেনজির আহমেদের সাম্রাজ্য গড়ার কথা জানতে পারেননি। এখন তো মনে হচ্ছে, উল্লিখিত দুটি মাধ্যম চ্যালেঞ্জ না করলে এসব আমাদের জানতে আরও দেরি হতো। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে যা জানা যায়, তাতে মনে হচ্ছে, একজন মানুষের পক্ষে রাতারাতি এত সম্পদ চুরি করা সম্ভব নয়। তাহলে তো মানতে হবে, এ মানুষটি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রশ্রয় পেয়েছেন। তা না হলে একজন দুর্নীতিবাজ পুলিশ বড় বড় পদে কাজ করার সুযোগ পেলেন কীভাবে? একাধিকবার পুলিশ পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এমন একজন দুর্নীতিবাজ শুদ্ধাচার পুরস্কার পেলেন কীভাবে?
এত হইচইয়ের পরও বেনজীর আহমেদের সাড়াশব্দ নেই। মিডিয়ার ভাষ্য-এর মধ্যে তিনি সপরিবারে বিদেশে পালিয়েছেন। জানতাম পুলিশ দেখে চোর পালায়, এখন পুলিশ দেখে সাবেক পুলিশপ্রধান পালান! পালানোটা যদি সত্য হয়, তাহলে জনমনে সরকারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ তৈরি হবে। দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়দাতা হিসাবে সরকারের দিকেই আঙুল তুলবে মানুষ। যেখানে দুদকের তদন্ত শুরুর প্রথমেই অভিযুক্তের দেশত্যাগে বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা, সেখানে দুদক সে দায়িত্ব পালন না করলেও ব্যাপক প্রচারিত দুর্নীতিবাজকে আটক করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষেরই উচিত ছিল প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তিনি নির্বিঘ্নেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। অসংগতি আরও লক্ষ করা যাচ্ছে। আদালতের নির্দেশনায় তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করতেও নাকি একটু সময় নেওয়া হয়েছে, যাতে তিনি তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো খালি করার সময় পান। যদি তা সত্য হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগবে, ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী একজন সাধারণ নাগরিক না পারলেও বেনজীর আহমেদ বিপুল পরিমাণ অর্থ এভাবে একযোগে তুলে কি নজির সৃষ্টি করতে পারলেন? যদি এসব টাকা বিদেশে চালান হয়ে থাকে তবে ডলার সংকটের এ সময় কোন পদ্ধতিতে টাকাগুলো সরে গেল? আরেকজন দুর্নীতিবাজ পি কে হালদারও তো একইভাবে সহায়তা পেয়েছিলেন। এ ডিজিটাল যুগেও নাকি দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা সংবলিত দুদকের চিঠি পৌঁছাতে পথে দেরি হয়ে যায়! স্থলবন্দরে নিষেধাজ্ঞার পত্র পৌঁছানোর তেরো মিনিট আগে তিনি নিরাপদে ভারতের মাটিতে পা রাখেন। কী অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা!
সরকার আস্থা রেখে আজিজ সাহেবকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিল। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এ আস্থাভাজনকেও সরকার চিনতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দেওয়ার পর সরকারের ঘুম ভাঙে। অনেকেই আজকাল প্রশ্ন রাখেন, সরকারের সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের এত সখ্য কেন! এভাবে দুর্নীতি এখন সরকার, রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের ছেলেবেলায় ঘুসখোর-দুর্নীতিবাজরা মাথা নিচু করে হাঁটত। পরিবার, এমনকি স্ত্রী-সন্তানরাও মুখ ফিরিয়ে নিতেন। এখন উলটো হয়ে গেছে। স্ত্রী-সন্তানরাও প্রশ্ন না করে চুরির টাকায় বিলাস-বসনে দিন কাটাচ্ছেন, বুক ফুলিয়ে হাঁটছেন সমাজে।
সম্প্রতি এক বন্ধু একজন পুলিশের এসআইয়ের কথা বলছিলেন। এদেশের একটি প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসআই সাহেবের মেয়ে পড়ে। মেয়েকে পড়াতে তো তার বেতনের চেয়ে বেশি টাকা দিতে হয়। ভদ্রলোকের পোস্টিং ঢাকার বাইরে দূরবর্তী এক জেলায়। তাই মেয়ের সুবিধার্থে ঢাকার বিলাসবহুল এলাকায় তিনি একটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। আমার বন্ধু এসআই সাহেবের পক্ষ নিয়ে বললেন, তাদের বড় গুরু যদি হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন, তাহলে এ পেটি অফিসারের দু-দশ কোটি টাকা থাকাটা দোষের হবে কেন? তবে এ সত্যটিও ভুললে চলবে না, অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এখনো সততা নিয়ে চলার চেষ্টা করেন। তারা তো হিরো নন। তাই আলোচনায় তাদের কথা নয়, লক্ষ্মীর বরপুত্রদের কথাই জানা যায়।
সাধারণ মানুষের ধারণা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যারা অধিষ্ঠিত হন এবং সেসব পদের ক্ষমতা ব্যবহার করে দিনের পর দিন দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশ্রয় ছাড়া তা সম্ভব হয় না। এ দেশে মিডিয়ায় হইচই না বাধলে যেন সাতখুন মাপ। বেনজীর আহমেদ সেদিক থেকে দুর্ভাগা। থলের বেড়ালটা বেরিয়ে গেছে আগেই। তার মতো না হলেও পুলিশপ্রধানদের অনেকেই মোটামুটি বিপুল অর্থবিত্ত নিয়ে অবসরে যান। একবার ঢাকার বাইরে এক জেলা সদরে যাচ্ছিলাম। পথে একই নামের অনেক নতুন চকচকে এসি বাস চলাচল করছিল। জানলাম, সদ্য অবসরে যাওয়া একজন পুলিশপ্রধান এসব বাসের মালিক। আসলে এসব ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর ব্যাপার। আমলার দুর্নীতি দুদক বা গোয়েন্দারা এড়িয়ে যান, কারণ তারা সরকারি দলের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেন। রাজনীতিকদের নানা কর্ম-অপকর্ম সামাল দেন। পুলিশ সরকারি দলের পক্ষে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বলে পুলিশ সুবিধাভোগী; এতে আর বিস্ময়ের কী আছে। সাধারণ মানুষ এসব নিয়তি নির্ধারিত বিষয় হিসাবেই মেনে নিয়েছে। এমন বাস্তবতায় সরকারি দলের নিদানের রক্ষাকবচ এসব পেশাজীবী নিরুদ্বেগে দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে যান। তাই প্রশ্ন দাঁড়ায়-কে কাকে শাসন করবে?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে দুর্নীতির এমন লাগামছাড়া দশায় যে আগুন জ্বলছে, এর আঁচ কি সরকার বা সরকারি দলের গায়ে লাগবে না? নিশ্চয়ই লাগবে। পুড়িয়েও দিতে পারে। যেহেতু সরকারের হাতে প্রশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা আছে কিন্তু রাশ টানার শক্তি নেই, সেহেতু দুর্নীতি আরও মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়বে। তখন চাইলেও সরকার লাগাম টানতে পারবে না। সরকারের সফলতার নানা অর্জন দুর্নীতির চোরাবালিতে ম্লান হয়ে যেতে খুব দেরি হবে না।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com