Logo
Logo
×

বাতায়ন

‘বয়কট ইন্ডিয়া’ প্রচারণার নেপথ্যে

Icon

তাপস হালদার

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘বয়কট ইন্ডিয়া’ প্রচারণার নেপথ্যে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ইন্ডিয়া আউট’ এবং ‘বয়কট ইন্ডিয়া প্রোডাক্টস’ দুটি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বিদেশে বসে একশ্রেণির অনলাইন গুজব সৃষ্টিকারী ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। যদিও তারা বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইস্যু সৃষ্টি করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের গুজবের ফলাফল শূন্য হয়।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। তারপরই সুপরিকল্পিতভাবে এ প্রচারণা শুরু হয়। তাদের ধারণা, পশ্চিমা বিশ্ব এত বিরোধিতা করার পরও ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে সরকার নির্বাচন করতে সমর্থ হয়েছে। এখন ভারতের বিরুদ্ধে জনগণকে যদি খেপিয়ে তোলা যায়, তাহলে সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হবে। কয়েক মাস আগে মালদ্বীপের ‘ভারত বয়কট’ থেকে এদেশের একশ্রেণির মানুষ ভারতবিরোধিতার দিবাস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না বাংলাদেশ আর মালদ্বীপের পরিস্থিতি এক নয়।

ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইনস্ট্রাগ্রাম ও ইউটিউবে যারা প্রচারণা চালাচ্ছে, সেসব ব্যক্তি দেশের মানুষের কাছে গুজব সৃষ্টিকারী হিসাবে চিহ্নিত। তাদের কাজই হলো গুজব রটানো। এদের অপপ্রচারে আমোদপ্রিয় একশ্রেণির মানুষ বিনোদনের খোরাক পায়, কিন্তু তাদের কথা কেউ আর বিশ্বাস করে না।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত স্পষ্টই বলেছে, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাদের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন নির্বাচন নিয়ে সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে, ঠিক তখন ভারত সংবিধানের আলোকে সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।

বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা নতুন নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ভারতবিরোধিতা চলে আসছে। কোনো কোনো পক্ষ ভারত জুজুর ভয় দেখিয়ে বারবার বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কিন্তু এখন অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে মানুষকে ভুল বোঝানোর সুযোগ নেই। আগে বলা হতো, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে, মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, বাংলাদেশ সার্বভৌমত্ব বলে কিছু থাকবে না, বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে ইত্যাদি। মানুষ বুঝতে পারছে, এগুলো ছিল মিথ্যাচারের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ বিগত পনেরো বছরে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করে ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছে। গঙ্গার পানি চুক্তি, ছিটমহল, সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির মতো জটিল বিষয়গুলোর সমাধান হয়েছে।

বাংলাদেশ ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে আড়াইগুণ এবং আমদানিও বেড়েছে তিনগুণ। বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ১৯ শতাংশ ভারত থেকে আসে। ভারত হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানির উৎস। প্রথম স্থানে চীন থাকলেও সেখান থেকে ইলেকট্রনিকস, আসবাবপত্র, কেমিক্যাল, যন্ত্রপাতি আমদানি হয়, যা কোনোটাই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য নয়। ভারত থেকে আমদানির শীর্ষ রয়েছে তুলা, যা মোট আমদানির এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন গার্মেন্টসের কাঁচামাল তুলার অধিকাংশই আসে ভারত থেকে। এরপরই আসে খাদ্যপণ্য চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ভোজ্যতেল, চিনি, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার। এছাড়াও আসে রেলের বগি, ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে অন্যতম হলো পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চামড়া, তৈরি পোশাক, মাছ, এসি-ফ্রিজ, সাবান, ব্যাটারি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। যখন বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই ভারত থেকে দ্রুত আমদানি করে বাজার স্থিতিশীল করা হয়। সম্প্রতি ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ রেখেছিল। এই সুযোগে রমজান ও ঈদ সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের অনুরোধে পঞ্চাশ হাজার টন পেঁয়াজ রপ্তানি করে ভারত। চাল কিংবা ডিম যখন প্রয়োজন হয়, তখন বাংলাদেশে রপ্তানি করে। এক্ষেত্রে ভারতের রপ্তানিনীতি প্রযোজ্য হয় না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব প্রচারণায় দু-দেশের সম্পর্কে কি প্রভাব পড়তে পারে? এককথায় এর উত্তর হলো, না। কারণ ভারতবিরোধী অপপ্রচার এদেশে নতুন নয়। এরা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বারবার ভারতের বিরোধিতা করেছে।

বিশ্বায়নের যুগে একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। আবার সেটি যদি হয় বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ, তাহলে তো আর কোনো প্রশ্নই নেই। দ্বিপাক্ষিক আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধিতে দুই দেশের সরকারের যৌথ উদ্যোগে বাণিজ্য চুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌচলাাল রুট সম্পর্কিত প্রটোকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, কানেক্টিভিটি, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন, স্থল ও সমুদ্রসীমার বিরোধ নিরসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা ইত্যাদি বিভিন্ন ইস্যুতে দু’দেশের মধ্যে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। ভারতের সঙ্গে সরাসরি যাত্রী ও মালামাল পরিবহণে জল, স্থল, আকাশ পথকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বেশ কয়েকটি নতুন পথ চালু হয়েছে। ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলা বন্দর থেকে আখাউড়া-আগরতলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলা বন্দর থেকে বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর এই রুটগুলো চালু হয়েছে। এককথায়, বাণিজ্যের নতুন দ্বার খুলে গেছে।

বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভারত ভ্রমণ করে। গত বছর ১৬ লাখ বাংলাদেশিকে ভারতীয় ভিসা দেওয়া হয়েছে, যার অধিকাংশই মেডিকেল ভিসা। ভালো ও সাশ্রয়ী চিকিৎসার জন্য মধ্যবিত্তের কাছে ভারতের চেন্নাই, হায়দরাবাদ, দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে দু’দেশই লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন, অন্যদিকে ভারতের অর্থনীতিতে রাজস্ব যোগ হচ্ছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ভারত সফরকালে দিল্লিতে ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব অব সাউথ এশিয়ায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ভারতবিরোধী একটা অংশ তো আছে। নির্বাচন এলেই তারা ভারতবিরোধী মনোভাব একটি অংশের মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে চায়। কিন্তু ভারতবিরোধী মনোভাব ক্রমশ কমে আসছে। একটা বিরাটসংখ্যক মানুষ বোঝেন যে, বাংলাদেশের উন্নতির জন্য ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা উচিত। পুরো অঞ্চলের উন্নতির জন্যই প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা উচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সেটাই বিশ্বাস করে।’ অন্যদিকে এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘এসব অনলাইন প্রচারণা বিশ্বাস করতে নেই।’ দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এসব প্রচারণা আমলে নেওয়া হচ্ছে না, যা যথার্থই সঠিক। এ বিষয়ে জাপানের বিখ্যাত পত্রিকা নিক্কেই এশিয়ার গবেষণা মতে, ‘ভারত বয়কট’ বিষয়টি অনলাইনে প্রচুর প্রচারণা চললেও বাস্তবে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে সম্পর্ক শীতল হলেও যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখনই সম্পর্ক ভালো হতে থাকে। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বহুমাত্রিক পথ পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সময়কালে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের গভীরতা দিনদিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশ যেমন বলছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ, ভারতের পক্ষ থেকেও বারবার বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক একটা মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে, যা ঠুনকো প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে বিনষ্ট করা যাবে না।

তাপস হালদার : সাবেক ছাত্রনেতা ও কলামিস্ট

haldertapas80@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম