নির্বাচনের শেষ ষাট মিনিট বনাম নতুন ঘণ্টাতত্ত্ব

আতাহার খান
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রথমেই বলে রাখি, প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয় সংসদ নির্বাচনের শেষ ৬০ মিনিট। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মোট ৮ ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। গত ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা অবধি, এ ৮ ঘণ্টা মিনিটে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ৪৮০ মিনিট। টানা এ দীর্ঘ সময়ে ২৯৯টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেষমেশ ২৯৮টি আসনের ফলাফল ঘোষিত হয়। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ৪১.৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। তার মানে ৫৮.২ শতাংশ ভোটার অর্থাৎ ৬ কোটি ৯৭ লাখ ৩৩ হাজার ৮৭৭ জন ভোটার সংসদ নির্বাচনে ভোট দেননি। এর সোজা অর্থ হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছেন। তাই একে কেউ কেউ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলে স্বীকার করতে চাইবেন না, হয়তো প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন বলেও মানবেন না। তাতে কি কিছু যায় আসে?
সংসদীয় গণতন্ত্রে মোট আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি আসন হলেই হলো-চোখ বুজে সরকার গঠন করা যায়। এখানে কত শতাংশ ভোটার অংশ নিলেন সেটা আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় হলো শেষ এক ঘণ্টায়, মানে শেষ ৬০ মিনিটে ভোট পড়ে ১৪.৬৫ শতাংশ। এর অর্থ হলো, শেষ এক ঘণ্টায় ১ কোটি ৭৪ লাখ ৫৯ হাজার ৭৭০ জন ভোটার ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪টি বুথে উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছেন। এ হিসাবকেও আরও খোলাসা করে এভাবে বলা যায়, প্রতি বুথে শেষ এক ঘণ্টায় ভোট পড়ে প্রায় ৬৭টি। প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য হিসাব? ভোটার প্রতি যদি ৩ মিনিট সময় লাগে তাহলে ২০১ মিনিট সময়ের প্রয়োজন হয়, আর ২ মিনিট করে ধরলে প্রয়োজন হয় ১৩৪ মিনিট। স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার, অসম্ভব একটি কাজকে সম্ভব করে দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা শেষ ৬০ মিনিটকে নতুন এক ঘণ্টাতত্ত্বে পরিণত করেছেন। নির্বাচন কমিশনই দিতে পারবে তার উত্তর ও ব্যাখ্যা।
তবে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বাদ দিয়ে বলা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হবে তা আগে থেকে জানা ছিল। শেষ অবধি ২২৩ আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সেই ধারণাকেই সত্য প্রমাণ করে। এ বিশাল জয়ের সঙ্গে আরও যোগ হয়েছেন ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী, এতে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮০। বিএনপি এবং তার সঙ্গী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও ক্ষমতাসীন দলকে বাড়তি কোনো চাপই মোকাবিলা করতে হয়নি। বলা যায়, খালি মাঠে জুতসই প্রতিপক্ষ ছাড়া একতরফাভাবেই ম্যাচ জিতে আসতে হয়েছে তাকে। হ্যাঁ, প্রধান প্রতিপক্ষ মাঠেই থাকছে না-বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নমিনেশনবঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দাঁড়ানোর সম্মতি লাভ করে। এ স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই ৫৮টি (৫৮+৪=৬২) আসনে জয়ী হয়ে সংসদে দ্বিতীয় অবস্থান লাভ করে, আর আওয়ামী লীগের শরিক দল (জাসদ ১+ ওয়ার্কার্স পার্টি ১) ২টি এবং কল্যাণ পাটি ১টি আসন লাভ করে। এরা সবাই ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনি লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল। শুধু জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকবিহীন ২৬ আসনে নিজ দলীয় প্রতীক ‘লাঙ্গল’ নিয়ে নির্বাচন করে ১১টি আসন লাভ করে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশ। যদিও এ হিসাবকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেছেন অনেকে। তাদের বক্তব্য, অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। রাজধানীর দুই সিটির কোথাও ভোটের হার ৩০ শতাংশ পার হয়নি। ঢাকার ১৫ আসনে তো সবচেয়ে কম ১৩.০৪ শতাংশ ভোট পড়ে। দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভোট পড়ার হার ছিল আরও কম। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির জেলার কথা। এ দুই জেলার ৪১৯টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ২৭টি কেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়েনি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২৯৮টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। ২৪১টি আসনে সত্যি সত্যি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল না। তবে ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ৪১.৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এ হিসাবও কারও কারও কাছে অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়েছে। ভোটে পরাজিত হওয়া আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কেউ কেউ জাল ভোট ও সময় পার হওয়ার পর প্রকাশ্যে সিল মারার অভিযোগ করেছেন। তবে মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়, ভোট পড়ার হার ছিল কম।
আরও একটি হতাশার ছবি হলো, ২০ শতাংশের কম জনসমর্থন নিয়ে সংসদে যাচ্ছেন ৭২ জন সংসদ-সদস্য। এর মধ্যে মোট ভোটের ১০ শতাংশেরও কম ভোট পেয়ে সংসদে যাচ্ছেন ২ জন। এর একজন হলেন চাঁদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী। তিনি ভোট পেয়েছেন নির্বাচনি এলাকার মোট ভোটারের ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর একজন হলেন ঢাকা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী। তিনি তার আসনের মোট ভোটারের ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।
এদিকে ২৫ জন প্রার্থী পেয়েছেন ১৫ শতাংশেরও কম ভোট। এতে বেশকিছু প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে; যেমন, এভাবে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্ব কি সুনির্দিষ্ট হয়? কেউ কি মেনে নেবেন, এভাবে জনমতের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়? তাছাড়া, প্রমাণ করা কি যাবে, দলীয় সরকারের অধীনে প্রধান প্রতিপক্ষ দল ক্ষমতায় আসে? সংসদীয় গণতন্ত্রে কম ভোট পেয়েও নির্বাচিত হওয়া যায়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও নির্বাচিত হওয়া বৈধ। হ্যাঁ, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অসম্মতি থাকা গণতন্ত্রের এ শাসন নিয়ে প্রশ্ন এবং কথা ঠিকই উঠবেই।
প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠেছে। সাধারণত প্রতি ভোটারকে প্রার্থীদের নিয়োগ করা এজেন্টদের পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পৌঁছাতে হয় নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে। তার কাছ থেকে ব্যালেট পেপার বুঝে নিয়ে বুথে ঢুকতে হয়। নির্দিষ্ট মার্কায় মারতে হয় সিল। তারপর সেই ব্যালেট পেপার ভাঁজ করে ব্যালেট বাক্সে ফেলতে হয়। এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে একজন ভোটারকে কমপক্ষে ২ মিনিটেরও বেশি সময় খরচ করতে হয়। যুক্তির খাতিরে যদি আমরা ভোটারপ্রতি সময় ২ মিনিটও ধরি, তাহলে ৬৭ জন ভোটারের জন্য ভোটদান প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগার কথা ১৩৪ মিনিট। অথচ হাতে আছে সময় মাত্র ৬০ মিনিট। বাস্তবে সেই ৬০ মিনিটে মাত্র ৩০ জন ভোটার ভোট দিতে পারে এবং সেটা বিশ্বাসযোগ্যও হতো সবার কাছে। কিন্তু সেখানে দেখা যায় অন্য ছবি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দেখানো হলো ৬৭ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। এ কি মগের মুল্লুক! গোঁজামিল দিয়ে একটা হিসাব দেওয়া হলে তা সবাই মেনে নেবেন, এমনটা ভাবা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়! আসল কথা, সবকিছু এভাবে সরলীকরণ করা কোনোমতেই ঠিক হয়নি। যেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই দাবি করেছেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে এবং দলীয় সরকারের অধীনে এ নির্বাচনে কোনো রকম চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করতে হয়নি, সেখানে নির্বাচন কমিশনের কী দরকার ছিল এমন সব প্রশ্ন তোলার সুযোগ সৃষ্টি করা?
তাহলে কি মানতেই হবে, কিছু একটা ঘটানো হয়েছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভোটের হার বাড়ানোটাই ছিল লক্ষ্য। এজন্যই কি শেষ ৬০ মিনিটে নির্বাচন কমিশন এ অভিনব ঘণ্টাতত্ত্ব হাজির করে? সেজন্যই কি দরকার হয়েছিল অলীক হিসাব দাঁড় করানোর? বরং এতে সৃষ্টি হয় ভুল বোঝাবুঝি, তৈরি হয় নানা প্রশ্ন। আমরা জানি, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রক্ষার জন্যই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এ নির্বাচন আয়োজনের। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেখানে স্বীকার করেছেন দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত ছিল এ নির্বাচন, সেখানে কেন নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্টি হলো অহেতুক বিতর্ক? এর কি কোনো প্রয়োজনই ছিল? কে দেবেন তার উত্তর?
আতাহার খান : সাংবাদিক, কবি, মুক্তিযোদ্ধা