Logo
Logo
×

বাতায়ন

ডোনাল্ড লুর সফরের বার্তাটা বোঝা দরকার

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডোনাল্ড লুর সফরের বার্তাটা বোঝা দরকার

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বিষয়াদি দেখভালে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত। ভারত, বাংলাদেশসহ এতদঞ্চলের প্রায় সব দেশের নানা বিষয়ে তিনি অবগত থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তার সম্পৃক্ততার গুরুত্ব ব্যাপক। দেশে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি সরকারি দল, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সঙ্গে নিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে তার তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশি পর্যবেক্ষক প্রেরণে তার ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। সব দলের অংশগ্রহণে অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার অভিপ্রায় ছিল ইতিবাচক। নির্বাচনের পর ভোটার সংখ্যা, দলীয় অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রচারণার বিষয়টি বহুল আলোচিত। সেসময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরাশক্তির অযাচিত মন্তব্য ও হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠে। সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোট ও মানবাধিকার বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর দৌড়ঝাঁপ ছিল চোখে পড়ার মতো। রাষ্ট্রদূতদের প্রকাশ্যে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কার্যকলাপও লক্ষ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞাসহ নানামুখী কার্যকলাপ নিয়ে দেশে অন্তহীন কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনে ৪২ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি নিয়েও বেশকিছু মুখরোচক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল।

নির্বাচনের পর মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফর নিয়েও অনেক গুঞ্জন শোনা যায়। কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সরকারকে অনেকটা বেকায়দায় ফেলবে। নির্বাচনবিরোধী বা ভোটবর্জনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি-দল-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও বক্তব্য প্রদান অব্যাহত ছিল। মাঠে-ময়দানে-সভা-সমাবেশে এসব বক্তব্যে জনগণ ছিল উদ্বিগ্ন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনসহ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে প্রশমিত হয়। টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীর করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীও মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ফিরতি চিঠি মারফত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সমাপ্তি ঘটিয়ে ডোনাল্ট লুর সফর সরকারের পক্ষেই গেছে বলে বিজ্ঞমহলের ধারণা।

এ সফরের প্রাক্কালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া সংবাদ সম্মেলনে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘বাংলাদেশ সফরে এসে গত দুদিনে আমি দুই দেশের জনগণের মধ্যে পুনরায় আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছি। আমরা জানি, গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অনেক টেনশন ছিল। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। এতে কিছু টেনশন তৈরি হয়। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। আমরা সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। আমরা সম্পর্কোন্নয়নের উপায় খুঁজে বের করতে চাই। আমাদের সম্পর্কের পথে অনেক কঠিন বিষয় রয়েছে-র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন। কিন্তু কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য ইতিবাচক সহযোগিতার ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে চাই।’

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ঘিরে মানবাধিকার, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য দেখা দেয়। অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্বিঘ্ন নির্বাচনের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতিতে কড়াকড়ি আরোপের ঘোষণাও দেয়। ফলে নির্বাচন শেষ হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় ডোনাল্ড লুর এবারের সফর সম্পর্কোন্নয়নের ইচ্ছার ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। তার সফরে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এক নতুন মোড় নিয়েছে। তার বক্তব্যেই এর স্পষ্ট আভাস পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আর কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। লুর এ সফর সরকারকে অনেক স্বস্তি দেবে। চলমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র উভয়পক্ষই উভয়ের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী, যার পেছনে কাজ করছে উভয় দেশের জাতীয় স্বার্থ। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কারণে অর্থনীতিতে বড় বাজার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানকে যুক্তরাষ্ট্র কাজে লাগাতে চায়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক গবেষকদের মতে, বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণেই মূলত বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে বঙ্গোপসাগরের বিশেষ ভূমিকা, বাণিজ্যিক পথ মালাক্কা প্রণালিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের শক্ত অবস্থানের জন্য বঙ্গোপসাগরের দিকে চীনের নজর, চীনকে আটকানোর জন্য বঙ্গোপসাগরে মার্কিন অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ এবং ভারতের প্রতিবেশী ও চীনের খুব কাছাকাছি হওয়ায় মার্কিন প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। অধিকন্তু ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য সহজ করতে এ অঞ্চলের ভূমিকা, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ পরিকল্পনার অংশ হওয়া, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ হিসাবে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি-অর্থনীতি-ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে বিধায় ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে।

দেশের সচেতন মহল সম্যক অবগত আছেন, স্বাধীনতার আগে থেকেই এদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ষড়যন্ত্রে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বিরাজমান ছিল। পরামর্শকের বেশে বিদেশিদের অবাধ বিচরণের সুযোগে মোগল শাসকদের কাছ থেকে ভারতবর্ষ ইংরেজদের হস্তগত হওয়ার ঘটনা কারও অজানা নয়। পাকিস্তান আমলেও দেশ পুরোপুরি বিদেশিদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিণত হয়। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিদেশি প্রভাবমুক্ত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। এমনকি বিভিন্ন প্রতাপশালী রাষ্ট্র-মন্ত্রী-নেতাকে পর্যন্ত তিনি এদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ দেননি। ১৯৭৪ সালের ৪ মার্চ কুমিল্লার দাউদকান্দিতে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলংকা-আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা কারও সঙ্গে কোনো বিবাদে লিপ্ত হতে চাই না। আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে একে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে চাই। আমাদের ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করুক তা আমি চাই না, আমরা অপরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না।’

এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য, দেশের ৫০ বছরের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মযজ্ঞকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিক্রমা তথা আশু-স্বল্প-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের রোডম্যাপে রয়েছে অগ্রসরমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, লিঙ্গ সমতা, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ু বৃদ্ধি। শ্রমঘন রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, বিশেষায়িত ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব উন্নয়ন, পোশাক ও ওষুধ শিল্পকে রপ্তানিমুখীকরণ প্রভৃতি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে ভৌত অবকাঠামো, যাতায়াতব্যবস্থা প্রভৃতিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ। নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীরসমুদ্র বন্দর, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল নির্মাণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাবদ্ধতা নিরসন, সুপেয়-ব্যবহারযোগ্য পানি ও সুয়ারেজ প্রকল্পের মতো বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নসহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের সক্ষমতা অর্জনে উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে উন্নয়নের রোল মডেলের খ্যাতি পেয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারও নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছে। আলোচনা-সমালোচনার পর্যায় পেরিয়ে দেখার বিষয় হচ্ছে, দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর করতে ডোনাল্ড লুর এ সফর কী প্রভাব রাখে। এটুকুই প্রত্যাশা, দুই দেশের পক্ষ থেকে ঘোষিত সংকল্পের ভিত্তিতে সব ক্ষেত্রে পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হোক।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম