স্বদেশ ভাবনা
ফ্রিডম হাউজ সূচকে কেন আমাদের উন্নতি নেই
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রিডম হাউজ’ সম্প্রতি তাদের ‘Freedom in the World 2024’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালে রাজনৈতিক অধিকারচর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতায় ১৯৫টি দেশ ও ১৫টি অঞ্চলের পরিস্থিতি ফ্রিডম হাউজের এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটির প্রধান ফাইন্ডিংস পর্যালোচনা করা এবং সূচকে বাংলাদেশের কেন উন্নতি হচ্ছে না, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
প্রতিবেদনের প্রধান ফাইন্ডিংস হলো-ক. ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা ১৮ বছর ধরে বৈশ্বিক স্বাধীনতা নিম্নমুখী। এ বছর ৫২টি দেশে রাজনৈতিক অধিকারচর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতা কমেছে। বিপরীতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে মাত্র ২১টি দেশে। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ও সশস্ত্র সংঘাত মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করছে, বিপদের মুখে ফেলছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা ১৮ বছর ধরে বৈশ্বিক স্বাধীনতা নিম্নমুখী। এ বছর ৫২টি দেশে রাজনৈতিক অধিকারচর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতা কমেছে। বিপরীতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে মাত্র ২১টি দেশে। খ. সংঘাত ও স্বার্থপরতাসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যাপক সমস্যা মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব করেছে। গ. সশস্ত্র সংঘাত এবং কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসনের হুমকি বিশ্বকে কম নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক করে তুলেছে। কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসন দ্বারা পরিচালিত তুমুল সংঘর্ষ বিশ্বের অনেক স্থানে মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে এনেছে এবং গণতন্ত্রকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে। ঘ. বিশ্বের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোতে (disputed territories) মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতায় অস্বীকৃতি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় (associated countries) গণতন্ত্রের অবনতি ঘটিয়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ছাড়া বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোতে বসবাসকারী মানুষ কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের কাছে অসহায়। ঙ.বহুত্ববাদ আক্রমণের মুখে পড়েছে। কর্তৃত্ববাদী নেতৃবৃন্দ ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর বহুত্ববাদ প্রত্যাখ্যান ২০২৩ সালে গণতন্ত্রের ব্যাপক অবনতি ঘটিয়েছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৫টি দেশ ও ১৫টি অঞ্চলের অবস্থান ফ্রিডম হাউজের এবারের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রাজনৈতিক অধিকারচর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এসব দেশ ও অঞ্চলকে ‘স্বাধীন’ (free), ‘আংশিক স্বাধীন’ (partly free) ও ‘স্বাধীন নয়’ (not free)-এ তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এবারের সূচক অনুযায়ী, ৮৩টি দেশ স্বাধীন, ৫৬টি দেশ আংশিক স্বাধীন এবং ৫৬টি দেশ স্বাধীন নয়। ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ১০০ স্কোর করে দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। গতবারও দেশটি ১০০ স্কোর করে সুইডেনের সঙ্গে যৌথভাবে শীর্ষস্থানে ছিল। সবচেয়ে কম ১ স্কোর পাওয়া দেশ হলো সিরিয়া।
ফ্রিডম হাউজের এবারের প্রতিবেদনে গত ১০ বছরে স্বাধীনতার অবনতি হয়েছে এমন দেশ ও অঞ্চলগুলোর একটি তালিকা রয়েছে। ওই তালিকায় বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুরস্ক, লিবিয়া, ইয়েমেন, আজাবাইজান ও মিসরসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাম রয়েছে।
এখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। বিগত চারবারের মতো ফ্রিডম হাউজের এবারের সূচকেও বাংলাদেশ ‘আংশিক স্বাধীন’ শ্রেণিতে রয়েছে। রাজনৈতিক অধিকারচর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতায় বাংলাদেশের সম্মিলিত স্কোর ৪০। এর মধ্যে রাজনৈতিক অধিকারচর্চার ক্ষেত্রে স্কোর ১৫, নাগরিক স্বাধীনতায় ২৫। এ দুই ক্ষেত্রে আগের বছরেও বাংলাদেশের স্কোর অভিন্ন ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো স্কোর করেছে। তাদের স্কোর যথাক্রমে ৬৬, ৬৩, ৬২ ও ৫৪। তবে এসব দেশও আংশিক গণতন্ত্রের শ্রেণিভুক্ত।
প্রশ্ন হচ্ছে, ফ্রিডম হাউজের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানে উন্নতি হচ্ছে না কেন? অর্থাৎ ‘আংশিক স্বাধীন’ শ্রেণি থেকে ‘স্বাধীন’ শ্রেণিতে দেশটির উত্তরণ ঘটছে না কেন? ২০২২ সালে বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অধিকারচর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতা পরিস্থিতি ফ্রিডম হাউজের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অধ্যায়ে বলা হয়, বিরোধী দল এবং এর সঙ্গে যুক্ত বলে যাদের ধারণা করা হয়-তাদের, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজকে অব্যাহত হয়রানির মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা সুসংহত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দুর্নীতি অবাধে ঘটছে এবং রাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী প্রয়াসকে দুর্বল করা হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনায় দুর্বলতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তারা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই-তিন মাস আগে শুরু হয় মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক। বিএনপির মহাসচিবসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ সংখ্যা ১১ হাজার বলে স্বীকার করেন।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক ও হয়রানি এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোট ও সমমনা দলগুলোর দাবি না মানায় নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১৭টি দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বাদে বাকি দলগুলো অনেকটা নামসর্বস্ব। এদের মধ্যে কয়েকটি নিজ দলের প্রতীক বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করে। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে সরকারি দল নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলের সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেয়। ‘ডামি’ নির্বাচন হিসাবে পরিচিতি পাওয়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ১১টি আসন বাদে বাকি সব আসনে শাসক দল আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জয়লাভ করে। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদণ্ড’ মেনে অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। এভাবেই নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা সুসংহত করা অব্যাহত রেখেছে শাসক দল আওয়ামী লীগ।
দ্বিতীয়ত, প্রসার ঘটছে দুর্নীতির। বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণাসূচকে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনমন ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতির হার বেশি।
তৃতীয়ত, দেশে নাগরিক স্বাধীনতা সুরক্ষার ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। সংবিধান প্রদত্ত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকবাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ২০২২ সালের আগস্টে ঢাকা সফরকারী জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। সফর শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘নির্যাতনবিরোধী কমিটিসহ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের বিভিন্ন কমিটি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ শুধু দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অধিকার গ্রুপ করেছে এমন নয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও স্বীকার করেছে, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ অস্বীকার না করে তা স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করা যেতে পারে।’ প্রস্তাবিত ওই কমিশনে ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের দপ্তর তৈরি আছে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। সরকার ব্যাচেলেটের এ প্রস্তাব আমলে নেয়নি।
চতুর্থত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল আইনের বিতর্কিত ধারাগুলোর প্রায় সব একইভাবে রাখা হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইনে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নতুন আইনটিও মানুষের বাক্ ও চিন্তার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, রাজনৈতিক অধিকারচর্চা, বহুত্ববাদ, নাগরিক স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টিকারী কারণগুলো দূরীকরণে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ফ্রিডম হাউজ, ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্র্যাসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে না।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com