Logo
Logo
×

বাতায়ন

‘ডিগ্রিতে আবার ক্লাস করতে হয় নাকি!’

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘ডিগ্রিতে আবার ক্লাস করতে হয় নাকি!’

প্রতীকী ছবি

বিষয়টি নিয়ে মনের মাঝে যত কষ্ট-যাতনা, অস্বস্তি-ক্ষোভ, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা-দুর্ভাবনাই থাক, লেখাটি একটি হালকা জোক দিয়ে শুরু করতে চাই। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ছেলে খুশিচিত্তে বাবাকে বলল-‘জানো বাবা, আজ স্কুলে প্রতিযোগিতায় তিনটি বিষয়ে আমি প্রথম হয়ে পুরস্কার পেয়েছি। এতে স্কুলের স্যার এবং সব ছাত্রছাত্রী দারুণ খুশি।’

শুনে বাবা বললেন, ‘তোমার এমন সাফল্যের খবরে আমিও অত্যন্ত খুশি। তা আমাকে খুলে বল তো কোন কোন বিষয়ে তুমি প্রথম হয়ে পুরস্কার পেয়েছ?’

ছেলে বেশ আগ্রহ সহকারে বলতে শুরু করল-‘প্রথমটা পেয়েছি সুন্দর হাতের লেখার জন্য। দ্বিতীয়টা স্মরণশক্তির জন্য। আর তৃতীয়টা...।’ এ পর্যন্ত বলে হঠাৎ সে থেমে গেল। আবারও বলতে চেষ্টা করল-‘তৃতীয়টা...’; কিন্তু না, তার মনেই আসছে না। শেষবার সে স্পষ্ট করেই বলে ফেলল-‘তৃতীয়টা এ মুহূর্তে আমার মনে আসছে না।’

‘বাগাড়ম্বর’ আর ‘আত্মতুষ্টি’ যাই বলা হোক, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা ও ত্রুটিবিচ্যুতিগুলোর কথা সহজে এবং অল্পকথায় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। অথচ এ নিয়ে চারদিকে কেবল গলাবাজি আর গলাবাজি। আমরা ‘এই করেছি, সেই করেছি’, আমাদের ‘এই আছে, সেই আছে’, আমরা ‘এই করব, সেই করব’-আরও কত কী! শুরুটা সেই আশির, নিদেনপক্ষে নব্বইয়ের দশকে তো বটেই। ‘উন্নয়নের সরকার’, ‘শিক্ষাবান্ধব সরকার’, ‘শিক্ষকবান্ধব সরকার’...। আর সময় সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা এমন গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিধারী ব্যক্তির নামের সঙ্গে বিশেষণ সংযুক্তির তো কোনো হিসাবনিকাশই নেই। কারা তৈরি ও প্রয়োগ-ব্যবহার করে এসব অভিধা আর বিশেষণ? অন্য কেউ যেমনই হোক, শিক্ষক শ্রেণিটি এদিক দিয়েও বেশ এগিয়ে!

২.

শৈশবে মুখস্থ করা স্বনামে পরিচিত মহাজন রামসুন্দর বসাক প্রণীত ‘বাল্যশিক্ষা’ বইটির কথা খুবই মনে পড়ে। শিশুদের জন্য লেখা সুখপাঠ্য এ বইয়েরই একটি বাক্য হচ্ছে, ‘অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পায়’। শ্রেণিকক্ষে (যখন শিক্ষকতায় ছিলাম) প্রসঙ্গক্রমে কিংবা শ্রেণিকক্ষের বাইরে কখনো সুযোগ হলে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আমি এ বাক্যটি প্রায়ই উচ্চারণ করে থাকি। অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পায়; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কার বা কাদের বিদ্যা হ্রাস পায়? শিক্ষার্থীর, নাকি যিনি শিক্ষাদান করেন সেই শিক্ষকের? এক কথায় এর সহজ উত্তর-সবার। যে কোনো বিষয়েই চর্চা বা অভ্যাস না থাকলে সবার বিদ্যাই ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। আর কমতে কমতে তলানিতে পড়ে, একসময় তা একেবারে নিঃশেষই হয়ে যেতে পারে।

৩.

দেশে উচ্চশিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে কলেজগুলোয় শিক্ষার্থীদের ক্লাস না করার প্রবণতা দিনদিন যে কী মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, তা অল্প কথায় সহজে বলে শেষ করা যাবে না। বিষয়টি একেবারে ভাবনারও অতীত এবং সবার জন্যই গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। এছাড়া গোটা জাতির জন্যই সমূহ দুর্গতিরও আলামত বলে মনে করি। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে যেমন-তেমন, এর উপরের স্তরগুলোর হালহকিকত একেবারেই নাজুক।

দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, এমনকি অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও কথাটি সত্য যে, বছরের কোনোদিনই একটি ক্লাসেও উপস্থিত না থেকে কিংবা নামকাওয়াস্তে দুই-চার দিন উপস্থিত থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি পাস, অনার্স ও মাস্টার্সের মতো পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। অনিয়মিত নয়, ক্লাসে উপস্থিত না হওয়াদের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসাবেই বছর বছর এ সুযোগটি করে দিয়ে চলেছে কর্তৃপক্ষ। আর অতি সহজেই সুযোগ পেতে পেতে শিক্ষার্থীদের মাঝে এরূপ ক্লাস না করার প্রবণতা দিনদিন কেবল বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি যে কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা শিক্ষার সঙ্গে যারা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নন, তাদের বোধকরি সহজে বিশ্বাসই করানো যাবে না। তবু রক্ষা-নিয়ম অনুযায়ী আজকাল এক কলেজের পরীক্ষার্থীকে অন্য কলেজে বসে পরীক্ষা দিতে হয়। তা না করে আগের মতো নিজেদের কলেজেই বসে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে পরীক্ষার হলে এমন অসংখ্য পরীক্ষার্থীর দেখা পাওয়া যেত-যাদের ক্লাসে তো দূরের কথা, শিক্ষকরা ক্যাম্পাসেই কখনো দেখেননি।

৪.

দেখতে বেশ প্রাণোচ্ছল, সপ্রতিভ চেহারা। বয়স আনুমানিক চব্বিশ অথবা পঁচিশ। হতবাক না, আমি একদম নির্বাক হয়ে গেলাম তরুণটির মুখে এসব কথা শুনে। কোনো জড়তা নেই, নেই কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব, যা বলার ঝটপট ও অকপটে বলে দিয়েছে সে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে আরও যাচাই কিংবা অনুসন্ধান করার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। স্বাধীনতার বাহান্ন বছর অতিক্রম করেছি আমরা। বিজয়ের মাসে, বিজয়ের স্মৃতিবহ আনন্দঘন মুহূর্তে আমার কাছে এ এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা।

১৬ ডিসেম্বর, বেলা ঠিক ১১টা। কিশোরগঞ্জ শহরে পুরোনো বইয়ের একটি দোকানে ঢুকলাম। বইয়ের ওপর চোখ রেখেই ফাঁকে দোকানি তরুণটিকে নাম জিজ্ঞেস করলাম।

‘লেখাপড়া কতদূর করেছ?’

‘ডিগ্রি ভর্তি হয়েছি।’ ‘কোথায়’-জানতে চাইলাম। ও সংক্ষেপে বলল, ‘ঢাকায়।’ ‘ঢাকার কোথায়’-আমি আবারও জানতে চাই। ও আবারও সংক্ষেপেই জবাব দেয়-‘টঙ্গী।’ তার মানে ঢাকার টঙ্গীতে সে ডিগ্রি পড়াশোনা করে। ততক্ষণে ‘গ্রেশামের বিধান’ দেখা আমার শেষ হয়ে গেছে। এবার দোকান ত্যাগ করার পালা। ওর কথাবার্তায় ধৈর্যচ্যুতির কারণ থেকে থাকলেও আমি একটুও নিরুৎসাহী হইনি। বেশ কৌতূহল নিয়ে সরাসরিই জানতে চাই-‘তুমি টঙ্গীর কোন কলেজে ডিগ্রি পড়ো।’ ও আমতা আমতা করে কী একটা বলতে চেয়েও থেমে যায়, বলতে পারেনি। আমার নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে সে আরও অনেক কথাই বলে। শহরতলীতেই বাড়ি। ২০২০ সালে স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছে। বইয়ের দোকানটিতে সে ছিল কর্মচারী। মালিক বই ও আসবাবপত্র এবং জমাকৃত টাকাসহ বিক্রি করতে চাইলে সে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে দোকানটি কিনে নেয়।

‘দোকান ফেলে রেখে তো আর ক্লাস করা সম্ভব নয়’-এমন কথা শোনার পর জিজ্ঞেস করি, একেবারে ক্লাস না করলে শিখবে কী, পাশই বা করবে কীভাবে? দেখে এবং ওর সঙ্গে কথা বলে আমার কাছে মনে হলো খুবই সহজসরল। শিক্ষা-শিক্ষক-সমাজ-বাস্তবতা ও মূল্যবোধ-এসবকিছু তার ধারণার বাইরে। তবে দেশের ‘অন্তঃসারশূন্য’ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি সে অবহিত। তা না হলে আমার সঙ্গে এমন কথা এভাবে সে বলতে পারে না। লাজ ভঙ্গিমায় মাথাটা একটু নিচু করে ও বলল, ‘ডিগ্রিতে আবার ক্লাস করতে হয় নাকি!’ ওর নাম ও ফোন নম্বর উল্লেখসহ দোকানের একটি কার্ড আমাকে দিলে আবারও জানতে চাই ওর কলেজের নামটি মনে পড়েছে কি না। কিন্তু আগের মতোই সে আমতা আমতা করতে থাকে। শেষে বলে যে টাকা জমা দেওয়ার রসিদে (২৫০০ টাকায় ভর্তি) কলেজের নামটি লেখা আছে। শুনে আমিও অধোবদনে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলাম।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন রাহুদশা একদিনে বা একটি সরকারের আমলে সৃষ্টি হয়নি। অনেক অবহেলা ও অপরিণামদর্শিতার ফল এসব। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। বাগাড়ম্বর পরিহার করে এখনই সজাগ ও তৎপর হওয়া দরকার। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে কেবল কলেজের নয়, শিক্ষার্থীরা এমনকি নিকটজনদের (সম্পর্কের কথাটি এখানে আর পরিষ্কার করলাম না) নামও ভুলে যেতে পারে।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম