Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিঠে কড়া সংলাপ

লোভ-লালসার এক অসামান্য গল্প ও বাংলাদেশ

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লোভ-লালসার এক অসামান্য গল্প ও বাংলাদেশ

রুশ লেখক লিও তলস্তয়ের লেখা ‘How much land does a man require’ গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, লেখক কতটা সুন্দরভাবে একজন লোভী মানুষের চরিত্র সেখানে ফুটিয়ে তুলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পৃথিবীর লোভাতুর মানুষকে জীবনের হিসাব নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করার জন্য একজন কৃষকের জমির প্রতি লোভকে কেন্দ্র করে গল্পটি রচনা করলেও মূলত তিনি সব ধরনের লোভ-লালসা থেকে মানবসমাজকে মুক্ত থাকার জন্য গল্পটিতে অতি মূল্যবান একটি মেসেজ দিয়েছেন।

কৃষক প্যাহোম একজন অত্যন্ত লোভী ব্যক্তি ছিল। কম দামে যেখানেই ভালো জমি পাওয়া যেত, সেখানেই সে জমি কিনতে ছুটে যেত এবং সেসব জমি ভোগদখল করে মুনাফা লুটত। আর এভাবে সে সামান্য একজন কৃষক থেকে জমিদারে পরিণত হয়ে ভূসম্পত্তিসহ প্রচুর গরু, ঘোড়া ইত্যাদি গবাদি পশুরও মালিক বনে গেল।

এ অবস্থায় একবার সে শুনতে পেল, পাহাড়ের পাদদেশে একদল মানুষের বসবাস, যারা বস্কির বলে পরিচিত, সেখানে খুব সুন্দর সুন্দর জমি কম দামে পাওয়া যায়। খবরটি শুনে প্যাহোম কালবিলম্ব না করে চাকরটিকে সঙ্গে নিয়ে সেদিকে ছুটল। অতঃপর সেখানে পৌঁছে দেখল, চারদিকে সবুজে ঢাকা মাঠের পর মাঠ। এলাকার লোকের সঙ্গে কথা বলে সে জানতে পারল, জমি কিনতে হলে তাদের সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিয়ালের চামড়ার টুপি পরা সর্দার সেখানে উপস্থিত হলে তারা পাহাড়ের উপরে উঠে দরদাম ঠিক করার সময় সর্দার বললেন, ‘আমরা দিন হিসাবে জমি বিক্রি করি, এক হাজার রুবেলের বিনিময়ে একদিনের ভেতরে তুমি পায়ে চলে যতদূর ঘুরে আসতে পারবে, ততখানি জমি তোমার হবে, তবে মনে রেখ সূর্যাস্তের আগে তুমি এখানে ফেরত না আসতে পারলে কিন্তু তোমার টাকা মার যাবে।’

সর্দারের কথায় কৃষক প্যাহোমের মন আনন্দে ভরে উঠল। সে ভাবল, সারাদিনে অনেক দূর পর্যন্ত ঘুরে সহজেই প্রচুর জমির মালিক হয়ে যাবে! তাড়াতাড়ি সে সর্দারের টুপিতে এক হাজার রুবেল রেখে বলল, সারাদিনে আমি কতদূর বা কোন পর্যন্ত ঘুরে এলাম, কীভাবে তার প্রমাণ থাকবে? সর্দার বললেন, তুমি একটি কোদাল সঙ্গে নিয়ে যেও, যা দিয়ে তুমি যেখানে যেখানে যাবে, সেসব স্থানে কোপ দিয়ে চিহ্নিত করে আসবে। প্যাহোম ঘাড় নেড়ে বলল, তাহলে কাল সকালেই সে হাঁটা শুরু করবে। এ অবস্থায় সারারাত সে ঘুমাতে পারল না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে লাগল সারাদিন সে বহুদূর অবধি ঘুরে আসবে, একদিনে সহজেই পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মাইল ঘুরে আসতে পারবে, কারণ দিনগুলোও খুব লম্বা, কত জমির মালিকই না সে হবে। জমিগুলো দখলের পর তাকে আরও অনেক গরু আর ঘোড়া কিনতে হবে, বহু লোকও খাটাতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত অনিদ্রায় কেটে যাওয়ায় সূর্যোদয়ের আগেই সে একটি কোদালসহ চাকরটিকে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল এবং পূর্বাকাশ লাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা বেরিয়ে পড়ল।

চারদিকেই কেবল সবুজ আর সবুজ, কোন দিকে যাবে ঠিকমতো তা ঠাহর করতে না পেরে সে স্থির করল, যেদিকে সূর্য টকটকে লাল হয়ে উঠছে, সেদিকেই যাবে। প্যাহোম চলা শুরু করল এবং প্রথমে খুব জোরেও না, আবার আস্তেও না এভাবে চলা শুরু করল। চলার পথে প্রতি হাজার গজ অন্তর সে একটি করে গর্ত করে রেখে যেতে থাকল, যাতে করে তার জমির সীমানা নির্ধারিত হয়। এভাবে কিছুক্ষণ পর সে অনুমান করল, তিন মাইল এসেছে। তখন রোদের তেজ ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় গায়ের জামা খুলে সে কাঁধে রাখল। কিছুক্ষণ চলার পর রোদ আরও বেড়ে গেলে সে সঙ্গে আনা কিছু খাবার খেয়ে নিল। তারপর এখনো অনেক সময় আছে ভেবে আবার সামনের দিকে অগ্রসর হলো। চলতে চলতে ভাবল, আরও তিন মাইল সামনে গিয়ে সে বাম দিকে ঘুরবে। এভাবে যতই এগোতে থাকল, ততই ভালো জমি তার চোখে পড়ল। ফলে তিন মাইল পার হয়ে গেলেও সে আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলল, কারণ এসব ভালো জমি ফেলে আসা যায় না। এভাবে ক্রমাগত সে সামনের দিকে এগাতে থাকল আর ভাবল, সারা জীবন আর কোনো চিন্তা করতে হবে না, আজ সারাদিনে যতটা পারি জমি দখলে নিয়ে বাকি জীবন সুখ-শান্তি এবং অত্যন্ত আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেব। এসব ভাবতে ভাবতে সে কেবলই দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে চলল এবং কোদাল দিয়ে জমি চিহ্নিত করতে থাকল। অতঃপর এক সময় সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ল। প্যাহোম ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সূর্যটাকে দেখে নিয়ে ভাবল আর বেশিক্ষণ সময় নেই, এ অল্প সময়ের মধ্যেই যতটা পারি বেশি জমি দখলে নিতে হবে। এ অবস্থায় সে আরও দ্রুত পা চালাতে থাকল এবং আরও কয়েক মাইল জমি কোদালের কোপে চিহ্নিত করে ফেলল। তারপর সে পেছনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, সূর্যের আলো পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। কিন্তু তারপরও সে লোভ সামলাতে না পেরে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে আরও কিছু জমি কোদাল দ্বারা চিহ্নিত করে ফলল। তখন সে ভীষণ ক্লান্ত অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরি নেই, চারদিকে কেমন আবছা হয়ে আসছে। এতক্ষণ জমি দখলের নেশায় মেতে থাকলেও এক্ষণে তার বস্কির সর্দারের শর্তের কথা মনে পড়ে গেল। সূর্যাস্তের আগে পাহাড়ে ফিরতে না পারলে জমিও যাবে, টাকাও যাবে কথাটি মনে পড়তেই সে পাহাড়ের দিকে হাঁটা শুরু করল। সে খুব দ্রুত চলতে লাগল এবং কয়েক মাইল এগোনোর পর দেখল, তাকে কমপক্ষে আরও দশ-বারো মাইল যেতে হবে। এদিকে সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে, একটু পরেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসবে। এসব কথা ভেবে অতি দ্রুত পা চালাতে থাকায় প্যাহোমের চলতে অনেক কষ্ট হতে লাগল, ভয়ানক গরমে সে অত্যন্ত কাবু হয়ে পড়ল। তার পা কেটে চিরে গিয়েছে, আর চলতে পারছে না। বিশ্রাম করতে অত্যন্ত ইচ্ছা হলো, কিন্তু সূর্যান্তের আগে তার পৌঁছানো চাই-ই-চাই!

এভাবে চলতে চলতে ক্রমশ তার শরীর দুর্বল হয়ে আসায় সে ভাবল, হায়, খুব বেশি জমি দখলে নিতে, অনেক বেশি দূরে চলে গিয়ে কী ভীষণ ভুলটাই না করে ফেললাম! যদি ঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারি, তখন কী হবে? আবার সে পাহাড়ের দিকে চেয়ে দেখল, পাহাড় তখনো অনেক দূরে। প্যাহোম প্রাণপণ চলতে লাগল, তার খুব কষ্ট হচ্ছিল, তবুও চলা অব্যাহত রাখল। এক পর্যায়ে সে টুপি, কোট, জুতা, পানির বোতল সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছুটতে লাগল, তার গলা শুকিয়ে কাঠ হলো, হাতুড়ির মতো বুকের ভেতর আঘাত বোধ করতে থাকল, পা অবশ হয়ে এলো। প্যাহোমের মনে মরণের ভয় শুরু হয়ে গেল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে থামল না। কারণ সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে টাকা ও জমি দুটোই যাবে।

চলতে চলতে এক পর্যায়ে সে আরও দুর্বল হয়ে পড়ল, কিন্তু তারপরও সে থামল না। ভাবল, এখানে থেমে গেলে জমির মালিক হওয়া যাবে না, সারাদিনের এতটা পরিশ্রম, কষ্ট সব বৃথা যাবে। এক পর্যায়ে সে পাহাড়ের প্রায় কাছাকাছি এসে শেষ মুহূর্তে প্রাণপণ ছুটতে আরম্ভ করল। সূর্য একেবারে রক্তের মতো লাল হয়ে উঠেছে, ঠিক ভোরবেলা যেমনটা সে দেখেছিল। প্যাহোমও নির্দিষ্ট স্থানের কাছে চলে এসেছে। পাহাড়ের উপরের লোকদের দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সর্দারও সেখানে বসে আছেন। প্যাহোম ভাবল, অনেক জমি হয়েছে, এখন ভোগ করার জন্য বেঁচে থাকা দরকার। বাকি পথটুকু যেতে সে প্রাণপণ আরও একবার দৌড় দিয়ে যেমনি পাহাড়ের উপরে উঠতে থাকল, তখনই চেয়ে দেখল, সূর্য অস্ত গিয়েছে। সব পরিশ্রম ব্যর্থ হয়েছে ভেবে সে একটা ভয়ানক চিৎকার করে উঠল! কিন্তু বস্কিরা তাকে দেখে বলল, পাহাড়ের উপর থেকে এখনো সূর্যের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি এসো। কিন্তু ততক্ষণে প্যাহোমের পা একদম অবশ হয়ে গিয়েছে, তবুও দ্রুতভাবে এগোনোর চেষ্টা করে লম্বা করে হাত বাড়িয়ে কোনোমতে সে সর্দারের টুপি স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে সর্দার চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘সাবাস অনেক জমি পেয়েছ।’

কিন্তু প্যাহোম সেখানেই পড়ে রইল। তার চাকরটি প্যাহোমকে ধরে তুলতে গেল, কিন্তু পারল না। দেখা গেল প্যাহোমের মুখ দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত পড়ছে, সে এইমাত্র মারা গেছে! বস্কিরা সবাই জিভ কাটল। প্যাহোমের চাকর কোদাল দিয়ে ছয়ফুট লম্বা একটি কবর খুঁড়ে সেখানে তাকে সমাহিত করল।

লেখাটি এখানেই শেষ করা যেত। কারণ গল্পটি আগে যারা পড়েছেন, তারা যেমন গল্পটির মর্মকথা জানেন, আবার এইমাত্র যারা পড়লেন, তারাও তলস্তয়ের লেখাটির সারমর্ম বুঝে ফেলেছেন। তবে আমি কেন কাহিনিটুকুর সারাংশ এখানে তুলে ধরলাম, সে প্রশ্নটিও এসে যায়।

প্রায় দেড়শ বছর আগে তলস্তয়ের এ লেখাটি ইতোমধ্যে বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং সারা বিশ্বের কোটি কোটি লোক তা পাঠ করেছেন। কিন্তু লেখকের লেখার মূল উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হয়েছে, সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতেই পারে। বিশেষ করে আমাদের দেশের লোভী বা অতিলোভী মানুষের কথা বিবেচনায় তলস্তয়ের লেখা গল্পটিকে ‘অরণ্যে রোদন’ ছাড়া অন্য কিছু বলা যাবে কিনা তা প্রশ্নাতীত নয়। কারণ আমাদের দেশের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষই অতিলোভী। সেক্ষেত্রে ঘুসখোর সরকারি আমলা-কর্মচারী অথবা মজুতদার মুনাফাখোর ব্যবসায়ী, শ্রমিক ঠকানো ব্যবসায়ী, একশ্রেণির আইনজীবী, ডাক্তার, রাজনীতি করে খাওয়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ইত্যাদি যাদের কথাই বলি না কেন, বলতে গেলে সব শ্রেণি-পেশার বেশির ভাগ লোকই তলস্তয়ের লেখাটির উদ্দেশ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছেন। বিশেষ করে এদেশের রাজনীতি করে খাওয়া লোকজন যে ‘ক্লাসিক টেল অব গ্রিডে’র একটি উৎকৃষ্ট ও জাজ্বল্যমান উদাহরণ, সে কথাটি বলাই বাহুল্য।

আমাদের দেশের রাজনীতি যেভাবে দূষিত হয়েছে, কলুষিত হয়েছে, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিহিংসার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, রাজনীতির প্রতিটি পরতে যেভাবে নোংরামি ঢুকে পড়েছে, সুযোগ বুঝে একদল আরেক দলের লোকের উপর সময়ে সময়ে যেভাবে অত্যাচার নির্যাতন করা হয়, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমনটি করা হয় বলে মনে হয় না। আর এ সবই করা হয় লোভ এবং অতিলোভের কারণে। কেউ অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার জন্য, আবার কেউবা ক্ষমতা বা গদি দখলের জন্য এসব করে থাকেন। অথচ এসব যারা করে থাকেন, তাদের প্রায় সবাই তলস্তয়ের ‘প্যাহোম’ চরিত্রটির পরিণতির কথাটিও জানেন। কারণ তলস্তয়ের লেখা অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় বিধায় গল্পটিও বহুল প্রচলিত। সুতরাং আজকের লেখাটিতে সেই গল্পটিই আবার তুলে ধরে বলতে চাই, আপনারা যারা রাজনীতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে টাকা কামিয়ে অর্থ-বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, বিদেশে বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ করেছেন, সেসব সুখ-শান্তিতে ভোগ করতে পারবেন কিনা, সে বিষয়টি আশা করি ভেবে দেখবে। মনে রাখবেন, অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ের আপনাদের এসব কর্মকাণ্ডও কিন্তু ‘ক্লাসিক টেল অব গ্রিড’ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবে। কারণ দেশের সম্পদ লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবেন, আবার দেশে রাখার স্থান সংকুলানের অভাবে সেসব অর্থ-বিত্ত বিদেশে পাচার করে তা সুখে-শান্তিতে ভোগ করবেন, সে ভরসাও কিন্তু মিছে। কারণ দেশের সাধারণ নিরীহ মানুষসহ খেটে খাওয়া, অর্ধাহার-অনাহারে থাকা মানুষের অভিশাপের আগুনে আপনাদের প্রাসাদও কিন্তু একদিন পুড়ে যাবে!

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম