রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে এবং সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার দেখাশোনা করছে। গত ছয় বছরেও মিয়ানমারে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা ক্রমে তীব্র হচ্ছে; এর ফলে ক্যাম্পগুলোতে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। অভাব, বেকারত্ব ও হতাশা তাদের অনেককে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে তারা নানা ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। এসব কোনো কিছুর সঙ্গেই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা নেই। বাংলাদেশ এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবিচলভাবে কাজ করে চলেছে।
রোহিঙ্গাদের মাদক পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তাও নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার কথা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জানাতে পেরেছে এবং এ উদ্যোগ চলমান রেখেছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে অনেক লেখা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার মূল কারণ এবং টেকসই সমাধান না খুঁজে বাংলাদেশ সরকারের মানবিক কার্যক্রমের প্রশংসা বাদ দিয়ে অনর্থক সমালোচনা করে বাংলাদেশের অবদানকে খাটো করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মানব পাচার, অস্ত্র-মাদক চোরাচালান ও সহিংসতায় ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ছে, যা ক্যাম্পের ভেতরে এবং স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ও অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর চাঁদাবাজি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বসহ নানা ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার রোহিঙ্গা নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে এবং নানা ধরনের হুমকি দিয়ে চাপে রাখা হচ্ছে। দাতাগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাদ্য রেশন ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছে, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এ অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায় নতুন সংকট তৈরি হয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। বরাদ্দ কমায় ক্যাম্পে দিন দিন আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। অর্থের জন্য নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ায় শরণার্থীদের মানবিক সেবায় নিয়োজিত দেশি ও আন্তর্জাতিক এনজিওর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কে আছে। চলমান মানবিক কার্যক্রম সচল রাখতে ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক।
ক্যাম্পগুলোতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা স্যালভেশন অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সদস্যরা রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করছে। এরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না, এদের সহায়তা করতে মিয়ানমার ইয়াবা, মাদক, অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী চোরাচালানের অবারিত সুযোগ করে দিয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে এবং নিজেদের অধিকারের কথা বলতে না পারে, সেজন্য সুযোগ পেলেই নেতাদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী মাদক-চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অস্ত্রের মহড়া চালায়। এর ফলে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কে সময় কাটায়। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ক্যাম্পগুলোতে ১৭ ধরনের অপরাধের বিপরীতে ২ হাজার ৩০৯টি মামলা হয়েছে এবং এতে ৫ হাজার ২২৯ রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি রোহিঙ্গারা এখন কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের মতো বড় ধরনের অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমার থেকে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে অবৈধভাবে মাদক ও ইয়াবা পাচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। চলমান এ পরিস্থিতি পুরো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করছে।
ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণেও এসব সহিংস ঘটনা ঘটছে। ক্যাম্প এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে, যা বাংলাদেশের গড় জনসংখ্যার ঘনত্বের ৪০ গুণেরও বেশি। একটা ছোট এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বিভিন্ন ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এসব স্থানে সন্ত্রাসীদের দমন, গ্রেফতার এবং অস্ত্র উদ্ধার করার জন্য ক্যাম্পগুলোর ভেতরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালালে জনঘনত্বের কারণে অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা সবসময় বিবেচনায় রাখতে হবে।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোর ওপর থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এ পর্যন্ত ৩২ হাজার ৮৩২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। সব মিলে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে এবং দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চলমান রেখেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আরও নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করার ব্যবস্থা আছে। ভাসানচরে আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা দরকার, এ স্থানান্তর ব্যয়বহুল। রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়ার খরচ বহন করার জন্য বাংলাদেশ সরকার বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা চেয়েছে, তারা এ খরচ বহনে সহায়তা করবে বলে বাংলাদেশ আশা করে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ক্যাম্পের জনঘনত্ব কমিয়ে দ্রুত ভাসানচরে পাঠানোর কার্যক্রম নিতে হবে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এ উদ্যোগের গুরুত্ব ভালোভাবে বোঝাতে হবে এবং তাদের দ্রুত এ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকটের আর্থিক, নিরাপত্তা, সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। মানবিক কার্যক্রমের জন্য ব্যয় ছাড়াও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় প্রচুর জনশক্তি ও অর্থ ব্যয় করছে। কক্সবাজারে মোট ২০ লাখ ৯২ হাজার ১৬ একর বনভূমির মধ্যে ৩ হাজার ৫০০ একর ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে হারিয়ে গেছে। বন উজাড়ের ফলে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যহীনতা, ঘন ঘন ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ ও প্রাপ্যতা হ্রাস পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। সরকার তাদের প্রতি মানবিক সহায়তার দৃষ্টান্ত অব্যাহত রাখবে, তবে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে দেবে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়নের দুই হাজারের কিছু বেশি সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। যে হারে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, তাতে সীমিতসংখ্যক এপিবিএন সদস্য দিয়ে এ বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ সংকট দীর্ঘায়িত হলে ধীরে ধীরে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর চাপ ফেলবে, যা মোটেও কাম্য নয়। দ্রুত প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আঞ্চলিক দেশগুলোর সহযোগিতা নিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদের কারণে দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার এবং আশপাশের এলাকাগুলো নিরাপত্তার হুমকিতে রয়েছে। দীর্ঘদিন রোহিঙ্গারা একই জায়গায় থাকলে কক্সবাজারসহ পুরো পার্বত্য এলাকা হুমকির মুখে পড়বে এবং এ এলাকা অপরাধের ঘাঁটিতে পরিণত হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের নেওয়া কার্যক্রমগুলোকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই এবং এতে কেউ লাভবান হলেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। এর জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক ও সহযোগিতাপূর্ণ উদ্যোগ। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তাই এ সংকট সমাধানে কোনো এক পক্ষকে দোষারোপ না করে বহুমুখী এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সঙ্গে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ নিপীড়িত এ জনগোষ্ঠীর আশ্রয়দাতা হিসাবে সফলতার সঙ্গে ছয় বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আগ্রহী যে কোনো পক্ষকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়, তারা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার বিষয়ে কাজ করতে পারে; বাংলাদেশ যা করছে তার পাশাপাশি তারা সহায়তা বাড়াতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কাদের সক্ষমতা আছে, কীভাবে তা নিশ্চিত করা যায়, সেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। রোহিঙ্গারা যেসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তা জেনে নিয়ে কীভাবে ও কোথা থেকে তার ব্যবস্থা করা যায়, স্থায়ী সমাধানে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, কারা তা নেবে ও নিতে গেলে কী ধরনের সহযোগিতা দরকার-এগুলো জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত সমাধান ও কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সমালোচনা করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তাই চলমান এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আন্তরিক হলে সব মহলকে উপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত এ সংকট সমাধান হোক-এটাই প্রত্যাশা।
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক