কপ-২৮ ও বাংলাদেশ
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ-কপ ২৮ অনুষ্ঠিত হবে দুবাইয়ের এক্সপো শহরে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, কপ ২৮-এ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বর্তমানে বিশ্ব কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই বিষয়ে ফাঁকগুলো খুঁজে বের করে ২০৩০ সালের মধ্যে সমাধানের বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে আলোচনায় স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জাতিসংঘ আয়োজিত কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ) থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১৯৯৪ সালে প্রথম ইউনাইটেড ন্যাশন্স ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) গঠিত হয়। প্রতিবছর ইউএনএফসিসিসির সদস্য দেশগুলোর অংশগ্রহণে জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক সম্মেলন কপ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বর্তমানে ইউএনএফসিসিসির সদস্য দেশ হলো ১৯৮। ১৯৯৫ সালের ২ মার্চ জার্মানির বার্লিনে প্রথম কপ ১ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে যৌথ উদ্যোগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের কপ ২৫ স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে পুনরায় প্যারিস চুক্তির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। উল্লেখ্য, প্যারিস চুক্তিটি ২০১৫ সালে ১৯৬টি দেশের মতামতের ভিত্তিতে কপ ২১-এর মাধ্যমে ফ্রান্সের প্যারিসে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে অর্থাৎ ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ওই সময় সমগ্র বিশ্বে খরা, অনাবৃষ্টি/অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্তটি ছিল যুক্তিসম্মত। তাছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন প্রায় ৪৩ শতাংশ কমানোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
২০২০ সালে কপ ২৬ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে রেজিলিয়েন্স ক্লাইমেট চেইঞ্জ ও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন কমানোর জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা হয়েছিল। সেই লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন রোধে দৃশ্যমান পরিকল্পনার সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কী কর্মপরিকল্পনা যোগ করা যেতে পারে, সেই বিষয়টিও আলোচনায় গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছিল। ফলে ওই সময় প্যারিস চুক্তিতে উল্লিখিত বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার সম্ভাবনাটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কপ ২৭-এ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বছরে সুনির্দিষ্ট অর্থের বরাদ্দের নিশ্চয়তা প্রদান। যেহেতু বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা অসম্ভব, সেহেতু একুশ শতকের শেষে তাপমাত্রা ২ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে কীভাবে রাখা যায়, সে বিষয়ে আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
কপ ২৭-এ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের বিষয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। ওই সম্মেলনে উন্নত দেশের জন্য ২১১ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার, স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ৭০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার বরাদ্দের বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে ৩৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারের বিশেষ ফান্ড গঠনের বিষয়টিকে স্বাগত জানানো হয়েছিল।
তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে একটি নতুন জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ড গঠনের বিষয়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছিল। ওই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়, উন্নত দেশগুলোর সহায়তায় ২০২০ সালের মধ্যে বছরে ১০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বরাদ্দের বিষয়টি বাস্তবায়ন না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। পরিশেষে ২০২৪ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ফান্ড দ্বিগুণ করার জন্য জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটিজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান, ন্যাশনাল এডাপটেশন প্রোগ্রাম, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট অ্যাক্ট, এনডিসি, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান, মুজিব ক্লাইমেট প্ল্যান ও ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানসহ আরও অনেক পরিকল্পনা বিদ্যমান রয়েছে। এনডিসি অনুযায়ী দেখা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে শর্তহীনভাবে নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশ প্রায় ২৭ দশমিক ৫৬ টন গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডল থেকে কমাবে। আবার শর্ত অনুযায়ী, ৬১ দশমিক ৯ টন গ্রিনহাউজ গ্যাস কমানোরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৮৯ দশমিক ৪৭ টন গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডল থেকে কমাতে সক্ষম হতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান অনুযায়ী টেকসই উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমানোর ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জে একটি প্রতিবেদনও দাখিল করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ প্রায় শূন্য দশমিক ৯৮ টন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করছে, যা অনেক দেশের তুলনায় কম।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। ওই ফান্ডের আওতায় ৮০০ প্রকল্পে প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রায় ২ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন অর্থ ব্যয় করেছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ ২০০ মিলিয়নের বেশি ইউএস ডলার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করছে। অন্যদিকে মন্ট্রিল প্রটোকল অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্যে ২ দশমিক ১৪ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে কমানোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুবাইয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন কপ ২৮ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ সম্মেলনে সারা বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান, পরিবেশবিদ, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশাজীবীর লোকজন উপস্থিত থাকবেন। আশা করা যাচ্ছে, এ সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা নিজ নিজ দেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়গুলো উল্লেখ করবেন। যদিও পূর্বের সম্মেলনগুলোয় যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন কোনোটিই সফলভাবে হয়নি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা, যা বাস্তবে কখনো সম্ভব না। উন্নত দেশগুলো কর্তৃক বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ড দেওয়ার কথা ছিল, যা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উন্নত দেশ কর্তৃক কম মূল্যে উন্নয়নশীল দেশে সরবরাহের বিষয়টিও আলোচনায় ছিল। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা সম্ভব না হওয়ায় তাপমাত্রার বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে উন্নত দেশ কর্তৃক নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে উন্নয়নশীল দেশে সরবরাহের নিশ্চয়তা অতীব জরুরি। আশা করা যাচ্ছে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতি মোকাবিলায় চলমান কর্মসূচিগুলো কপ ২৮-এর মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হবে; যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন কমানো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আশা করা যাচ্ছে, বাংলাদেশও কপ ২৮-এ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে জোর দাবি জানাবে।
বাংলাদেশ যদি কপ ২৮-এ ফান্ডের নিশ্চয়তা পায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিদ্যমান কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হতে পারে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সমগ্র বাংলাদেশে বনায়ন ১৭ থেকে ৩০ শতাংশে উন্নীতকরণ, বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন, খরা, বন্যা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু উন্নতজাতের কৃষি ফসলের উৎপাদন বাড়ানো, নদীর নাব্য বৃদ্ধিকরণ ও জলাশয়গুলোর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা, পরিকল্পিত শহরায়ন ও শিল্পায়ন, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো, কৃষিতে কেমিক্যালের পরিবর্তে জৈব ও পরিবেশবান্ধব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়ানো ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। পরিশেষে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশও ভবিষ্যতে জলবায়ু সম্মেলন কপ ২৮ থেকে প্রাপ্ত ফান্ডের সদ্ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জিরো কার্বনের দেশে পরিণত হতে পারে।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
uzzal@bsmrau.edu.bd