ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে আর কবে সতর্ক হব?
হাসান মামুন
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এপ্রিলজুড়ে নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সময়টায় আমরা চিন্তিত হয়েছি প্রধানত বোরোর উৎপাদন আর উত্তোলন নিয়ে। সেটাই স্বাভাবিক; কারণ এটা আমাদের প্রধান ফসল। বিশেষ করে আমরা চিন্তিত হয়ে খবর নিয়েছি সেচের। কৃষি বিভাগও বলছিল, জমিতে ধান পেকে না এলে তাপপ্রবাহের মধ্যে অবশ্যই কিছু পানি ধরে রাখতে হবে। খবর আসছিল-যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়াসহ অনেক অঞ্চলে সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে এ সময়টায় অত সেচ অবশ্য দিতে হতো না। সেটা না হওয়াতেই সেচের চাহিদা বেড়েছে। একই সময়ে আবার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে অনেক।
জিকে সেচ প্রকল্প প্রায় অচল বলে আমরা খবর পাচ্ছিলাম আগে থেকেই। এর আওতাধীন অঞ্চলের কৃষকরা কীভাবে কী করছে, তার খোঁজ অবশ্য কমই নেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য সুপেয় পানিও সহজে মিলছে না। যারা সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে অনেক গভীর থেকে পানি তুলতে সক্ষম, তাদের কাছে ভিড় বেড়েছে আশপাশের মানুষের। কারণ চাপকলে পানি মিলছে না। সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না বলে সেচেও সাবমার্সিবল পাম্পের ব্যবহার বেড়েছে বহু এলাকায়। এগুলো সাধারণভাবে কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য নয়। কিন্তু প্রয়োজন তীব্র হয়ে উঠলে প্রশাসনকেও থাকতে হয় চোখ বুঁজে। অনেক স্থানে সাবমার্সিবল পাম্পে উত্তোলন করা পানি কিনে সেচের ব্যবস্থা করছে ছোট কৃষক। এসব পাম্প অবশ্য বিদ্যুৎচালিত। সরাসরি সংযোগ না থাকলে ডিজেল জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তবু এগুলো ব্যবহার করছে মানুষ। এতে সেচ খরচ কতটা কমেছে না বেড়েছে, সে আলোচনা আছে। তবে সারা দেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সেচযন্ত্র ব্যবহারের পর সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও কতখানি নেমে গিয়ে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, সেটাও বিবেচ্য।
প্রধান খাদ্যশস্য চালের জন্য যে মৌসুমের ওপর আমরা বেশি নির্ভর করি, সেই বোরো ফসলটা ব্যাপকভাবে সেচনির্ভর। অন্যান্য মৌসুমেও কম-বেশি সেচ লাগে; তবে বোরোর মতো নয়। এক্ষেত্রে এক কেজি চাল উৎপাদনে যে পরিমাণ পানি ব্যবহৃত হয়, তা জানলে সচেতন মানুষ মাত্রেরই মন খারাপ হবে। আর ভূউপরিস্থ পানির অভাবে সেটা যদি আহরণ করা হয় ভূগর্ভ থেকে এবং ক্রমে আরও তলদেশ থেকে, তাহলে ব্যাপারটা হবে দুশ্চিন্তার। দীর্ঘদিন দেশের বিপুলসংখ্যক কৃষক আবার অতিরিক্ত পানি তুলে জমিকে খাইয়েছে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে। সে কারণেও ভূগর্ভের পানি বেশি করে উত্তোলনের চাহিদা হয়েছে তৈরি। এতে আবার বেশি বিদ্যুৎ ও ডিজেল খরচ হয়েছে; ব্যয়ও বেড়েছে কৃষকের। এখনো এ প্রবণতা নেই, বলা যাবে না। পানির দেশে এর অভাব কখনো হবে না, এরকম ধারণার বশবর্তী হয়েও আমরা পানির এ অপচয় রোধে উদ্যোগী হইনি। ব্যক্তিগত ব্যবহারেও অধিকাংশ লোক পানির নির্মম অপচয় করে থাকে।
ঢাকা ওয়াসা যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করে, তারও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিন্তু ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না। সংস্থাটি এর বিল পায় কিনা, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন-এ পানি উত্তোলিত হয়েছে ভূগর্ভের আরও নীচ থেকে এবং এতে খরচ হয়েছে আরও বেশি। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কত নিচে নেমে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে সময়ে সময়ে প্রকাশিত খবরে আতঙ্কিত হতে হয়। এ অবস্থায় আশপাশের নদীর পানি পরিশোধন করেও সরবরাহ করা হচ্ছে বটে। তবে এর পরিমাণ কম; প্রত্যাশামতো বাড়ছে না এবং এক্ষেত্রে পানি উৎপাদন ও সরবরাহের খরচ আরও বেশি।
খরচ বেশি হলেও ভূউপরিস্থ পানির অধিক ব্যবহারের দিকেই আমাদের যেতে হবে। শুধু আবাসিক খাতে নয়, এমনকি সেচ কাজেও। কারণ আমরা যেভাবে নির্বিচারে পানি তুলে ব্যবহার করছি, তাতে দেশের অনেক অঞ্চলের ভূগর্ভে এবং সামগ্রিকভাবে প্রকৃতিতে একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর আর ঝিরির দেশে ভূউপরিস্থ পানিও গেছে কমে। এক কথায় বললে, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে সুদীর্ঘ সংকট চলাকালে আমরাও স্থানীয় কর্তব্য পালনের বিপরীত আচরণ করেছি। এ অবস্থায় বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যাচ্ছে শোচনীয়ভাবে নেমে। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে এবারকার পরিস্থিতি নাকি বেশি প্রতিকূল। এ সময়ে আবার কিছুটা বৃষ্টিপাত শুরু হলেও চলমান প্রতিকূলতা কতটা কাটিয়ে ওঠা যাবে, বলা কঠিন। তাপপ্রবাহ নতুন করে শুরুর পূর্বাভাসও রয়েছে। আর সাধারণভাবে বৃষ্টিপাত কমে আসার প্রবণতাই বেশি দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলে। তার পরও যেটুকু বৃষ্টির পানি বছরের একটা সময়ে মেলে, তা ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারের বিষয়ে অনেক কথা হলেও কাজ হয়নি বললেই চলে। এরই মধ্যে তিস্তায় জলাধার তৈরির মহাপরিকল্পনায় বিনিয়োগ নিয়ে শুরু হয়েছে কথাবার্তা। এক্ষেত্রে কতদিনে কী হবে বা আদৌ কিছু হবে কিনা, তাতে কিন্তু সংশয় রয়েছে। এসব বড় বড় কাজের আশায় বসে না থেকে সবসময়ই আমাদের উচিত হবে সম্ভব সব ক্ষেত্রে পানির সুপরিকল্পিত ব্যবহারে এগিয়ে আসা।
স্বাধীনতার পর দেশের জনসংখ্যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি। গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্যও পানির চাহিদা বেড়েছে অনেক। আর জমিতে কতবার কত ফসল যে ফলাতে হচ্ছে! সব ফসলে না হলেও অন্তত কিছু ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে আবার যেতে হচ্ছে; যেমন-চাল, শাকসবজি। বোরোর পাশাপাশি গ্রীষ্মে সবজি ফলানোর চাহিদাও বেড়ে উঠেছে। তাতেও বেড়েছে সেচের চাহিদা। এক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। নগর কর্তৃপক্ষগুলোও এমন নির্ভরতার পথেই এগিয়েছে পানি সরবরাহ করতে গিয়ে। আমরা তো শিল্প বিকাশের পথেও এগিয়েছি প্রধানত বেসরকারি খাতকে অবলম্বন করে। এ খাতেও গ্যাস-বিদ্যুতের মতো পানির চাহিদা বেড়েছে লাফিয়ে। শিল্প-কারখানার বিপুল চাহিদা মেটাতে তারা নিজেরা শক্তিশালী পাম্প দিয়ে পানি তুলছে অনেক গভীর থেকে। অর্থনীতিতে শিল্পের ভূমিকা উত্তরোত্তর এত বেড়েছে যে, প্রশাসনও ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বলতে পারেনি, যে অঞ্চলে ইতোমধ্যে পানির স্তর অনেক নিচে চলে গেছে, সেখানে শিল্প গড়া যাবে না। পানির পুনঃব্যবহারেও তাদের বাধ্য করা যায়নি। উপরন্তু এসব কারখানা থেকে নিক্ষিপ্ত তরল বর্জ্যে নদী-নালা দূষিত হয়েছে বেশি করে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে ট্যানারিশিল্প সাভারে স্থানান্তরের পর (বর্জ্য পরিশোধনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থার অভাবে) ওই এলাকার একাধিক নদী দূষণের শিকার হচ্ছে এখন। পরে এসব নদীর পানি পরিশোধন করে সরবরাহ করাটাও হয়ে উঠছে যথারীতি কঠিন। কোনো কোনো অঞ্চলে লবণাক্ততার মতো সমস্যা বেড়ে ওঠায় নগর কর্তৃপক্ষকে কিন্তু বাধ্য হয়েও পার্শ্ববর্তী নদীর পানি পরিশোধন করে গ্রাহকদের জোগাতে হচ্ছে। এমন বিপদের কথা মাথায় রেখেও নদীকে দূষণমুক্ত রাখা প্রয়োজন।
ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে আর্সেনিক সমস্যাও বাড়ছে। এটা তীব্র হয়ে উঠত না বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে প্রাপ্ত পানির পুনঃভরণ বা রিচার্জ হওয়ার ব্যাপারটা সচল থাকলে। অব্যাহত নগরায়ণে সে প্রক্রিয়াও ব্যাহত। কংক্রিটের শহরে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হলেও সে পানি আবার মাটির তলদেশে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে কম আর অনেক ধীরগতিতে। এ অবস্থায় প্রাকৃতিক বনায়ন ব্যাহত হচ্ছে অনেক স্থানে। সবুজায়নও। নদ-নদী মরে যাওয়াতেও ঘটছে এটা। মরুকরণের প্রবণতা বেড়ে উঠছে। এ অবস্থায় কিছু সেচনির্ভর ফসল কম ফলালেও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে ধান-চাল, আলু, পেঁয়াজ ও শাকসবজি পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন করে যেতে হবে। অর্থকরী বলে বিবেচিত কিছু শস্যের উৎপাদনও কমানো যাবে না। এগুলোয় পানির অপচয়মূলক ব্যবহার কেবল রোধ করতে হবে। সেচ কম লাগে, এমন ফসলের জাত উদ্ভাবনেও হতে হবে সবিশেষ মনোযোগী। নানা ব্যর্থতার মধ্যেও আমাদের কৃষি গবেষকরা কিন্তু সাফল্য দেখিয়েছেন। তাদের নব নব উদ্ভাবন মাঠেও নিয়ে যাওয়া গেছে কম সময়ে। এবার যেমন হাওরাঞ্চলে এমন জাতের ধানবীজ বেশ ব্যবহৃত হয়েছে, যা থেকে বৈশাখের ঝড়বৃষ্টি ও বন্যা শুরুর আগেই ফসল তোলা যায়।
সারা দেশে সব ধরনের ভবনে বৃষ্টির সহজলভ্য পানি নিজস্ব জলাধারে ধরে রেখে তার অতিরিক্ত অংশটা আবার ভূগর্ভে চালান করে দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, এদেশেরই অনেক এলাকার মানুষ সুপেয় পানির জন্য রীতিমতো লড়াই করছে। এ সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে খাবার পানির যে ধরনের সংকট মোকাবিলা করতে হয়, তা সহজে পানি পাওয়া লোকজনের পক্ষে কল্পনা করা কঠিন। সেখানেও প্রাকৃতিক সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত আহরণের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উঁচু এসব এলাকায়, এমনকি বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সুব্যবস্থা বেশি করে প্রয়োজন। ফলমূল উৎপাদনে এগিয়ে থাকা এসব অঞ্চল থেকে বৃষ্টিহীন সময়ে গাছে সেচ দিতে না পারার খবরও কম মিলছিল না। আজকাল মাছের চাষও হচ্ছে জমি কেটে তাতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে! মাছ উৎপাদনেও আমাদের ছাড় দেওয়া চলবে না। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, প্রধানত মাছের দাম বেশি বাড়ার কারণে সম্প্রতি ‘খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি’ বেড়েছে উচ্চ হারে। নদীসহ মুক্ত জলাশয়ের মাছও রক্ষা করতে হবে এগুলোকে রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রয়াস নিয়ে। নদীমাতৃক দেশে নদী বাঁচানো না গেলে ভূগর্ভস্থ পানি রেহাই পায় না, এটা প্রমাণিত। উন্নয়নটাও এতে টেকসই হতে পারছে না।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নেমে যাওয়ায় রাজধানীসহ কোনো কোনো অঞ্চল দেবে যাওয়া আর স্বল্পমাত্রার ভূকম্পনেও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা নিশ্চয়ই অহেতুক ভয় দেখাচ্ছেন না।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক