Logo
Logo
×

বাতায়ন

এখন বরইয়ের দামও তো বেড়ে যাবে!

Icon

এরশাদুল আলম প্রিন্স

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এখন বরইয়ের দামও তো বেড়ে যাবে!

দোরগোড়ায় রমজান। চারদিকে রোজার নানা প্রস্তুতি। এক সময় রোজার আগে আমাদের মা-বোনরা ঘরবাড়ি ঝাড়ামোছা করত। জায়নামাজ, পোশাকাদি, বিছানার চাদর ইত্যাদি ধুয়ে-মুছে রোজার প্রস্তুতি নিত। সেহরি-ইফতার নিয়ে কখনোই তাদের বিশেষ প্রস্তুতি ছিল না। কারণ, সে সামর্থ্যই ছিল না। আমি গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। ছোলা-মুড়ি আর কদাচিৎ গুড়ের শরবত দিয়ে ইফতার করতাম। ইফতারে খেজুরের দেখা খুব কমই পেতাম। পেলেও বাজারের সবচেয়ে নিম্নমানের খেজুর হয়তো কখনো কখনো জুটত। গ্রাম বা শহরের সেই নিম্নবিত্তদের ইফতার আজও আগের মতোই আছে। সমাজের একটি শ্রেণির ধনৈশ্বর্য বেড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু গরিব আরও গরিব হয়েছে। ফলে গরিবের ইফতারে আজও খেজুর জোটে না। উপরন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে এবার খেজুরের বদলে তাদের বরই ধরিয়ে দেওয়া হলো।

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন আঙুর, খেজুরের পরিবর্তে বরই, পেয়ারা দিয়ে ইফতার করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আপেল লাগে কেন? আঙুর লাগে কেন? আর কিছু নেই আমাদের? ইফতারে বরই খান, পেয়ারা খান, আমাদের যা আছে সেগুলো ব্যবহার করুন। ইফতারের প্লেট সেভাবে সাজান।

সরলভাবে দেখলে এ কথাগুলোর মাঝে ভুল নেই। খেজুরের পরিবর্তে দেশি ফল দিয়ে ইফতার করার পরামর্শ দিয়েছেন, এতে ভুল কোথায়? কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, মানুষের যদি সামর্থ্য না থাকে, তবে খেজুরের পরিবর্তে বরই না হোক, অন্য কিছু খাবে। কিছুই না পারলে না খাবে। মানুষ তার সক্ষমতা অনুযায়ী খাবার জোগাড় করে; না পারলে না খেয়ে থাকে এটাই স্বাভাবিক।

দরিদ্র রোজাদাররা পানি বা এক মুঠ ডাল-ভাত দিয়ে সেহরি-ইফতার করে। ছোলা-মুড়ি পেলে খায়, না পেলে না খায়। খেজুরের যে দাম, তাতে দেশের অধিকাংশ মানুষ এমনিতেই ইফতারে খেজুর খেতে পারে না। সেখানে খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ না দিলেও হতো। সামর্থ্য না থাকলে মানুষ নিজেই তার বিকল্প বের করে নেয়। সরকারের মন্ত্রী বা দায়িত্বশীলদের মুখে এজাতীয় কথা তাই বেমানান। যদিও এজাতীয় কথা মন্ত্রী-এমপিদের মুখে এই প্রথম নয়। এর আগের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী বেগুনের বদলে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে বেগুনি বানাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, গোশতের বদলে পরামর্শ দিয়েছিলেন কাঁঠাল খাওয়ার। প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, উন্নত বিশ্বের মানুষ মাংস কম খায়। মাংসের বদলে তারা কাঁঠালের কাবাব বা কাঁঠালের বার্গার খায়। আমরাও উন্নত জাতি, তাই আমাদেরও উচিত কাঁঠালের কাবাব বা বার্গার খাওয়া। এছাড়া তিনি কাঁচামরিচ শুকিয়ে রাখা, ডিম সিদ্ধ করে ফ্রিজে রাখার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শও দিয়েছিলেন। জনগণ সাদরে প্রধানমন্ত্রীর সেসব অভিনব ও মজাদার খাবারগুলো গ্রহণ করেছে! এ পরামর্শগুলো আরও আগে পেলে জনগণ হয়তো আরও বেশি উপকৃত হতো।

শিল্পমন্ত্রী হয়তো প্রধানমন্ত্রী থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু শিল্পমন্ত্রী শুধু খেজুর না খাওয়ার পরামর্শটুকু দিলেই ভালো করতেন। খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি খেজুরের সঙ্গে সঙ্গে বরইয়ের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন। কদিন পর খেজুরের দাম দিয়েই যদি আমাদের বরই কিনতে হয়, তখন জনগণ কী খাবে? আমরা জনগণ না পারলে না খাব। দোহাই, আমাদের আর নতুন কিছু খাওয়ার বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়ার দরকার নেই।

মানুষ সহজাতভাবেই বিকল্প খোঁজে। বেঁচে থাকার তাগিদেই সে তা করে। এখানে পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই। সামর্থ্যবানদের বিরিয়ানি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার যেমন প্রয়োজন নেই, আবার গরিবকে পান্তাভাত-মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত খাওয়ার ছবকও দেওয়ারও কিছু নেই। এ সবই নিদারুণ রসিকতা। চরমতম দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক।

চৌকিদার রাতভর ঘুমিয়ে থেকে গৃহস্থকে সজাগ থেকে বাড়ি পাহারা দিতে বলা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কী? এদেশে এখন সেটাই চলছে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, শিল্পমন্ত্রী শিল্পোন্নয়নের কাজ করবেন না, খাদ্যমন্ত্রী গম চুরির দায় নেবেন না-অথচ তারা সবাই উলটো জনগণকেই বিকল্প বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেবেন। এসব জনগণের সঙ্গে উপহাস করার শামিল ও নিজ দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ। নিজের দায়িত্বের প্রতি কতটা উদাসীন থাকলে এমন সব মন্তব্য করা যায় সেটিই ভাবনার বিষয়। এর আগের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না। সিন্ডিকেটের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটা স্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি মন্ত্রীকে (তার এ মন্তব্যের জন্য) ধরবেন এবং যথারীতি সে মন্ত্রী ধরাও খেয়েছেন। এ যাত্রায় এখনো তিনি মন্ত্রী হতে পারেননি।

এর আগে সরকার কয়েকটি নিত্যপণ্যের মূল্য বেঁধে দিয়েছিল। ডিমের দাম বেঁধে দিয়েছিল ১২ টাকা। কিন্তু সে দাম ১২ টাকায় থেমে থাকেনি। বেড়েছে, কমেছে। বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে না। সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্য আইন আছে। প্রতিযোগিতা আইনই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সরকারকে শুধু পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার জনগণের ওপর কঠোর না হয়ে, তাদের নিত্যনতুন বিকল্প খাবারের পরামর্শ না দিয়ে যদি বাজার নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী হতো, তবে কাজ হতো। কাজটি সহজ না, জানি। সিন্ডিকেটের হাত অনেক লম্বা সে-ও জানি। এর লাভ-লোকসানের অংশীদাররা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়েও যে নেই, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু, তার পরও সরকার চাইলে, আন্তরিক হলে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু সেসব বিষয়ে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। ক’দিন পরপর একেক মন্ত্রী একেক পদ ও বিকল্প খাবার নিয়ে হাজির হন। এ কেমন রসিকতা!

গত কয়েক বছর করোনা অতিমারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথা বলে আমাদের অনেক পকেট কাটা হয়েছে। এখনো তা চলছে। অনেকে তো বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের সব খরচ বুঝি আমরাই জুগিয়েছি। পরিসংখ্যান বলছে, খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১২.৫৪ শতাংশ আর মজুরি বৃদ্ধির হার মাত্র ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এ অবস্থায় সমাজের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের অবস্থা শোচনীয়। তার ওপর বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। একদিকে দেশের একটি শ্রেণি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, টাকার পাহাড় গড়েছেন; আরেকদিকে মধ্যবিত্ত হয়েছে নিম্নবিত্ত আর নিম্নবিত্তরা হয়েছে প্রান্তিক। তারপরও আমরা চলছি। জীবনতো চলবেই। উপহাসটুকু একটু গায়ে লাগে, এই যা!

এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী ও কলাম লেখক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম