Logo
Logo
×

বাতায়ন

সংঘাত এড়াতে প্রতীকবিহীন উপজেলা নির্বাচন

Icon

এম এ আজিজ

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংঘাত এড়াতে প্রতীকবিহীন উপজেলা নির্বাচন

দেশে যত আইন তৈরি করা হয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলো দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে করা। আবার, একই লক্ষ্যে কিছু আইনের সংশোধনীও আনা হয়েছে। তেমনি ১৯৮২ সালের উপজেলা পরিষদ আইন দলীয় স্বার্থেই ২০১৫ সালে সংশোধন করা হয়েছে। আবার সংশোধিত আইন থাকতেই দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন হতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালীন ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৮৩ সালের ৭ নভেম্বরের মধ্যে ৪৬০ উপজেলা পরিষদ সৃষ্টি করেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সব থানাকে উন্নয়ন করে উপজেলা পদ্ধতি চালু করা হয়।

আইনে বিধান রাখা হয়েছিল, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে উপজেলা পরিষদ গঠন হবে। এ নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে, যাতে স্থানীয় সমাজসেবকসহ অপরাপর পেশার মানুষ ও রাজনীতিকরাও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এছাড়াও ৪২টি মহকুমাসহ মোট ৬৪টি জেলাও সৃষ্টি করা হয়। অর্থাৎ স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে উন্নয়ন কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু করতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন রাজনৈতিক দলের বাইরে রাখা হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল, রাজনৈতিক দলগুলো প্রচ্ছন্নভাবে তাদের দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে যার যার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনের সব কার্যক্রমেই জড়িত হতো। এ অজুহাতে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সহজ পথ বিবেচনা করে ২০১৫ সালে উপজেলা আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনি ব্যবস্থা চালু করে। দেশের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞরা অগত্যা ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রাজ্যের গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি’-এর আদলের একটি ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন। অবশ্য, অধিকাংশ বিরোধী দলগুলো শুরু থেকেই এ সংশোধনীর বিরোধিতা করে।

কিন্তু আইনটি সংশোধনের পর বিশেষজ্ঞরা হতাশ হন। কারণ, তারা দেখলেন সংশোধনীতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সব পদকে বাদ রেখে শুধু চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার শুধু মেয়র পদের নির্বাচনকে রাজনৈতিক দলের প্রতীকে রাখা হয়েছে। তাই বিশেষজ্ঞরা মত দিলেন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থার আইন এভাবে সংশোধন করে তৃণমূলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে সরাসরি রাজনৈতিক দলের অধীনে এনে উন্নয়নের ভিত্তিমূল উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভাকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হলো। তারা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূলভিত্তি হিসাবে গড়ে তুলতে যতটা সম্ভব রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখার পক্ষে ছিলেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগ নৌকার প্রতীকের প্রার্থীর পাশাপাশি দলের অন্য সদস্যদের ডামি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করার অনুমতি দেয়। এছাড়া নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে আরও প্রায় ‘ভোটারবিহীন’ ২৭টি অনুগত দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায়।

এ একপক্ষীয় নির্বাচন নিজেদের মধ্যে হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় সারা দেশে চারজন এবং তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১৫ জন নিহত হন। আহত হন কয়েকশ। সহিংসতায় ঘর-বাড়ি হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করা হয়। আক্রমণকারী ও আক্রমণের শিকার সবাই আওয়ামী লীগের নৌকা, ডামি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক।

নিজেদের মধ্যে নির্বাচন করায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে গৃহদাহ ও গৃহবিবাদ দলকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে ফেলেছে। এ অবস্থায়, দল থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক না কেন, অন্য সব গ্রুপই মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এক বা একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী দেবে। তাই আওয়ামী লীগের কাছে দলীয় মনোনয়নে প্রার্থী না দেওয়াই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। কারণ, একজনকে প্রতীক দিলে দলের মধ্যে বিভেদ আরও বাড়বে।

নৌকা-ডামি-স্বতন্ত্র প্রার্থীর পাশাপাশি অন্য দলকে আসন ছেড়ে দিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করায় তৃণমূল আওয়ামী লীগে শৃঙ্খলা যেমন ভেঙে পড়েছে, তেমনই বিভেদ-বিভাজনও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মহাবিপাকে পড়বে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা মেয়র প্রার্থী বাছাই করতে। কারণ, প্রত্যেক স্থানীয় নেতাই দলে এবং এলাকায় প্রভাব ধরে রাখতে তার বলয়ের ব্যক্তিকেই প্রার্থী করতে মরিয়া হয়ে লড়াই করবে। এতে এক সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এ অশান্ত পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় নেতারাও সামাল দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সফরে যাবেন তৃণমূলের এ গৃহবিবাদ নিরসন করতে। কিন্তু এ প্রচেষ্টায়ও গৃহদাহ মীমাংসা হবে বলে মনে হয় না।

এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ তৃণমূলে সংঘাত-সহিংসতা এবং দলাদলি এড়াতে নয় বছর পর নিরুপায় হয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক ব্যবহার থেকে পিছু হটেছে। অর্থাৎ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার উন্নয়নের প্রয়োজনে নয়, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থেই প্রতীকবিহীন নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য, এ পদক্ষেপও আরেক দফা সরকারি দলের তৃণমূলে বিভেদ ও সংঘাত-সংকট উসকে দেবে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার পর কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে বা অন্য কারও পক্ষে ভোট করলে তাকে দল থেকে সরাসরি বহিষ্কার করা হবে। ২০১৫ সালের পর সব ধরনের নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া নেতাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে এবার জাতীয় নির্বাচনে দল সিদ্ধান্ত নিয়েই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। অর্থাৎ গঠনতন্ত্রের এ ধারার প্রয়োগ করা হয়নি। আবার, সরকারি দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতাকারীদের বহিষ্কার করে দেখেছে, তৃণমূলের নেতৃত্বই আর থাকে না। পরে তাদের ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। যেমন গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দুবার বহিষ্কার করে দুবারই ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় দলীয় প্রতীক যুক্ত করার একটি লক্ষ্য ছিল তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় প্রতীক ছড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি সব পর্যায়ে দলীয় জনপ্রতিনিধির ব্যবস্থা চালু করা। একেবারে দলীয় প্রতীক তুলে দিতে হলে আইনের সংশোধন করতে হবে। কিন্তু আইন সংশোধনের ইচ্ছা আপাতত আওয়ামী লীগের নেই; বরং বিদ্যমান উপজেলা আইন বহাল রেখে দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়া। অর্থাৎ দলের সবার জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত রাখা হবে।

যা হোক, প্রথম ধাপে শ’খানেক উপজেলা পরিষদের ভোটগ্রহণ ৩০ এপ্রিলের মধ্যে হবে। বাকিগুলো কয়েক ধাপে মে মাসে করা হবে। আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন হবে। একই দিন কয়েকটি পৌর সভায় নির্বাচন হবে।

বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এখন জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি এবং কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা কম। অপরদিকে, বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও, আওয়ামী লীগ নিজেদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফেরানোর প্রচেষ্টা হিসাবে প্রতীকবিহীন নির্বাচন করবে।

দেশে উপজেলার সংখ্যা ৪৯২। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পাঁচ ধাপে দলীয় প্রতীকে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবার দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলগুলো।

এম এ আজিজ : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম