Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বাধীনতার মূল চেতনায় ফিরতে হবে

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীনতার মূল চেতনায় ফিরতে হবে

দুই সপ্তাহ পরেই মহান স্বাধীনতা দিবস। গত ৫৩ বছর ধরে আমরা প্রতিবছরই এ দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করে আসছি। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হবে না। বিশেষ দিনগুলো কেবল আনুষ্ঠানিকতার জন্য উদযাপিত হয় না, বরং যে লক্ষ্য সামনে রেখে দিবসটির জন্ম তার একটি বছরওয়ারি খতিয়ান বিবেচনা করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্য অর্জনে যদি কোনো ঘাটতি থাকে তবে তা পূরণের অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা থাকা বাঞ্ছনীয়। স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশক পরে এসে আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে দু’ধরনের মূল্যায়ন চোখে পড়ে। প্রথমটি হলো যারা পাকিস্তানের অনিবার্য পতনকে আজও মেনে নিতে পারেননি তাদের। তাদের মতে, আমাদের দেশ এখনো পাকিস্তান থাকলে মঙ্গল হতো। দ্বিতীয় মূল্যায়নটি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির। তাদের মত হলো, স্বাধীনতার সনদে উল্লেখ করা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা আজও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। এ দুটি মূল্যায়নের যথার্থতা যাচাই করার একটি প্রয়াস নেওয়া যেতেই পারে। তবে এ কাজে সাবেক ইউজিসি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলামের প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধের সহযোগিতা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

প্রথম মূল্যায়নটি, যেখানে বলা হয়ে থাকে, আমরা পাকিস্তান থাকলেই ভালো থাকতাম, যারা এমন মূল্যায়ন করেন, পাকিস্তানের প্রতি রয়েছে তাদের অন্ধ আনুগত্য। এ ধরনের মূল্যায়নে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে যে সীমাহীন শোষণ, লুণ্ঠন ও রাজনৈতিক নিপীড়ন চালানো হয়েছিল, তা অবলীলায় অস্বীকার করা হয়। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা জননির্ভর না হয়ে সামরিকনির্ভর হয়ে পড়ে। গত ৭৫ বছর ধরে পাকিস্তানের কোনো সরকার জাতীয় বাজেটে সামরিক খাতের আধিপত্য খর্ব করার সাহস রাখেনি, আজও রাখে না। ২০২৪ সালে এসেও পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছাড়া কোনো সরকার গঠন ও পরিচালনা কল্পনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক হতাশা বিরাজ করলেও সামরিকতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা আজও পাকিস্তানকে বাংলাদেশের তুলনায় অধিকতর স্বস্তিদায়ক মনে করেন, তারা কোনো সূচক ব্যবহার করেন না বা সূচকের প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি এড়িয়ে যান এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনামূলক এমন কতগুলো সূচক আছে, যা থেকে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান আজ আর তুলনা করার মতো রাষ্ট্র নয়। সূচকগুলো হলো-এক. বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের জিডিপি ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের চেয়ে ১১৯ বিলিয়ন ডলার কম। দুই. পাকিস্তানের মোট জিডিপি আমাদের চেয়ে কম, জনসংখ্যা বেশি। সেখানে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ১ শতাংশ, আর বাংলাদেশে এই হার ১ দশমিক ২ শতাংশ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা বর্তমানে ২২ কোটি, আর বাংলাদেশে ১৭ কোটি। অথচ ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ কোটি, আর সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটিরও বেশি। তিন. মাথাপিছু আয়কে সামনে আনা যাক। ২০২২ সালের জুনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২৬৮৮ ডলার, পাকিস্তানের ছিল ১৫৪৭ ডলার। তবে ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কিছুটা কমে ২৬২২ ডলার হয়েছিল, তখন পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় কমে ১৪৭৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। চার. রপ্তানি আয়ের পার্থক্যটাও লক্ষ্যণীয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সরকারের ও আইএমএফের হিসাবে গরমিল আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে সরকারি হিসাবমতে, কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলারে; কিন্তু আইএমএফ বলছে, সঠিক হিসাব হলো, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। ২০২৪ সালে এ রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন ডলার। আমরা যদি সর্বনিম্ন হিসাবটিও ধরি, তাহলেও তা দিয়ে তিন মাসেরও বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অন্যদিকে একই সময়ে পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৯ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে দেশটি ৫ সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারে। ছয়. বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ, আর পাকিস্তানের বেলায় তা জিডিপির প্রায় ৪৭ শতাংশ। সাত. নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। বাড়ির আঙিনার বাইরে গিয়ে কর্মরত নারীর অনুপাত পাকিস্তানে ১৪ শতাংশের বেশি নয়, অথচ বাংলাদেশের বেলায় এ হার ৩৬ শতাংশেরও বেশি। আট. আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১ জন, অন্যদিকে পাকিস্তানে বর্তমানে তা হাজারে ৫৯ জন। নয়. বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু যেখানে ৭৩ বছর, পাকিস্তানের বেলায় তা মাত্র ৬৬ বছর। দশ. বাংলাদেশে শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে রয়েছে। এগারো. স্থানীয় মুদ্রার কথায় আসি। ২০০৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রুপির মূল্যমান বাংলাদেশের টাকার চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি ছিল। ২০২৪ সালে এসে বাংলাদেশের বাজারে ১১৪ টাকায় ১ ডলার কেনা যায়, কিন্তু পাকিস্তানে ১ ডলার কিনতে হলে ২৭৭ রুপি খরচ করতে হয়। বারো. বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার হচ্ছে ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের বেলায় তা মাত্র ৫৯ শতাংশ। তেরো. জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। ২০২২ সালের মানব উন্নয়ন সূচকে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৯, আর পাকিস্তানের ১৪৭। এসব সূচক বিচেনায় নিয়ে স্পষ্টভাবেই বলা চলে, আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো তুলনা চলে না। বাংলাদেশের তুলনা হতে পারে সফল কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে। সুতরাং, মূল্যায়নকারীদের প্রথম অংশের বিচার-বিশ্লেষণ প্রমাণসাপেক্ষ নয়। নেহায়েতই পাকিস্তানপ্রীতি থেকে মূল্যায়ন-মন্তব্যটি করা হয়ে থাকে।

এবারে আসা যাক স্বাধীনতার পক্ষশক্তির মূল্যায়ন প্রসঙ্গে। এ অংশের বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা হচ্ছে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অনন্য প্রাপ্তি। পৃথিবীর বুকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য স্বাধীনতা ছিল অপরিহার্য শর্ত। তবে একই সঙ্গে স্বীকার করতে হবে, স্বাধীনতা সনদের যে মূলনীতি-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক ন্যায়বিচার, এ তিনটি নীতির প্রতি আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সুবিচার করতে পারিনি। এ মূল্যায়নটি আমলে নেওয়ার দাবি রাখে। রাজনীতি ও অর্থনীতিকে আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী পরিচালিত করতে পারলে, আমরা আরও বেশি সমৃদ্ধ হতে পারতাম। স্বাধীনতার প্রথম দুই দশক আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলা দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে। ’৯০-পরবর্তী সময়ে নির্বাচনমুখী রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা সন্তোষজনক পর্যায়ে ফিরে আসে। কিন্তু ২০১৪ সালের পর দেশের জাতীয় নির্বাচনগুলো বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রাজনীতির বেলায় আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছাতে পারিনি। অন্যদিকে, অর্থনীতিতে যদি দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং পুঁজি পাচার বন্ধ করতে পারতাম, তাহলে আজকের বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে অনন্য উদাহরণ হতে পারত। সরকারি ভাষ্যমতেই আমাদের অর্থনীতিতে যে পরিমাণ কালো টাকা আছে, তা জিডিপির ৩৩ শতাংশের সমান। কিন্তু তার সুরাহা করতে পারছি না আমরা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রেটি সারা বিশ্বের অবৈধ অর্থপ্রবাহ, দুর্নীতি, অবৈধ বাণিজ্য ও অর্থ পাচার নিয়ে গবেষণা করে। তাদের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ থেকে ১০ বছরে পাচার হয়েছে ৭ হাজার কোটি ডলার। তার মানে হলো, অর্থ পাচারের পরিমাণ গড়ে বছরে ৭০০ কোটি ডলার। যদি ১ ডলার সমান ১১৪ টাকা ধরা হয়, তাহলে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা; অথচ আমরা যে পদ্মা সেতু নিয়ে গর্ব করি, সেই পদ্মা সেতু নির্মাণে ৭ বছরে মোট ব্যয় করা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে পদ্মা সেতু নির্মাণে আমরা প্রতিবছর গড়ে মাত্র ৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছি। আমরা এ সমস্যারও কিনারা করতে পারছি না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। কয়েক হাজার টাকার ঋণখেলাপির দায়ে কৃষককে কোমরে দড়ি বেঁধে আইনের দরজায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রশ্ন হলো-বিপুল অঙ্কের অর্থ যাদের কাছে আটকে আছে, তেমন ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কতটা কঠোর হচ্ছে?

দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। একদিকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত দরিদ্র হচ্ছে, বিপরীতভাবে দিন দিন ধনীরা পরিণত হচ্ছে সুপার ধনীতে। প্রচারিত ও প্রকাশিত প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির কোনো সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। তাই মনে হয়, আমরা সাম্যের প্রতিশ্রুতি থেকে দিনকে দিন বিচ্যুত হচ্ছি। আজ ৫৪তম স্বাধীনতা দিবসে এসে বলতেই হবে, আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে আওয়ামী লীগের একটি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি আজকের শাসক আওয়ামী লীগের রয়েছে শাসনজনিত দুর্বলতা। এ নিয়ে দুটি ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথম ধারায় একদল মানুষ আওয়ামী লীগের সমালোচনা ও বিরোধিতা করতে করতে এক পর্যায়ে স্বাধীনতারই বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। অন্য ধারাটি আওয়ামী লীগের অসহিষ্ণুতা থেকে সৃষ্ট। সেটি হলো, আওয়ামী লীগের কোনো কাজের যৌক্তিক ও আবশ্যিক সমালোচনাকারীকে শাসকগোষ্ঠী নির্বিচারে স্বাধীনতাবিরোধীর তকমা লাগিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত এ দুটি ধারাই বর্জনীয় ও নিন্দনীয়। স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখে সব শহিদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে শাসকদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনারা স্বাধীনতা যুদ্ধে আÍদানকারী শহিদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অধিকতর মনোযোগী হোন।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম