Logo
Logo
×

বাতায়ন

আলোর ঝলকানিতেও আঁধারে ওরা

Icon

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আলোর ঝলকানিতেও আঁধারে ওরা

সুপার মার্কেটে কেনাকাটার অভ্যাস বহু বছর আগে ছিল। বিদেশে পড়াশোনা করার সময় ক্যাম্পাস থেকে বহু দূরের সুপার মার্কেটে ছুটির দিনে কেনাকাটা করতে যেতাম। সেখানে প্রবাসী অনেকের সঙ্গে দেখা হতো। বিশেষ করে প্রবাসী ছোট ছেলেমেয়েরা সুপার মার্কেটের ভেতরে বিভিন্ন রাইডে চড়ে এবং মার্কেটের বাইরে খোলা পার্কের আলো-বাতাসে লাফালাফি করে বাংলা ভাষায় আনন্দ প্রকাশ ও ভাব বিনিময় করে সময় কাটানোর সুযোগ পেত। তাদের বাবা-মায়েরাও দেশের নানা বিষয়ে খোশগল্প করার সময় পেতেন। দেশে ফিরে আসার পর তাদের সেই সুযোগ হারিয়ে গেছে।

অধুনা ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন বড় শহরে বাহারি নামের নানা সুপার মার্কেট গড়ে উঠেছে। সেগুলোর বেশিরভাগই শহরের জনবহুল এলাকায় অবস্থিত। এগুলোর নেই কোনো খোলা প্রাঙ্গণ, নেই কোনো রাইড, নেই কোনো বিনোদনের জায়গা। এমনকি সেগুলোর ৯৮ শতাংশের কোনো নিজস্ব পার্কিং সুবিধা নেই। পরিবারসহ গাড়ি নিয়ে সেখানে কোনো কিছু কিনতে গেলে তাই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অসহ্য যানজটের মধ্যে সরকারি জনবহুল অপ্রশস্ত রাস্তার উপরে গাড়ি রেখে মার্কেটে ঢুকতে হয়। সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধের মাঝে রাস্তায় আনঅ্যাটেনডেন্ট গাড়ি রেখে কোথাও গেলে চুরি অথবা পুড়ে যাওয়ার ভয় অনেক বেশি।

২.

সম্প্রতি বাণিজ্যিক রাজধানীতে গরুর মাংস কিনে বাসায় ভিজিয়ে রাখার পর মরা পোকা ভেসে ওঠার খবর বেরিয়েছে। মাংসে পোকা ভেসে ওঠার কারণ ছিল বিদ্যুতের দীর্ঘ লোডশেডিংয়ে পচা মাংস ফেলে না দিয়ে রেফ্রিজেরেটরে রেখে বিক্রি করার প্রবণতা। এছাড়া সম্প্রতি কাঁচাবাজারে গরুর চর্বিতে লাল রং মেখে আসল মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে কম দামে বিক্রি করার খবর প্রকাশ পেয়েছে। সবকিছুতেই যেন জাতির মাথায় পচনের কীট!

তাই সেদিনের হরতালের সকালে প্রতিবেশী বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কাঁচাবাজারের দিকে রওনা দিলাম। তার উদ্দেশ্য তাজা শাকসবজি ও মাছ কেনা। সে সাধারণত সুপার মার্কেটের ফ্রোজেন মাছ-মাংস খায় না। গল্প করতে করতে বহুদূর পথ হেঁটে আমরা রাজশাহী শহরের বড় একটি কাঁচাবাজারে প্রবেশ করলাম। শেষ কবে শহরের নদীতীরের ওই কাঁচাবাজারে গিয়েছি তা মনে নেই। শুধু মনে হলো, আগের তুলনায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। যদিও সেটা গা সওয়া বিষয়, তবুও মাছ বাজারের হাঁকডাক শুনে কিছুটা শব্দদূষণ মনে হলো। চোখে লাগল আলোর বিষয়টি, যা কিনা দৃষ্টিদূষণের পর্যায়ে টেনে নিয়ে গেল। আগের তুলনায় দিনের বেলাতেও সেখানে এত বেশি এলইডি বাল্ব লাগানো হয়েছে যে, মাছের ডালির দিকে তাকানো দায়। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগের ওই মাছ বাজারের ভৌত কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিক্রেতাদের আচরণ আগে যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে।

শুধু মনে হলো, আগে মাছ বাজারের গলিগুলোতে এত নোংরা পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল না। কিন্তু এখন সেখানে কাদা পানি মেখে একাকার হয়ে গেছে। তবুও সেখানে মাছ কেনার জন্য প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় জমে যায়। কারণ, রাত পোহালেই নদী-বিলের তাজা মাছ মেলে ওই বাজারে।

মাছ কিনতে কিনতে শীতের সকালেও শরীরে ঘাম জমে পোশাক ভিজে গেল। অন্যদিকে কাদা পানিতে পায়ের অবস্থাও বেশ নাজুক। অগত্যা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বের হয়ে অনেকক্ষণ পর একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার দেখা মিলল। সেটাতে কোনোরকমে মাত্র দুজন বসা যায়। মাছের ব্যাগ রাখতে হলো ড্রাইভারের পায়ের নিচে। সে চার-পাঁচ মাইল পথের জন্য ভাড়া দাবি করল অনেক বেশি।

সেই রিকশায় উঠে দুজনে গল্প করতে থাকলাম। বাজারের মধ্যে চেঁচামেচি ও এলইডি আলোর তীব্রতা থেকে রেহাই পেয়ে একটু স্বস্তি লাগল খোলা রাস্তায় এসে। আলোর তীব্রতা নিয়ে কথা বলা শেষ না হতেই বন্ধুটি হঠাৎ মাথার উপরে তাকাতে বলল। উদ্দেশ্য, আমাকে হাজার হাজার নতুন বাল্ব দেখানো। বলল, মাছ বাজারে কী আলো দেখেছ? এ রাস্তায় রাতের বেলা কখনো গাড়ি ছাড়া বের হয়েছ কি? এখানে একশ মিটারের মধ্যে কতগুলো বাল্ব লাগানো হয়েছে তা দেখেছ কি? আমি বললাম, না এ রাস্তায় রাতে কখনো গাড়ি ছাড়া বের হইনি। বিশেষ করে আমি নিজে ড্রাইভ করি। গাড়ির জানালা সবসময় বন্ধই থাকে। সুতরাং রাতে বের হলেও নিজে ড্রাইভ করায় কখনো রাস্তার বাল্ব গুনে দেখার সুযোগ হয়নি।

চলতে চলতে বন্ধুটি বলতে লাগল, কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় একজন অর্থনীতির প্রফেসর লিখেছিলেন রাস্তায় স্বল্প ব্যবধানে এত বিদেশি বাল্ব লাগানোর কথা। এ শহরের অনেক জায়গায় রাতে বিদ্যুৎ থাকে না। বিনা নোটিশে বারবার বিদ্যুৎ চলে যায়। পর্যাপ্ত বিদ্যুতের অভাবে এ এলাকার উদ্যোক্তারা ভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে কারখানা গড়েন। অথচ কয়েকটি রাস্তায় অল্প ব্যবধানে এত বেশি বাল্ব লাগানো হয়েছে, যা বিদ্যুতের অপচয়। এ অপচয় অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক এবং মানুষের দৃষ্টিদূষণ ঘটাচ্ছে বলে ইতোমধ্যে নানা সমালোচনা হচ্ছে।

সম্প্রতি এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ৬৩.৭৮ শতাংশ অভিযোগই বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ে। গত ৩০ নভেম্বর বিদ্যুৎ ভবনে গ্রাহক সন্তুষ্টিবিষয়ক জরিপের রিপোর্টের তথ্যে বলা হয়েছে, ৩৪.৪২ শতাংশ অভিযোগ লোডশেডিং সংক্রান্ত। সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে বিদ্যুতের অপচয় রোধ করতে তিনটি খুঁটির পর একটিতে আলো জ্বালিয়ে বাকিগুলো নিভিয়ে রাখলে দেশের অন্যান্য জায়গায় লোডশেডিং কমানো যেতে পারে।

এছাড়া এ শহরে উন্নতমানের উন্মুক্ত কাঁচাবাজার নেই। স্বল্প আয়ের মানুষের বসবাসই এ শহরে বেশি। বিশেষ করে শিক্ষা শহর হওয়ায় এখানে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য ভিড় করে। তারা মেসে থাকে। আধুনিক সুপার মার্কেটে কেনাকাটা করার মতো তাদের সিংভাগের আর্থিক সামর্থ্য নেই। সেজন্য তাদের সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর জোর দিয়ে সস্তায় ভেজালমুক্ত তাজা খাদ্যসামগ্রী কেনাকাটার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন উন্মুক্ত কাঁচাবাজারগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সাজানো জরুরি। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে-কাজলা, বিনোদপুর ইত্যাদি এলাকায় ড্রেনের ওপর কসাইয়ের ঝুলন্ত মাংসের দোকান স্মরণাতীত কাল থেকে দেখে আসছি।

পচা ড্রেনের পাশে শাকসবজি, ফলমূল বিক্রি হচ্ছে শহরের বহু জায়গায়। অস্বাস্থ্যকর কত কিছু। কর্তৃপক্ষ সেদিকে নজর না দিয়ে রাস্তায় মাত্রাতিরিক্ত তীব্র আলোর ব্যবস্থা করে চলেছে। দেশের অর্থনীতি জনকল্যাণমুখী না করে কিছু বিত্তশালী মানুষের ভোগবিলাসের বস্তুতে পরিণত করা কতটা যৌক্তিক?

৩.

এই শিক্ষা শহরে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা একটি পার্টটাইম জব অথবা উপার্জনমুখী কাজের অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে ড্রপআউট হচ্ছে। এখানে এত বেশি শিক্ষার্থীর বসবাস যে টিউশনি জোগাড় করা দুরূহ ব্যাপার। কেউ ভাগ্যক্রমে একটা টিউশনি করার সুযোগ পেলেও তার পারিশ্রমিক এত কম হয় যে তা দিয়ে যাতায়াত ভাড়া মেটানোর পর তেমন কিছু থাকে না। কেউ কেউ ঢাকা, গাজীপুরে গিয়ে পোশাকশিল্পে কাজ করছে অথবা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিবছর। এ শহরের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আয় কী?

অথচ এ অঞ্চলে উৎপাদিত ফল, কৃষিপণ্য, মাছ ইত্যাদি দিয়ে উৎপাদনমুখী কলকারখানা গড়ে তুলতে পারলে শিক্ষার্থীরা ছুটির দিনে অথবা সারা বছর পার্টটাইম জব করার সুযোগ পেত। এতে তাদের দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক, মানসিক চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করার সুযোগ পেতেন।

সেদিন রাতে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক আত্মীয়কে দেখতে গেলাম। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য যাওয়া। কারণ সম্প্রতি তার স্ত্রী একটি জটিল রোগে মারা গেছেন ভারতের এক হাসপাতালে। এ শহর ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় এবং সেখানে গতি করতে না পেরে বারবার ভারতের মুম্বাই শহরে চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়ে তিনি ও তার আত্মীয়রা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল হলেও শেষ পর্যন্ত রোগীকে বাঁচানো যায়নি। মাত্র এক বছর আগে তার দুজন সহকর্মী একই ধরনের রোগে ভুগে মাত্র দুমাসের ব্যবধানে ইন্তেকাল করেছেন। তাদেরও চিকিৎসার জন্য বারবার ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে কথা স্মরণে আসতেই আমার সেই আত্মীয় অনেকটা বিচলিত হয়ে উঠলেন। যদি আমাদের দেশে, এই শহরে তারা চিকিৎসার সুযোগ পেতেন, তাহলে কতই না উপকার হতো নির্ভরশীল পরিবারগুলোর জন্য। এছাড়া আমাদের দেশের অর্থ দেশেই থাকত।

আমাদের শহরে ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা নেই, ভালো কলকারখানা নেই, ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। আছে রাজনৈতিক উত্তেজনা, অটোরিকশার জ্যাম ও অনবরত হর্ন বাজানোর শব্দ, অহেতুক আলোদূষণ, দৃষ্টিদূষণ ইত্যাদি। নির্বাচনের অজুহাতে ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ রেখে যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখার কারণে এ দূষণাবস্থা আরও বেড়েছে। এদিকে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

সদর রাস্তায় বিদেশি নিয়ন বা এলইডি বাল্বের আলোর বন্যা সেসব রোগীর নিঃস্ব পরিবারের নিভে যাওয়া আলোকে কীভাবে আবার জ্বলতে সাহায্য করবে, তা আমার জানা নেই বলে বন্ধুটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ আগে কাঁচাবাজারের কাদা পানি ডিঙিয়ে তার বুকের কষ্ট যেন গভীর থেকে গভীরে উথলে উঠল। আমি আর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না। শুধু তার মুখের দিকে একবার তাকানোর চেষ্টা করলাম। শব্দদূষণ, আলোদূষণের আলোচনা ছাপিয়ে ওর মুখাবয়বে নানা ধরনের চিন্তার আভাস লক্ষ করলাম। ততক্ষণে রিকশাওয়ালা বাসার সামনে এসে তার ‘সংসার চলে না’ বলে ভাড়াটা বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি করল। আর বিড়বিড় করে বলল, রাস্তায় এত আলোর ঝলকানিতে আমাদের মতো বস্তিবাসীদের লাভ কি স্যার?

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

fakrul@ru.ac.bd

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম