Logo
Logo
×

বাতায়ন

ডলার বাজারের খবর আসলে কী

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডলার বাজারের খবর আসলে কী

দেশে ডলারের দাম আর না বেড়ে বরং কমতে শুরু করেছে বলে খবর বেরিয়েছে সম্প্রতি। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন পর অপেক্ষাকৃত কম দামে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) কিনছে। কমে কিনতে পারলে তারা আমদানিকারকদের কাছে কম দামে ডলার বেচতে পারবে। উচ্চশিক্ষাসহ আরও যেসব কাজে ডলার লাগে, সেসব ক্ষেত্রেও গ্রাহকদের তাহলে এখন কম ব্যয় হওয়ার কথা। বিদেশে শিক্ষা গ্রহণে খুব অসুবিধা হচ্ছিল সেখানকার খরচ মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পেতে। বিদেশে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহেও সমস্যা হচ্ছিল নিশ্চয়ই। অনেক কম ডলার বাজারে থাকায় পণ্যসামগ্রী আমদানিকারকদেরও এটা সংগ্রহ করতে হচ্ছিল ব্যাংকের ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দিয়ে। ‘কার্ব মার্কেট’ থেকেও তাদের কিনে আনতে হচ্ছিল ডলার!

এমন একটা প্রায় নজিরবিহীন পরিস্থিতিই মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। এখনো যে একেবারে হচ্ছে না, তা নয়। তবে ডলারের দাম কিছুটা কমে এসে একটা জায়গায় স্থিত হওয়ার প্রবণতা দেখালে সেটা স্বস্তির বলতে হবে। আমদানিকারকরা নাকি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে আগের মতো জটিলতায়ও পড়ছেন না। তাদের একাংশ আবার একইসঙ্গে রপ্তানিকারক। তারা কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি করেন সেগুলো দিয়ে পণ্য বানিয়ে রপ্তানি করতে। তবে কিছু আমদানিকারক আনেন ব্যক্তিগত ভোগে ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রী। সংকট ঘনীভূত হয়ে ওঠায় সাম্প্রতিককালে আলু-পেঁয়াজের মতো পণ্যও আমদানি করতে হচ্ছে। সরকারি সংস্থাগুলো জ্বালানি তেলসহ কিছু জরুরি পণ্য করে আসছে আমদানি। হালে খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি কমাতে কিছু চাল আমদানিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর সবগুলোতেই লাগবে ডলার।

ভারতের মতো বড় বাণিজ্যিক অংশীদারের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার কথা শোনা গিয়েছিল। তবে প্রক্রিয়াটি এগোয়নি। নতুন করে সেটা আর শোনাও যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান সহসা হারাচ্ছে না বলেই মনে হয়। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতে ডলার সরবরাহ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এর মজুত (রিজার্ভ) বাড়ানোর ওপর বরং জোর দেওয়া হচ্ছে। চলমান সংকটে বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সহায়তা জোগাচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংকটকালে আমরা তাদের সহায়তা চেয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলাম। তারাও সহায়তা জোগাতে এগিয়ে এসেছেন অনেকের ‘ধারণা’ ভুল প্রমাণ করে। তবে ঋণ জুগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু লক্ষ্য অর্জনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে সংস্থাটি। এর একটি হলো তাদের হিসাব পদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভ রাখা। সেটি পূরণে বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকেও শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়ার খবর মিলছে। বাংলাদেশের সংকটের স্বরূপ বিবেচনা করে তারা এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কমিয়েও ছিলেন। এখন সেটাও অর্জন করা না গেলে প্রশ্ন উঠতে পারে-ডলার সংকট তাহলে কাটছে কীভাবে?

বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ‘পড়ে থাকা’ ডলার কিনে নেওয়ার একটা প্রক্রিয়ায়ও (সোয়াপ) গিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে স্বল্পমেয়াদে তার রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। মুশকিল হলো, সেটা আইএমএফের হিসাবমতে রিজার্ভের অংশ হবে না। এতে জনমনে এমন ধারণা অবশ্য জোগানো যাচ্ছে যে, রিজার্ভ পরিস্থিতি এখন অপেক্ষাকৃত ভালো আর ব্যাংকগুলোও সংকটে নেই। তারা বরং কিছু ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রেখে বিনিময়ে নগদ টাকা নিয়ে সেটা স্বল্পমেয়াদে হলেও ঋণ হিসাবে ব্যবহার করতে পারছে। ঘরে ঘরে আটকে থাকা ডলারও রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যাংকে নিয়ে আসার উদ্যোগ করা হয়েছে জোরদার। এতে ‘আকর্ষণীয় সুদের ব্যবস্থা’ করা হয়েছে। ক’মাস আগে অনেকে কার্ব মার্কেট থেকেও ডলার কিনে ঘরে জমা করছিলেন বলে শোনা যাচ্ছিল। বিদেশ থেকে বয়ে আনা ডলারও লোকে মুদ্রাবাজারে নিয়ে আসছিলেন না এমন জল্পনা (স্পেকুলেশনস) থেকে যে, দাম আরও বাড়বে। এখন এ কারণেও তারা হাতের মুঠো থেকে ডলার বাজারে ছাড়বেন যে, দাম সম্ভবত আর বাড়বে না। সামনে হয়তো আরও কমবে! ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে কম দামে রেমিট্যান্স কিনছে বলে খবর তাদের আশাহত করবে বৈকি।

মাঝে ব্যাংকিং চ্যানেলে অধিক রেমিট্যান্স আসা নিশ্চিত করতে সরকারি প্রণোদনার বাইরেও ব্যাংক সমপরিমাণ অর্থ দিতে পারবে বলে জানানো হয়েছিল। তাতেও রেমিট্যান্স আশানুরূপভাবে বাড়েনি। প্রবাসীদের পরিবারগুলোয় যথারীতি অর্থ আসছিল হুন্ডিতে। এখনো কমবেশি ৫০ শতাংশ প্রবাসী আয় হুন্ডিতে হস্তান্তর হচ্ছে। এটা রোধের কোনো চেষ্টাই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তবে বছরের শুরুতে দু’মাস ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসায় ঊর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছিল। এটা সাম্প্রতিককালে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধির বড় কারণ। রপ্তানি আয়েও বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে, যদিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। বিদেশি বিনিয়োগ যখন বাড়ছে না বললেই চলে এবং বড় কিছু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিদেশি ঋণ ছাড়ের খবর কম, তখন রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কম হারে বাড়লেও সেটা উৎসাহব্যঞ্জক। তবে ঈদের আগ দিয়ে অর্থাৎ মার্চে আবার রেমিট্যান্স গেছে কিছুটা কমে। বরাবরের প্রবণতা দেখে বিশ্লেষকরা বরং বলছিলেন, মার্চে এটা আরও বাড়বে।

দেশে ডলারের দাম কমে আসার প্রবণতায় কি তাহলে রেমিট্যান্স পাঠাতে নতুন করে নিরুৎসাহিত হলেন প্রবাসীরা? নাকি হাতে করে বেশি ডলার নিয়ে আসছেন? নাকি হুন্ডিতে অর্থ পাঠাতে তারা নতুন করে উৎসাহিত? ব্যাংকের তুলনায় এখনো কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি অর্থ মিলছে হুন্ডিতে। বিদেশে ও দেশে এ কাজে নিয়োজিতরা অনেক বেশি সংগঠিতও বটে। চাহিদামাফিক আগেভাগেও তারা অর্থ পৌঁছে দেন প্রাপকের হাতে। এদের সঙ্গে লড়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়িয়ে তোলা কঠিন। এ অবস্থায় প্রবাসীদের হাতে হাতে আসা ডলারগুলো বাজারে এলেও সরবরাহ কিছুটা বাড়ে। কুরবানির ঈদেরও বেশি বাকি নেই। তখন আরেকবার রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আশাবাদ রয়েছে। বেশি রেমিট্যান্স আসার প্রেক্ষাপটটিও তৈরি হতে হবে। রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও আমদানির মতো ক্ষেত্রে ডলারের বিভিন্ন দাম এবং এর ফারাক যথেষ্ট কমিয়ে আনাটাই এখন সবচেয়ে বড় করণীয়। হুন্ডিতে অনেক বেশি অর্থ পেলে কেউ মুখের কথায় বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠাবেন না।

পরে বেশি অর্থ পাওয়ার আশায় রপ্তানিকারকরাও আয়ের একটা অংশ বিদেশে রেখে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি করে অর্থ পাচারের অভিযোগও জোরালো। দেশীয় মুদ্রা তো নয়; ডলারই পাচার হয়ে থাকে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ অব্যাহতভাবে পাচারের কারণেও ডলার সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে বলে অনেকের মত। বেশি দাম পাওয়ার আশায় পাচারকৃত অর্থ আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলেও শোনা যায়। এভাবেও কিছু ডলার এসে থাকলে সেটা এর বাজার শান্ত হয়ে আসার জন্য ভালো। রিজার্ভ নির্দিষ্ট স্তরে রাখতে না পারলেও সার্বিক বিবেচনায় আইএমএফ হয়তো তার কিস্তি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করবে না। ঋণদান অব্যাহত রাখতে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য সেটা আবার হয়ে থাকবে ‘গ্রিন সিগন্যাল’। তা সত্ত্বেও অন্যরা আইএমএফের মতো দ্রুতগতিতে ঋণ ছাড় করবে বলে মনে হয় না। এদিকে সরকারকে আবার মূলত মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে নেওয়া ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি করে। দেশে কর্মরত কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিলও শোধ করতে হচ্ছে ডলারে। এসব চুক্তি নিয়েও কম কথা উঠছে না। সরকারকে আগ্রাসীভাবে ঋণ করে ইতঃপূর্বে নেওয়া বিদেশি ঋণ শোধ করতে হচ্ছে বলেও খবর রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ করা গেলেও তা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার নিয়ে এসব ঋণ শোধ করা যেত।

সরকারের সুবিধা রয়েছে রিজার্ভ থেকে নির্ধারিত দামে ডলার সংগ্রহের। সার, ডিজেল ইত্যাদি আমদানির সময়ও সরকার এ সুবিধা পেয়ে থাকে; বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যা পায় না। এলসি নিষ্পত্তির সময় ডলারের জন্য তাদের বর্ধিত দাম দিতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ছোট ব্যবসায়ীরা তীব্র ডলার সংকটে ব্যাংকের ‘বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার’ হয়েছেন বলেও অভিযোগ কম নেই। বেশিরভাগ ব্যাংকে এখন ডলার সরবরাহ বাড়লে স্বভাবতই এসব অভিযোগ কমে আসবে। তৈরি হবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। ব্যবসায়ও এটা থাকা জরুরি। সর্বস্তরের ব্যবসায়ী শান্ত হয়ে আসা বাজার থেকে স্বাভাবিক দামে ডলার কিনতে পারলে তারা ব্যবসার পরিকল্পনাও করতে পারবেন। মূল্যস্ফীতিতেও এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। আমরা তো জানি, বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমে এলেও ডলারের দাম অস্থিতিশীল বলে স্থানীয় বাজারে এর সুফল মেলেনি বললেই চলে।

সুদের হার বাড়তে থাকায় বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি সুযোগ পেলেই দ্রুত সেটা পরিশোধ করে দেওয়ার কারণেও মাঝে ডলার সংকট বেড়েছিল। বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ সহসা বাড়বে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় স্থানীয় উৎসগুলো থেকে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দ্রুত রপ্তানি আয় বাড়াতে সক্ষম খাত-উপখাতগুলো চাঙ্গা করা গেলে ডলার সরবরাহ বাড়বে। বিদেশে কর্মী প্রেরণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও রেমিট্যান্সে এর প্রতিফলন না থাকাটা অবশ্য দুর্ভাগ্যজনক। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ যেভাবে হোক, বাড়াতে হবে। প্রতিশ্রুত ঋণ ছাড়ে অগ্রগতি এ মুহূর্তে ডলার সরবরাহ বাড়াতে বিশেষ সহায়ক হতো। এ অবস্থায় রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ‘আমদানি নিয়ন্ত্রণ’ আরও কতদিন অব্যাহত রাখা হবে, সেটা এক গুরুতর প্রশ্ন। কারণ এতে আমাদের আমদানিনির্ভর অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়ছে। প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া আর কর্মসংস্থানের নিম্নগতিও হয়ে উঠছে নিয়তি।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম