প্রতীকী ছবি
সামাজিক অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা যেন দিনদিন বেড়েই চলছে। পারিবারিক সংঘাত, সংঘর্ষ, গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, স্থানীয় আধিপত্য, রাস্তাঘাটে মারামারি ইত্যাদি নানা ঘটনা আমরা দেখেছি। মানুষ এমনিতেই নানা কারণে বিষাদগ্রস্ত। এসব ঘটনা মানুষকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। সামাজিক এসব অনাচার ও বিশৃঙ্খলার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। ফলে মানুষ সুযোগ পেলে নানাভাবেই সে ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছে।
কোনো সমাজই পুরোপুরি অপরাধমুক্ত নয়। অন্যায়-অপরাধ হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার বিচার করা। সামাজিক এসব অপরাধের বিচার না হলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। ফলে মানুষের মাঝে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও বাড়ে। নিরাপত্তাবোধের সংকট দেখা দেয়। একজন নাগরিক নিজেকে নিরাপদ মনে করতে না পারলে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। এভাবে রাষ্ট্রে ধীরে ধীরে একটি অসুস্থ নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠে। যাদের কাছ থেকে কখনোই স্বাভাবিক আচরণ আশা করা যায় না। সমাজে এখন সে রকম পরিস্থিতিই চলছে।
মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। শুধু শহরে নয়, গ্রামের মানুষের মধ্যেও আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব বাড়ছে। কেউ কারও বাড়ির উঠোন মাড়ান না। ঘরে দরজায় টোকা দেওয়া তো পরের কথা। অথচ একসময় গ্রামে ভোরে ঘরের দরজা খোলা হতো আর রাতে ঘুমানোর আগে তা বন্ধ হতো। এখন সেদিন নেই। আর এ ইটপাথরের শহরে তো দুজন মানুষ বছরের পর বছর একই ভবনে থাকেন অথচ তারা কেউ কাউকে চেনেন না। এভাবে নিজের অজান্তেই আমরা একটি স্বার্থপর, ভয়ের সংস্কৃতির, সংক্ষুব্ধ ও আত্মকেন্দ্রিক নাগরিক সমাজের একেকজন সদস্য হয়ে পড়ছি। এখানে কুশল বিনিময়, চোখে চোখ রেখে ভাব বিনিময় অনেক পরের কথা, সালাম বিনিময়ও হয় না। এটি একটি সামাজিক রূপান্তর। এ রূপান্তর আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে? তবে এমন একটি নাগরিক সমাজ দিয়ে একটি মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব নয়।
নিশ্চিত ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে-এমন আত্মবিশ্বাস খুব কম মানুষেরই আছে। জোর যার মুল্লুক তার-এমন সমাজে বিচারহীনতা থাকে। কদাচিৎ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলেও বিচারহীনতাই এমন সমাজে স্থায়ীভাবেই প্রতিষ্ঠিত।
আমরা জানি, দেশের কয়েকটি জেলায় নিয়মিত দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়। এসব ঘটনায় অনেকে হতাহতও হয়। কিন্তু তারপরও ওসব এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ হয় না। কারণ, দাঙ্গাবাজদের আইনের আওতায় আনা হয় না। যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো, তবে এসব ঘটনা কমে যেত। বিচার না হওয়ায় একের পর এক এসব ঘটনা ঘটতেই থাকে। ওইসব এলাকার স্থানীয় দাঙ্গা যেন আজ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। অথচ একটি সভ্য সমাজে এভাবে বর্শা, বল্লম দিয়ে মারামারি-হানাহানি হতে পারে না। কিন্তু তারপরও হচ্ছে।
পারিবারিক দ্বন্দ্ব খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এর জেরে যেভাবে নারী-পুরুষ-শিশু খুন হচ্ছে, তা সভ্যসমাজে আশা করা যায় না। বীভৎস সেসব ঘটনা। এছাড়া জমি ভাগাভাগি নিয়ে লাঠালাঠি তো এদেশে লেগেই আছে। বাড়ি বা জমির সীমানা নিয়ে বিরোধের জেরে খুনোখুনি যেন স্বাভাবিক বিষয়।
অপরাধের বিচার জরুরি। বিচার না হলে অপরাধের পরিমাণ ও মাত্রা দুই-ই বাড়ে। এখন তা-ই হচ্ছে। সামান্য ঘটনার জেরে শক্তি প্রয়োগ এখন বিরাট বাহাদুরি। সমাজে এখন সবাই বাহাদুর হতে চায়। রাস্তাঘাটে, জনপদে সব জায়গায় সবাই যেন অপরপক্ষের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগে জয়ী হওয়ার প্রতিযোগিতায় রত। ধরুন রাস্তায় চলছেন, গাড়ির সঙ্গে গাড়ির একটু ঘষা লাগল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে যে আগে চড়থাপ্পড় দিতে পারে, সে-ই বাহাদুর। যার আত্মীয় বা বন্ধু বড় ক্ষমতাবান, তার আওয়াজও তত উঁচু। এখানে আমরা সবাই রাজা-তাই কেউ কাউকে পাত্তা দিই না। যেখানে যার লোকবল বেশি, ক্ষমতা বেশি, সেখানে সে-ই জয়ী। আগে মাইর, তারপর কথা। রাস্তাঘাট যেন আজ মাস্তানদের স্বর্গরাজ্য। যে যেখানে পারছে ক্ষমতা দেখাচ্ছে। আবার সে-ই আরেক জায়গায় মার খাচ্ছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এক মহোৎসব চলছে এখানে। কেন এমন হচ্ছে? কেন আমরা দিনকে দিন এমন অশান্ত ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?
সমাজবিজ্ঞানীরা এর নানা কারণ বলছেন। সমাজে বৈষম্য বাড়লে মানুষ নানাভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ বৈষম্য শুধু ধনবৈষম্য হতে হবে এমন নয়। যে কোনো স্থায়ী সামাজিক বৈষম্য ও অনাচার মানুষকে ক্রমাগত অশান্ত ও অসহিষ্ণু করে তোলে। অতিরিক্ত বস্তুবাদী মনোভাব যে কোনোভাবেই হোক না কেন, উপরে ওঠার প্রতিযোগিতায় আমরা লিপ্ত। এ প্রতিযোগিতা আমাদের মানবিকভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সমাজে স্বাধীন মতামত ও মুক্তিবুদ্ধিচর্চার সুযোগ থাকতে হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজেই মুক্তবুদ্ধির চর্চা হতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন গণতান্ত্র নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক উন্নয়ন টেকসই উন্নয়নের পথ রচনা করে। কিন্তু সে পথ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে পরমতসহিষ্ণুতার চর্চাও এখানে আর হয় না। সমাজ ও রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের জায়গা নেই।
সমাজে বেকারত্ব বাড়ছে। কমছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। সুযোগ ও সম্পদের স্বল্পতা আছে। তাই সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা। দুই টাকা বাস ভাড়া কম-বেশি নিয়ে এদেশে খুনোখুনি পর্যন্ত হয়। রিকশা ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডা করতে হয়নি-এমন লোক এদেশে আছে কি? সব রিকশাওয়ালাই মনে করেন, তাদের ঠকানো হচ্ছে, আবার সব যাত্রীই মনে করেন, রিকশা ভাড়া বাড়তি নেওয়া হচ্ছে।
অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে বৈষম্য ও অপ্রাপ্তির শিকার। এ অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনা তাকে ক্ষুব্ধ ও অসহিষ্ণু করে তুলছে। সুযোগ পেলে সে এক জায়গার অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার ক্ষোভ আরেক জায়গায় প্রকাশ করছে। যে কেউ এ ক্ষোভ, প্রতিহিংসা ও হিংস্রতার শিকার হতে পারেন।
এসব থেকে মুক্তির পথ হচ্ছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করা। কিন্তু বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কাঠামো হয়তো বিশ্বাসই করে না। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিকাশ লাভ করে। আমাদের জন্য সে অনুকূল পরিবেশ নেই। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ না হলে সেখানে ক্ষোভ বাড়ে, সেই ক্ষোভ থেকে প্রতিহিংসা, বিবাদ ইত্যাদি। কাজেই সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সেখানে আইনের শাসন থাকবে, ন্যায়বিচার থাকেব, থাকবে পরমতসহিষ্ণুতা। গণতন্ত্রেই তা সম্ভব।
আল্লাহ মানুষকে কিছুটা অস্থির জীব হিসাবেই সৃষ্টি করেছেন। ‘মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অতিশয় অস্থির চিত্তরূপে। যখনই তার ওপর কোনো বিপদ-মুসিবত আসে, তখন সে হা-হুতাশ করে। আর যখন তার কল্যাণ (সচ্ছলতা) ফিরে আসে, তখন সে কার্পণ্য করতে আরম্ভ করে (আল কুরআন, সুরা মায়ারিজ, আয়াত ১৯-২১)। আল্লাহ এ অবস্থা থেকে বাঁচারও উপায় বলে দিয়েছেন। সালাত প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন, জাকাত এবং বেশি বেশি করে দান-সদকা করতে বলেছেন। মূলত যারা তাদের রব ও বিচার দিবসকে ভয় করে, তারা অস্থিরতা প্রদর্শন করে না। তারা মানুষের প্রতি সহনশীল ও সহমর্মী হয়। এটাই আকাঙ্ক্ষিত। সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। অস্থিরতা ও অসহিষ্ণু মনোভাবে কোনো ধর্মই উৎসাহ দেয় না।
সমাজে কিছুটা অনাচার-অবিচার থাকবেই। এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের চলতে হবে। আমরা রাতারাতি সমাজকে বদলে দিতে পারব না। কিন্তু নিজেকে বদলে দেওয়া সম্ভব। সমাজ বদলের এটাই প্রথম ও শেষ উপায়। গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ আমরা চাই। এটা ছাড়া স্বাধীন মতামত ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার আর জায়গা নেই, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করারও উপায় নেই। ফলে এ ক্ষোভ, বৈষম্য, হতাশা ও অস্থিরতা দূর করারও বিকল্প কোনো পথ নেই। এ থেকে পরিত্রাণ জরুরি।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক