নিরপেক্ষতার চোখ দিয়ে দেখুন সব
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমরা যারা ইতিহাস থেকে সত্য ধারণ করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের মহান স্মৃতি যাদের বুকের ফটোপ্লেটে এখনো উজ্জ্বল, দলপ্রেম নয়-দেশপ্রেম যাদের ধমনিতে, সুবিধাবাদ যাদের আকর্ষণ করতে পারেনি, তারা দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে কলুষমুক্ত দেখতে চায়। আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষতায় দেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন তাদের আমোদিত করে। তারা দেখতে পান তেমন কোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য পূরণের সুযোগ রয়েছে। তবে শঙ্কা সুশাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়ন সব অর্জনকে না নড়বড়ে করে দেয়!
এ সরকারের শুভার্থী হিসাবে আমাদের ভেতর কিছু শঙ্কার কালো মেঘ জমাট বাঁধছে। বারবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও সরকারের পরিচালকরা দলীয় বৃত্তে আটকে গিয়ে মুদ্রার দুটো পিঠই কি দেখতে পাচ্ছেন? কারণ চারপাশে নানা পেশাজীবী ধামাধরা চাটুকারের সংখ্যা বাড়ছে। প্রকৃত সংকট তারা সরকারপ্রধানের দৃষ্টি থেকে সরিয়ে রাখতে চায়। অন্যদিকে ক্ষমতা ও শক্তির মোহে নানা খানাখন্দ কি দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে? পাহাড়ে ওঠা কঠিন-তবে স্বস্তি, এ কাঠিন্য অনেকটাই জয় করতে পারছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার দৃঢ় নেতৃত্বে। কিন্তু মুহূর্তের ভুলে বা বিভ্রান্তিতে পতন কিন্তু এক লহমায় হয়ে যেতে পারে। আমার এক স্কুলশিক্ষক বলতেন আত্মম্ভরিতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়।
ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ড এ দেশে নতুন নয়। যখন থেকে ছাত্র রাজনীতি অঙ্গ বা সহযোগী যে নামেই হোক মূল দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তখন থেকে ক্যাম্পাসে রাজনীতির শক্তিতে খুনোখুনির মাত্রাও বেড়ে যায়। এক সময় ছাত্রশিবিরের রগ কাটা রাজনীতির বিভীষিকা ছড়িয়েছিল বিশেষ করে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সংগঠনটি জামায়াতে ইসলামের অঙ্গ। ওদের রগ কাটা ইমেজ বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের হিংস্র চেহারা আমরা ভুলতে পারি না। সুতরাং এ দলটির অঙ্গ তো আর ভিন্ন আচরণ করবে না। অন্যদিকে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েই তো জিয়াউর রহমান রাজনীতি ও সরকার পরিচালনা করেছিলেন। অস্ত্র আর অর্থ তুলে দিয়ে ছাত্রদলের যাত্রা শুরু করিয়েছিলেন তিনি। সে সময়ও খুনোখুনি কম হয়নি। আর এ দলের বাই প্রডাক্টই ছিল জেনারেল এরশাদের ছাত্রসমাজ। তাই অস্ত্রচর্চা এরাই বা কম করবে কেন!
আবরার হত্যা, এর আগে বিএনপি আমলে বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সনি হত্যা, এসব মর্মান্তিক স্মৃতির কারণে বুয়েটের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এটি বেশিদিন হজম করতে পারেননি সরকারদলীয় রাজনীতিকরা। নানা কায়দাকানুন করে আবার ছাত্রলীগ রাজনীতি পুনর্বহাল করে বুয়েটে। এর সবই দেশবাসী জানেন।
মানুষ তো সুন্দরের স্বপ্ন বুনতেই পছন্দ করে। আশা নিয়েই নাকি মানুষের বাঁচা। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মানুষ শুভ প্রত্যাশা কিছুটা করেছিল। ভেবেছিল ঐতিহ্যবাহী দল ছাত্রলীগ, যার বয়স আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশি, নানা গৌরবময় আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থেকে নিজের উজ্জ্বল ঐতিহ্য গড়েছে দলটি, সে গৌরবের ছাত্রলীগে বেড়ে ওঠা আজকের আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা দলে ও সরকারে থেকে একটি শোভন ছাত্র রাজনীতির দীক্ষা দেবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এ যুগে এসে ছাত্রলীগকে সেই মার্জিত রূপে আমরা দেখতে পাইনি। ছাত্র রাজনীতি ষণ্ডাতন্ত্রে আটকে যাওয়ায় ক্যাম্পাসে মেধাবীরা রাজনীতিবিমুখ হয়েছে। অর্থশক্তি আর পেশিশক্তির মোহে এরাও আসক্ত হয়ে পড়েছে। সুস্থ রাজনীতি চর্চা না থাকায় কখনো শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, আবার কখনো শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ছাত্রলীগে নাম লেখানো তরুণদের দলের লাঠিয়াল বানানো হয়েছে। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভালো হতে পারে না।
আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের একটি সমস্যা আমরা দেখতে পাই, তারা দেশের মানুষকে বোকা ভাবতে পছন্দ করেন। তাই এমন সব কথা বলেন, যা আসলে সচেতন মানুষকে বিরক্তই করে। এ সচেতন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। একজন স্বল্পশিক্ষিত রিকশা ড্রাইভারের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শুনলেও অবাক হতে হয়। তাই এ দেশের বড় সংখ্যক মানুষ-যারা দলীয় রাজনীতির আফিমে বুঁদ নন, তাদের কাছে নেতাদের রাজনৈতিক বক্তব্যের কোনো মূল্য নেই। যেমন আবরার হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের কণ্ঠে শুনেছিলাম-এটি নাকি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দায় ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেবে না। এ ছেলেদেরও দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ এখন নিজ ঘর ঠিক রাখতে চায়। তাই অপকর্মের জন্য ছাত্রলীগ কর্মীরা বলি হলেও নেতৃত্বের কিছু যায়-আসে না। তারা নিরপেক্ষতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসাবে নিজেদের নাম প্রচার করতে পারবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সব ক্যাম্পাসেই যে ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী বখাটে হয়ে গেছে, এ সত্য তো তারা স্বীকার করতে চাইছেন না। এখানেই আমাদের আশঙ্কার জায়গা।
এই যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাধারণ ছাত্রদের ছাত্রলীগ এক রকম জিম্মি করে রেখেছে, তা কি কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন না? মিছিলে না গেলে, ছাত্রলীগের বড় ভাইদের আদেশ না শুনলে বা ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাদের যে গেস্টরুমে বা তথাকথিত টর্চার সেলে নিপীড়ন করা হয়, হল প্রশাসন প্রায়ই প্রতিবিধান না করে অক্ষমতা প্রকাশ করে, এ কথা কি কারও অজানা? নেতারা উচ্চাসনে বসার কারণে যদি না-ই দেখতে পান, এতসব গোয়েন্দা সংস্থা কী রিপোর্ট দেয়? নাকি দাপট দেখিয়ে চলার মধ্যেই বীরত্ব দেখছেন। বাহবা দিচ্ছেন!
যে কোনো সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী বলবেন, দলীয় বৃত্তে বন্দি ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি সব শাসন যুগে ক্ষমতাসীনদের উপকারে লাগলেও শিক্ষার স্বাভাবিক ও কাঠামোগত উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এতে সাধারণ্যে অস্বস্তি যেমন তৈরি হচ্ছে, ক্ষোভও বাড়ছে তেমনি। এর ফলে দল ও দলীয় সরকার অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটি খুব অদ্ভুত কথা সুবিধার স্রোতে ভাসা রাজনীতিকরা বলেন। ছাত্র রাজনীতি না করলে নাকি রাজনীতির ট্রেনিং পাওয়া যায় না। তাই ছাত্র রাজনীতি না থাকলে ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল ধরবে কারা! তবে রাজনীতির প্রশিক্ষণ পাওয়া যে ছাত্রলীগের পরিচয় আমরা পাচ্ছি, তাতে ভবিষ্যৎ রাজনীতির হাল ধরে এরা খুনির পৃষ্ঠপোষকতা করবে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর কমিশন বণিকদের আশ্রয়দাতা হবে। দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হয়ে যাবে দেশ।
সভ্য দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন থাকে। তারা শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ দেখে। একাডেমিক উন্নয়ন ও সংস্কৃতি বিকাশে ভূমিকা রাখে। জাতীয় রাজনৈতিক দলের সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠন হিসাবে চলা তাদের কাছে অদ্ভুত চিন্তা। শিক্ষকরা হন শিক্ষা গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ। রাজনৈতিক দলাদলির অভিজ্ঞতা তাদেরও নেই। তাই বলে কি রাজনৈতিক সচেতনতা তাদের মধ্যে তৈরি হয় না? জাতির প্রয়োজনে তারা মাঠে নামেন না? আইরিশ আন্দোলন এবং ফ্রান্সের সংকটে কি ছাত্র-শিক্ষকরা নিশ্চুপ বসেছিলেন? এজন্য আলাদা করে রাজনৈতিক দীক্ষা নিতে হয়নি।
আমাদের দেশে আইউববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং অতঃপর জাতির সংকটে সাধারণ ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী সবাই কি ঝাঁপিয়ে পড়েননি? বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী-যার রাজনীতির প্রতি ঝোঁক আছে-পড়াশোনো আছে, রাজনীতির মাঠে তথাকথিত প্রশিক্ষণ পাওয়াদের চেয়ে তারা অনেকটা এগিয়ে থাকে।
এটি ঠিক একটি সাংগঠনিক শক্তি সুচারুভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ছাত্র রাজনীতি বা শিক্ষক-রাজনীতি নয়, ছাত্রের রাজনীতি ও শিক্ষকের রাজনীতির জন্য বিভিন্ন আদর্শের সংগঠন থাকতেই পারে। তবে তা হতে হবে যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংশ্রবমুক্ত।
প্রচলিত ধারায় সরকারি দলআশ্রিত রাজনৈতিক সংগঠন এতটা হিংস এতটা উন্মত্ত হয় কেন? কারণ এসব দলের ছাত্রদের মাথার ওপর থাকে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশীর্বাদের ছাতা। এভাবে তারা শক্তিমান হয়। অর্থশালী হয়। পরিশেষে অমানবিক বখাটে হয়ে যায়। তাদের দাপটে অসহায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমন এক কাঠামোয় যে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে, একে বহাল রেখে কোনো কল্যাণ হবে না। আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই, ক্যাম্পাসে যদি রাজনৈতিক দলআশ্রিত ছাত্র রাজনীতি না থাকে এবং দলীয় শিক্ষক রাজনীতি বিলুপ্ত হয়, তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই শিক্ষার পঞ্চাশ ভাগ মানোন্নয়ন দেখতে পাব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ পথে হাঁটবেন কিনা।
গত শতকের আশির দশকেও এমন দশা ছিল না। তখন রাজনৈতিক হানাহানি ক্যাম্পাসে যে ছিল না, তেমন নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাম দলগুলো তখনো শক্তিশালী ছিল না অন্য কোথাও। সত্তরের দশকের শেষ দিকে ছাত্রলীগ মুজিববাদী আর জাসদে ভাগ হয়ে অনেক রক্ত ঝরিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তরুণদের হাতে অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে দাপুটে বানিয়েছিলেন। তবুও তাদের মধ্যে সামান্যতম ন্যায়বোধ ছিল। মারামারি লাগলে ভিন্ন আদর্শের হলেও নিজ বিভাগের ছাত্রদের রক্ষায় এগিয়ে আসত। এখন তো ক্ষমতার দাপটে একজন ছাত্রলীগ নেতা বা কর্মী ২ বছরের সিনিয়র ভাইকেও চড় মারতে দ্বিধা করে না। আর অপমানিত সিনিয়র মাথা নিচু করে চলে যান। জানে এর প্রতিবিধান কেউ করবে না। হল প্রশাসনের শিক্ষকরা র্যাগিং বন্ধ করতে পারেন না। টর্চার সেল বা গেস্টরুমে ওদের আদালত থেকে সাধারণ ছাত্রদের রক্ষা করতে পারেন না। উলটো অপমানিত হবেন তাই। এসব অপসংস্কৃতি যদি বন্ধ না হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় তার সৌন্দর্য ফিরে পাবে না।
বিশ্ববিদ্যলয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ যদি দলীয় আনুগত্যের বিচারে না গিয়ে পাণ্ডিত্যের বিচারে করা না হয়, স্খলন চলতেই থাকবে। একজন সুশিক্ষিত, দৃঢ়চেতা, দলনিরপেক্ষ উপাচার্য আপন যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক নেতৃত্ব যেমন দিতে পারেন, তেমনি দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকায়ও সফল হন। নানা তদবিরে আসা দুর্বল উপাচার্যদের দশা তো আমরা দেখছিই। আমার ছাত্রাবস্থায় বিদগ্ধ পণ্ডিত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারের মতো উপাচার্যরা ব্যর্থ হননি। কারও দয়া-দাক্ষিণ্যের পেছনে তাদের ছুটতে হয়নি। এখন প্রতিষ্ঠানটি এমনভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে যে, উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এ সময়ের একজন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে রাজি করানো কঠিন হবে। রাষ্ট্র ও সরকারের ভেতর যদি এমন ভাবনা আসে যে, বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির তপোবন তৈরি করব, তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চিন্তা বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবকিছু নতুনভাবে সাজাতে হবে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com