Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

আয় হ্রাস বনাম উচ্চ মূল্যস্ফীতি

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আয় হ্রাস বনাম উচ্চ মূল্যস্ফীতি

টানা ২২ মাস দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য-উভয় খাতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার অব্যাহত আছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) পুরো সময়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেও তা বজায় রয়েছে। তথ্য বলছে, দেশের অর্থনীতিতে তিন দশকে আর কখনোই এত দীর্ঘ সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্থায়ী হতে দেখা যায়নি। এদিকে যখন মূল্যস্ফীতি ঘটছে, তখন হ্রাস পাচ্ছে মানুষের আয়। আয় হ্রাসকালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কীভাবে সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট বৃদ্ধি করেছে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাত দিয়ে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার এবং মানুষের মজুরি বৃদ্ধির একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ সময়কালে মূল্যস্ফীতির হার ৯.৪১ থেকে ৯.৯৪ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ওঠানামা করেছে ৭.৩২ থেকে ৭.৮৫ শতাংশের মধ্যে। এ সময়কালে মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার কম। এর মানে, প্রতি মাসে যতটা মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, মজুরি বাড়ছে এর চেয়ে কম হারে। এখানেই শেষ নয়। ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি অনুসরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ফলে একদিনেই ৭ টাকা বাড়ে ডলারের বিনিময় হার, টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে ৬.৩৬ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, এর আগের এক বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মানে অবমূল্যায়ন ঘটে প্রায় ২৭ শতাংশ। টাকার মানের হঠাৎ বড় ধরনের এ অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও হ্রাস পেয়েছে। তাই খরচের গতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন-আয় ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ।

আমাদের সংবিধানে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর উল্লেখ করতে গিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১৫)। আবার মানুষের জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর শীর্ষে অবস্থান খাদ্যের। গত বছর (২০২৩) দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির গড় ১০ শতাংশের নিচে নামেনি; আর অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৬ শতাংশ, যা প্রায় ১২ বছরে সর্বোচ্চ। গত এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.২২ শতাংশ, যা মার্চে ছিল ৯.৮৭ শতাংশ। আর এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৩ সালের এপ্রিলে জাতীয়ভাবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৮৪ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, ২০২৩ সালের এপ্রিলে একজন ক্রেতাকে খাদ্যপণ্য কিনতে মানুষকে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিলে তাকে এর চেয়ে অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে এবং বর্তমানে তা অব্যাহত রয়েছে।

দেশের খাদ্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবার কেনার খরচ ছিল প্রতিমাসে মাথাপিছু ১ হাজার ৮৫১ টাকা। গত দুই বছরে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে মাথাপিছু খাবার কেনার খরচ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯২৩ টাকা; যা দুই বছর আগের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি। এতে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। শুধু দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষ বা নিম্নআয়ের মানুষ নয়, খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। তাদের মাছ, মাংস, ডিম, দুধ অর্থাৎ আমিষজাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হচ্ছে। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের মধ্যে পুষ্টির অভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া, খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় হ্রাস করতে হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং পারিবারিক স্বাস্থ্য রক্ষায় নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্যপণ্যবহির্ভূত খাতেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মোট ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়া অন্যসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। আফগানিস্তানে এ ব্যয় ৭৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৬৯ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির পকেটের ব্যয় ৬০ শতাংশের কম। ২০২৩ সাল ইউনেসকো প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের ফাইন্ডিংস অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১ শতাংশের জোগান আসে পরিবারগুলো থেকে, যা এ খাতে পরিবারপিছু খরচের বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ হার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি কারণে জমি, নির্মাণসামগ্রীর দাম হুহু করে বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি নির্মাণ ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। তাছাড়া শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও অন্যসব মহানগরীতে হোল্ডিং কর বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বহুলাংশে বেড়েছে। এসব কারণে বাড়ি ভাড়া বেড়েই চলেছে। রাজধানী ঢাকায় ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ ভাড়া বাড়িতে বাস করে এবং তাদের আয়ের একটি বড় অংশ বাড়ি ভাড়ায় ব্যয় হয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় অর্ধেক, ১২ শতাংশ আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাড়ি ভাড়া খাতে। ফলে বাড়ি ভাড়া মেটানোর পর ভাড়াটিয়াদের সংসার নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অন্যান্য খাদ্যবহির্ভূত খাত যেমন-যাতায়াত, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত বছর তিন দফায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৫ শতাংশ। চলতি বছরে ইতোমধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৮ শতাংশ। রাজধানীতে ঢাকা ওয়াসা বাড়িয়েছে পানির দাম। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৪ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা।

বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে ৪ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে পাঁচ লাখের মতো মানুষ চরম দারিদ্র্যের স্তরে নেমে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ভোগক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে দারিদ্র্য হ্রাস প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চরম দারিদ্র্য স্তরে নেমে আসা পাঁচ লাখ মানুষের আগে অবস্থান ছিল দারিদ্র্য স্তরে। একই কারণে নিম্নমধ্যবিত্তের অনেকের দারিদ্র্য স্তরে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ে এমনটা ঘটেছিল। ২০২৩ সালের মে মাসে রাজধানীতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সম্মেলনে জানানো হয়, করোনার কারণে ঢাকায় নতুন দরিদ্রের আবির্ভাব ঘটে। গত বছর ঢাকায় মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন দরিদ্র, যারা নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে আসে। এর অর্থ দাঁড়ায়, চলমান টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেমন একদিকে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে সামাজিক স্তর বিন্যাসে পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে।

এ অবস্থায় সরকারের যা করণীয় তা হলো-এক. মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিকে নিম্নমুখী করতে যথাযথ কৌশল নির্ধারণ। কৌশল নির্ধারণে যেসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে সেগুলো হলো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় হ্রাস, সরকার পরিচালনার ব্যয় হ্রাস, অর্থ পাচার বন্ধ, খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি জোরদারকরণ। দুই. মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ানো। বিবিএসের তথ্য বলছে, তিন বছর ধরে মাথাপিছু আয় অনেকটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে ২৭৯৩ ও ২৭৪৯ মার্কিন ডলার। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২৭৮৪ মার্কিন ডলার। তিন. ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আয়বৈষম্য হ্রাস। বিবিএসের খানা জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আয়বৈষম্য বেড়েই চলেছে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম