Logo
Logo
×

বাতায়ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা হবে: ড. এএসএম মাকসুদ কামাল

Icon

আসিফ রশীদ ও মাহমুদুল হাসান নয়ন

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা হবে: ড. এএসএম মাকসুদ কামাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯তম উপাচার্য হিসাবে ৪ নভেম্বর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। এর আগে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), ডিন, প্রাধ্যক্ষ, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষা, গবেষণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং, সামগ্রিক পরিবেশ, কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাসহ নানা বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : আসিফ রশীদ ও মাহমুদুল হাসান নয়ন

যুগান্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯তম উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় আপনাকে অভিনন্দন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের দায়িত্ব গ্রহণের পর কী কী চ্যালেঞ্জ আপনার সামনে রয়েছে বলে মনে করেন?

অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। এর চ্যালেঞ্জও বহুমাত্রিক। যদিও আমরা প্রতিষ্ঠার ১০৩ বছর অতিবাহিত করছি। প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে দিনের পর দিন বহু সমস্যা এখানে পুঞ্জীভূত হয়েছে। সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন কাজের গতি ও সামগ্রিক স্বচ্ছতা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। বিভাগ, ইনস্টিটিউট, সেন্টার এবং আবাসিক হলগুলোর সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বড় কলেবর, তার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে কারিগরি দক্ষতা প্রয়োজন, তাতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত সময়ে মানসম্মত সেবা প্রদান করা একটি বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এজন্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশনের আওতায় আনার পদক্ষেপ নিয়েছি। কারিকুলাম মানসম্মত, প্রয়োজননির্ভর ও গবেষণাধর্মী করে তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত একাডেমিক অবকাঠামো গড়ে তোলাও চ্যালেঞ্জিং। এখানে যেমন আর্থিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তেমনি মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জও আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৯ অক্টোবর জাতির পিতাকে ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদানের দিন তার সমাবর্তন বক্তৃতায় গবেষণাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার পরামর্শ আমাদের দিয়েছেন, যা আমরা বাস্তবায়ন করব। জন্ম থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ ছিল গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি প্রদান করা। তাই গবেষণায় তেমন জোর দেওয়া হয়নি। আমরা আংশিকভাবে গবেষণায় অবদান রাখলেও এখনো বেশ পিছিয়ে। যে কোনো গবেষণা উৎপাদন ও সমাজকল্যাণমুখী হতে হবে। এজন্য যে গবেষণা পরিবেশ ও ইথিক্যাল ট্রান্সফরমেশনের দরকার তা আমরা শুরু করেছি। কিন্তু লম্বা পথ অতিক্রম করতে হবে। এজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক ও সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। বিষয়টি একটি চেইন সমীকরণের মতো। এসবের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা বড় চ্যালেঞ্জ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং চতুর্দিকে প্রবেশদ্বার থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা সংকট গভীরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ মূল সড়কগুলো সিটি করপোরেশন ও রোড অ্যান্ড হাইওয়ের আওতায়। তাই প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করাও কঠিন। সমন্বয় ও টিমওয়ার্কের মাধ্যমে যাবতীয় সমস্যার সমাধানে আমরা পদক্ষেপ নেব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের আদেশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অংশীজনের অংশগ্রহণের আইনগত বিধান রেখেছেন।

যুগান্তর : এর আগে আপনি উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?

ড. মাকসুদ কামাল : হিউম্যান ক্যাপিটাল গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রায়োগিক জ্ঞান ব্যবস্থাপনার জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা দরকার। কারিকুলামে দক্ষতা বৃদ্ধির যে বিষয়গুলো থাকা প্রয়োজন, তা অনেকাংশে এখন অনুপস্থিত। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ের জন্য আমাদের ল্যাবরেটরিগুলোর আরও আধুনিকায়ন দরকার। অন্যদিকে সামাজিক, কলা, ব্যবসায় শিক্ষা ও প্রশাসনবিষয়ক বিষয়গুলোর প্রায়োগিক জ্ঞান সৃজনের লক্ষ্যে যে আধুনিক পদ্ধতি অনুসৃত হওয়া প্রয়োজন তাতেও ঘাটতি আছে। এ বিষয়গুলো আমরা অ্যাড্রেস করা শুরু করেছি। সঠিকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, নির্দিষ্ট সময়ে ফল ঘোষণা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সম্পর্কের আরও উন্নয়নে আমরা নজর দিয়েছি। আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো উচ্চতর জ্ঞানের আদান-প্রদানের জন্য আরও মানসম্মত হওয়া প্রয়োজন। লাইব্রেরিতে পড়াশোনার পরিবেশ এবং ই-লাইব্রেরি সুবিধা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। ইনোভেশন ইকোসিস্টেম প্রায় অনুপস্থিত, যেটি উচ্চশিক্ষার একটি বড় উপাদান। সেদিকে আমরা নজর দেব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে জাতীয় পর্যায়ে যে নলেজ হাউজগুলো রয়েছে, যাদের মাঠপর্যায়ের জ্ঞান উল্লেখযোগ্য, তাদের সঙ্গে আরও যোগাযোগ বাড়ানো দরকার, যাতে পাঠ্যপুস্তক ও প্রায়োগিক জ্ঞানের মধ্যে আরও সমন্বয় সাধিত হয় এবং শিক্ষার্থীরা পঠন-পাঠনে আরও আনন্দ খুঁজে পায়। জ্ঞান আহরণ আনন্দদায়ক না হলে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় না। আমরা উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রেডিট ট্রান্সফার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক এক্রিডিটেশনের ব্যবস্থা করছি। এজন্য সিলেবাসেও পরিবর্তন আনা হবে।

নিও-লিবারেল গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে টিকে থাকতে হলে জ্ঞান ব্যবস্থাপনা ও জ্ঞান সৃজনে আমাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত মেধাবী ও পরিশ্রমী। আমাদের যে রিসোর্স রয়েছে, তার সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার মান আরও বাড়ানো যাবে। ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি সম্পর্কোন্নয়ন ও যথোপযুক্ত সরকারি সহযোগিতা পেলে শিক্ষার মান আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে পারব, এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

যুগান্তর : এক সময় যে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হতো, আজ তা বিশ্বের সেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও স্থান পায় না। এর কারণ কী? আপনি কি মনে করেন হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে?

ড. মাকসুদ কামাল : ব্রিটিশ শাসনামলে জন্ম নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ভবনগুলোর সঙ্গে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত মিল এবং এ অঞ্চলের বৃহত্তর ও অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হতো। র‌্যাংকিং যদিও করপোরেট কালচার, কিন্তু এর বাস্তবতা রয়েছে। ২০২৩ সালে ‘টাইমস হাইয়ার এডুকেশনের র‌্যাংকিং’য়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৬০১-৮০০ ব্যান্ডের মধ্যে ছিল। ইমপ্যাক্ট র‌্যাংকিংয়ে ৪০১-৬০০ ব্যান্ডে আমাদের অবস্থান। যে ক্রাইটেরিয়া বিবেচনায় র‌্যাংকিং করা হয়, তার মধ্যে মোটাদাগে রয়েছে-আন্তর্জাতিক পরিচিত (শিক্ষার মান ও সুনাম, শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত, ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষক ইত্যাদি), গবেষণার পরিবেশ (গবেষণা অবকাঠামো, গবেষণার সংখ্যা এবং গবেষণার উৎপাদনমুখিতা); গবেষণা মান (উদ্ধৃতি, জ্ঞানের জগতে প্রভাব ও নতুনত্ব ইত্যাদি); আন্তর্জাতিক আউটলুক (বিদেশি ছাত্র, কোলাবরেশন ও যৌথ গবেষণা এবং ইন্ডাস্ট্রি তথা প্রডাকশন হাউজের সঙ্গে সম্পর্ক)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতায় এ ক্রাইটেরিয়া পূরণে প্রয়োজন পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিকল্পনা, উচ্চশিক্ষায় সরকারি অঙ্গীকার ও তার বাস্তবায়ন এবং সব রাজনৈতিক শক্তির সহযোগিতা। একটি একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান আমরা প্রণয়নের পথে। সে আলোকে ভবিষ্যতে বাজেট চাইব। আমাদের সব সহকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম ওয়েবসাইটে না থাকার কারণে আন্তর্জাতিক পরিচিত অসম্পূর্ণ। মনে রাখা দরকার, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ওয়েলফেয়ার দেশগুলোর মতো প্রায় বিনা খরচে পড়াশোনা করেন। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি আমাদের থেকে শতগুণ বেশি। আমাদের ক্রমেই এ বিষয়গুলোও ভাবতে হবে। আমরা একটি সমন্বিত প্রয়াস শুরু করেছি, এটিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়কে মর্যাদার স্থানে উপনীত করা যাবে।

যুগান্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পিএইচডির মতো উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে যথাযথ সুযোগ পান না বলে অভিযোগ আছে। বলা হয়, এক্ষেত্রে মেধা নয়, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব কাজ করে বেশি। এ অভিযোগের বিষয়ে কী বলবেন?

ড. মাকসুদ কামাল : অভিযোগটি কাল্পনিক। আমাদের সহকর্মীদের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু ওভারসিজ বৃত্তি’ রয়েছে, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে পুনরায় চালু করেছেন। এ বৃত্তি ১৯৯৮ সালেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছিলেন। পরবর্তী জোট সরকার বৃত্তিটি বন্ধ করে দেয়। এ বৃত্তির আওতায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে তরুণ সহকর্মীদের উচ্চশিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রায় ১৭০ জন সহকর্মী এ বৃত্তি নিয়ে উন্নত দেশে পিএইচডি প্রোগ্রামে আছেন। কমনওয়েলথ বৃত্তি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাবৃত্তি এবং মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বৃত্তি নিয়েও অনেক সহকর্মী বিদেশি ডিগ্রিরত। প্রায় ৩৫০ জন তরুণ সহকর্মী এখন উন্নত দেশে ডিগ্রি অর্জন করছেন। এখানে রাজনৈতিক বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।

যুগান্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সময় না দিয়ে বাইরে অর্থাৎ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়তি আয়ের জন্য পাঠদান করে থাকেন বলে অভিযোগ অনেকদিনের। আবার কোনো কোনো শিক্ষক চাকরি বহাল রেখেই বিদেশে পাড়ি জমান, দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করেন এবং দেশে ফেরেন না। এতে করে পাঠদানের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ কি আপনি নেবেন?

ড. মাকসুদ কামাল : প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অননুমোদিতভাবে পড়ানোর বিষয়টি অতীতে প্রকট ছিল। আমরা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করেছি, এখন একজন শিক্ষকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যে কোনো একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে পড়ানোর সুযোগ আছে। উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষকরা বন্ড সই করে বিদেশে যান এবং ডিগ্রি শেষে ফিরে আসেন। যারা ফিরে আসেন না, দেনা-পাওনা পরিশোধসাপেক্ষে আইন অনুসরণ করে তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে, প্রয়োজনে গ্যারান্টারের বিরুদ্ধেও মামলা রুজু করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থানের সুযোগ নেই। বিনা ছুটিতে দেশের বাইরে অবস্থান করার প্রবণতা এখন নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে।

যুগান্তর : ২০২০ সালের মার্চে ডাকসু ও হল সংসদের সর্বশেষ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও তা হচ্ছে না। করোনার সময় যদি বাদও দেই, এরপরে তো নির্বাচন হতে পারত। ডাকসু নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার কারণ কী? আপনি কি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন?

ড. মাকসুদ কামাল : নেতৃত্বের বিকাশ ও সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে ডাকসু নির্বাচন প্রয়োজন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে ওঠে। ম্যানেজেরিয়াল দক্ষতাও আসে। সেই বিবেচনায় ডাকসু নির্বাচন হওয়া উচিত। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক মতৈক্য। ভবিষ্যতে ছাত্রসংগঠনগুলো এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা সচেষ্ট থাকব। সব পক্ষের সহযোগিতা পেলে অনুকূল পরিবেশে এ নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।

যুগান্তর : স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী নানা সংকটময় মুহূর্তে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাজনীতিতে মূল দলের হস্তক্ষেপ এবং অসাধু রাজনীতিকদের প্রভাব শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশের অন্তরায় বলে মনে করা হয়। আপনি কী মনে করেন?

ড. মাকসুদ কামাল : বাংলাদেশের ছাত্রসংগঠনগুলো প্রকৃতপক্ষে মূল দলের ছাত্র শাখা হিসাবেই কাজ করে। আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতি শুধু নয়, উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটিরই নিজ নিজ ছাত্র, যুব ও অন্যান্য সংগঠন রয়েছে। ছাত্ররাজনীতির স্বাতন্ত্র্য থাকা উচিত। ছাত্ররাজনীতি সব সময় শিক্ষার্থীদের স্বার্থে হওয়া উচিত। ছাত্রসংগঠনগুলোর উপলব্ধি হওয়া উচিত তারা যে প্রজšে§র নেতৃত্ব দিচ্ছে, এ প্রজন্ম বিশ্বায়নের যুগে বসবাস করছে। পৃথিবীর সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত তাদের কাছে থাকে। বর্তমান শিক্ষার্থীরা সহজেই অনুধাবন করতে পারে এ ছাত্ররাজনীতি তাদের জন্য কল্যাণকর কিনা, জ্ঞান ব্যবস্থাপনাকে আরও জোরদার করার জন্য নিবেদিত কিনা। যদি কোনো সংগঠন এসবের চর্চা করতে পারে, তারা শিক্ষার্থীদের বেশি পরিমাণে নজর কাড়তে পারবে এবং মূল দলের প্রভাব থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত থাকতে সক্ষম হবে।

যুগান্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব দেখছি। আগের সেই সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান অনেকটাই অনুপস্থিত। এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবেন?

ড. মাকসুদ কামাল : শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, বিশেষত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক পরিবেশ। এর ওপরে নির্ভর করে শ্রেণিকক্ষ কতটুকু ইন্টার‌্যাক্টিভ হবে। ইন্টার‌্যাক্টিভ এডুকেশন ছাড়া কখনোই উচ্চশিক্ষা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক কখনো অভিভাবক, কখনো বন্ধুত্বের মতো হওয়া উচিত, যাতে জ্ঞানের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো ভীতি কাজ না করে। নানাবিধ কারণে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এক ধরনের দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচিং ইভ্যালুয়েশনের জন্য একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করেছি, যেখানে ২১টি প্রশ্ন আছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়-একজন শিক্ষক যথাসময়ে শ্রেণিকক্ষে আসেন কিনা, পাঠদান পদ্ধতি ইন্টার‌্যাক্টিভ কিনা, ক্লাস বিষয়বস্তুর ওপরে নির্দিষ্ট কিনা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন থেকে শুরু করে ফল প্রকাশ যথাসময়ে হচ্ছে কিনা-এমন অনেক প্রশ্ন সেখানে আছে। টিচিং ইভ্যালুয়েশনের কাজটি সঠিকভাবে করতে পারলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বহুলাংশে কমে যাবে। আমরা এর বাস্তবায়ন অচিরেই শুরু করব। সহশিক্ষা কার্যক্রম আরও জোরদার করার পরিকল্পনা আমাদের আছে। এতে সম্পর্কের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে।

যুগান্তর : আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানের টেকনিক্যাল কমিটির সভাপতি ছিলেন। এর বাস্তবায়নে অগ্রগতি কতটুকু?

ড. মাকসুদ কামাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান বস্তুতপক্ষে একাডেমিক কার্যক্রমকে আরও প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। আমরা পরিবেশ ও গবেষণাবান্ধব একটি ফিজিক্যাল মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছি। এর পাশাপাশি একটি একাডেমিক প্ল্যান তৈরিতেও কাজ করছি। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ের ল্যাবরেটরিগুলোকে উচ্চতর গবেষণার জন্য গড়ে তোলা হবে। মাস্টারপ্ল্যান তিনটি ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৩০০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। গবেষণা ও ল্যাবরেটরির জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ইনস্টিটিউট মিলে ৯৬টি এনটিটি রয়েছে। ৫৬টি গবেষণা সেন্টার রয়েছে। মেডিকেল সেন্টারসহ অনেক সেবা প্রদানকারী অবকাঠামো আছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো সেবা দেওয়ার জন্য এখন সেভাবে উপযুক্ত নয়। এজন্য মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ধাপে মেডিকেল সেন্টার, নতুন হল তৈরি, লাইব্রেরি, শ্রেণিকক্ষ বাড়ানো এবং সেগুলোকে আধুনিক শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে সজ্জিত করার জন্য প্রথম ধাপে কাজ করা হবে। একাডেমিক ও অবকাঠামোগত মাস্টারপ্ল্যান সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে পঠন-পাঠন, জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সৃজনে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও মনোযোগ বহুলাংশে বাড়বে।

যুগান্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অবকাঠামো অপর্যাপ্ত। এ অবস্থার উন্নয়নে কী করবেন?

ড. মাকসুদ কামাল : গবেষণার জন্য বর্তমানে যে অবকাঠামো আছে, তা অপ্রতুল হলেও গবেষণা কার্যক্রম চলমান। তবে মানসম্মত গবেষণার জন্য গবেষণা অবকাঠামো, আধুনিক ল্যাবরেটরি ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো বিশেষভাবে প্রয়োজন। গবেষণার পরিধি আমরা বাড়িয়েছি। শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স, পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণা ও বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় শিক্ষকদের নিজস্ব গবেষণা ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের বহু বিভাগে মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের থিসিসওয়ার্ক ছিল না। ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী যেন মাস্টার্স পর্যায়ে গবেষণার সুযোগ পায়, তা একাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে মেধাবীদের উচ্চতর গবেষণার জন্য বৃত্তি দেওয়া হয়, আমাদের মেধা ওই দেশগুলোর উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটি ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু করতে যাচ্ছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেব। এক্ষেত্রে শর্ত থাকবে মানসম্মত গবেষণা, গবেষণালব্ধ ফল ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরসংবলিত জার্নালে প্রকাশ করতে হবে। গবেষণাগুলো থেকে আমরা পেটেন্ট তৈরির চেষ্টা করব। এগুলো নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যাতে কোলাবরেশন করা যায়, সেজন্য স্টার্টআপ স্টুডিও তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা কম্প্রিহেনসিভ রিসার্চ ইথিকাল ফ্রেমওয়ার্ক ও গবেষণার মৌলিকত্বের জন্য প্লেজারিজম নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। এভাবে গবেষণা শক্তিশালী করা গেলে বড় বড় প্রকল্পের উপযোগিতা যাচাই, বাস্তবায়ন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের ওপর যে নির্ভরতা আছে, তা থেকে ক্রমেই বের হয়ে আসতে পারব। জাতি হিসাবেও আমরা স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠব।

গবেষণার জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিষয়ক ডিসিপ্লিনগুলোর যেমন উন্নত ল্যাবরেটরি নেই, তেমনি ল্যাবরেটরি স্থাপনের জায়গারও অভাব রয়েছে। ব্যবসায় শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞানবিষয়ক ডিসিপ্লিনেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অপ্রতুলতা রয়েছে। অবস্থানগত কারণে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, কালচারাল নয়েজ, চতুর্দিক থেকে খোলামেলা পরিবেশ, নিরাপত্তার ঘাটতি ইত্যাদির কারণে বর্তমান ক্যাম্পাস গবেষণাবান্ধব নয়। তাই গবেষণা উপযোগী একটি ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা পূর্বাচলে ৫২ একর জমি রাজউক থেকে প্রাথমিক এলটমেন্ট পেয়েছি। সেখানে গবেষণার জন্য বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের আধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং একটি মেডিকেল ফ্যাকাল্টি ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ফ্যাকাল্টি যেমন রয়েছে, তেমনি গবেষণানির্ভর একটি হাসপাতাল আছে। পৃথিবীর সব প্রতিষ্ঠিত ও উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ফ্যাকাল্টি রয়েছে। পূর্বাচলে মেডিকেল ফ্যাকাল্টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিতে চাই। বাংলাদেশে মেডিকেল সায়েন্সে গবেষণা অন্যান্য শাখা থেকে তুলনামূলক কম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখানে অবদান রাখতে চায়। আশা করি, সরকার আমাদের সে সুযোগ করে দেবে।

যুগান্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অনেক অভিযোগ। নিয়োগ প্রক্রিয়া বিশ্বমানের করতে আপনার পদক্ষেপ কী হবে? কোনো নীতিমালা করবেন কি?

ড. মাকসুদ কামাল : শিক্ষক নিয়োগে অভিযোগ শুধু আমাদের দেশে নয়, বহু উন্নত দেশেও আছে। তবে কোথাও সহনশীল, আবার কোথাও একটু বেশি। আমাদের শিক্ষক নিয়োগ অতীতে খুব অস্বচ্ছ ছিল সেটা বলা যাবে না, যদিও বিভিন্ন কারণে কখনো কখনো পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা বহুলাংশেই নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমত প্রার্থীর ফল তথা একাডেমিক অর্জন দেখছি। দ্বিতীয়ত, ওই শিক্ষার্থীর ইন্টারভিউ দেখি, যেটি তার পারফরম্যান্স। তৃতীয়ত, নিয়োগপ্রত্যাশী গবেষণামনস্ক কিনা সেটি নিশ্চিত হতে তার পাবলিকেশন্স দেখি। চতুর্থত, একজন শিক্ষার্থীর আচার-ব্যবহার দেখা হয়। এগুলো দেখেই আমরা শিক্ষক নিয়োগ দেই। বর্তমানে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ। প্রয়োজনে আরও স্বচ্ছ ব্যবস্থা আমরা নেব।

যুগান্তর : দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষক সুনামের সঙ্গে অবদান রাখছেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে আমাদের উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে কাজে লাগানো যায় কিনা? শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখবেন কি?

ড. মাকসুদ কামাল : আমাদের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী দেশের বাইরে উচ্চতর গবেষণা ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করছেন। তাদের অনেককে আমরা জানি ও চিনি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে আমরা তাদের সহযোগিতা নিতে চাই। এজন্য সংশ্লিষ্ট ডিনদের বলা হয়েছে ওইসব অনুষদের যেসব সাবেক শিক্ষার্থী দেশের বাইরে গবেষণা ও শিক্ষকতায় আছেন, তাদের একটি তালিকা দেওয়ার জন্য। এডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসাবে তাদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে তাদের ফেরাতে আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো নীতিমালা করতে পারিনি। এজন্য আপাতত এডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসাবে নিয়োগ দিয়ে অনলাইনে প্ল্যাটফর্মে ক্লাস নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। আমাদের প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষক বিভিন্ন দেশে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য গবেষণার কাজ করছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে নিয়ে আমরা অনলাইনে যুক্ত হয়ে শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়নের পরামর্শ নিয়েছি। তারা দেশে এলে যেন উপযুক্ত পরিবেশে ক্লাস নিতে পারেন এবং গবেষণাগারে গবেষণা করতে পারেন, সেই সুযোগ আমরা দেব। বিদেশে শিক্ষকতা ও গবেষণারতদের সঙ্গে আমরা অনলাইনে সভা করে তাদের সহযোগিতা নেব।

যুগান্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন খুবই কম। বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী টানতে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি?

ড. মাকসুদ কামাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে একটি ফরেন স্টুডেন্ট অফিস চালু হয়েছে। এ অফিসের জন্য আমরা একটি ব্রুশিয়ার তৈরির কাজ করছি। বঙ্গবন্ধু ওভারসিস স্কলারশিপের আওতায় বিদেশি শিক্ষার্থীরা যেন আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আসে, সেজন্য আমাদের একটি চ্যানেল ওপেন করার চিন্তা আছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরিতে পাঁচজন ডিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আসলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে আকৃষ্ট করতে আমাদের মেথড অব ইন্সট্রাকশন মানসম্মত হতে হবে। এজন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি ম্যানুয়াল আমরা তৈরি করছি। সেটিকে অনুসরণ করে মেথড অব ইন্সট্রাকশন যতটুকু উন্নত করা যায়, সেটি আমরা করব। বলা আছে, মেথড অব ইন্সট্রাকশন ইংরেজি ভাষায় হতে হবে। কিন্তু এখনো অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষে সেটি অনুসরণ করা হয় না। যাতে শ্রেণিকক্ষেও আন্তর্জাতিক পরিবেশ থাকে, সেজন্য সিলেবাসেও কিছু পরিবর্তন আনার কথা আমরা ভাবছি। বিদেশি শিক্ষক টানতে আমাদের কোনো রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালা এখনো নেই। তবে বর্তমান নীতিমালার মধ্যে থেকে এডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসাবে আগ্রহী বিদেশি শিক্ষক আনতে আমরা ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি এবং কোনো কোনো বিভাগে নিয়োগও দেওয়া হয়েছে।

যুগান্তর : ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক অভিযোগ। সবুজ ও পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস গড়তে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি?

ড. মাকসুদ কামাল : পরিবেশবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমার প্রত্যাশা-এখানে সবুজায়ন হবে, ক্যাম্পাস পরিবেশবান্ধব হবে, গ্রিন বিল্ডিং থাকবে এবং অন্যরা আমাদের দেখে শিখবে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫-৪০ হাজার শিক্ষার্থী আছে। পাঁচ হাজারের ওপর কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। দুই হাজারের বেশি শিক্ষক আছে। এ পরিসরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বিচরণ করে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যতটুকু অপরিচ্ছন্নতা আছে, তার দায় যতটুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের, তার থেকে বেশি দায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন আগত বহিরাগতদের। জাতির চাহিদা মেটানোর জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্দিক থেকে খোলা রাখতে হয়েছে। বন্ধের দিনগুলোতে এবং বিকালে বিনোদনের জন্য অনেক মানুষ এখানে আসে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অনেক নোংরা হয়। উপরন্তু পরিচ্ছন্নতার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে এখনো গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রতিটি হলে একটি পরিবেশ ক্লাব গঠনের চিন্তা রয়েছে। প্রতিটি ডিন অফিসকেন্দ্রিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সকাল ৬টার মধ্যে যেন ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন থাকে-এ বিষয়ে ইতোমধ্যে স্টেট অফিসকেও নির্দেশনা দিয়েছি। আমরা যারা ক্যাম্পাসে থাকি, তাদেরও সচেতন হতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কাজ করবে, আমরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সার্টিফিকেট দেব। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়িত হলে আরও সবুজায়ন হবে। প্রায় ১৫ একর সবুজ এলাকা বাড়বে। ডেড-জোনগুলো ব্যবহার উপযোগী হবে।

যুগান্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যা নিরসন, গণরুম ও গেস্টরুম কালচার বন্ধ এবং শিক্ষার পরিবেশ ফেরাতে কী ধরনের পরিকল্পনা আছে?

ড. মাকসুদ কামাল : আমি যখন প্রায় ৩৯ বছর আগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হয়ে আসি, তখনো গণরুম কালচার ছিল। আমরা শুনেছি, তার আগেও এ কালচার ছিল। দেশের সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে এখানে আসে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক অসচ্ছল ছেলেমেয়েরাও ভর্তির সুযোগ পায়। আর্থিক অসচ্ছলতায় তাদের অনেকেরই রাজধানীতে মাথাগোঁজার মতো কোনো ঠাঁই থাকে না। এ কারণে তাদের হলে থাকতে হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় এতটাই মানবিক যে, সীমিত সক্ষমতার মধ্যেও শিক্ষার্থীদের আগলে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। এ কারণে অনেক কক্ষে ধারণক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থী থাকে। ছাত্রসংগঠন নিয়ন্ত্রিত গণরুম ছাড়াও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন অনেক শিক্ষার্থী নিজের অসুবিধা বিবেচনায় না নিয়ে জুনিয়রদের নিজ কক্ষে থাকার সুযোগ করে দেয়। আমি মাস্টার দা সূর্যসেন হলে ৬ বছর প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছি। শিক্ষার্থীদের বাস্তব অবস্থা আমার দৃষ্টিতে এসেছে। মূলত আবাসন সমস্যা সমাধান না হওয়ার কারণেই কথিত গণরুম-গেস্টরুম কালচার গড়ে ওঠে। মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় নতুন একটি ছাত্রী হল ও একটি ছাত্র হল নির্মাণ এবং পুরোনো হলগুলোর সংস্কারের প্রস্তাবনা আমরা দিয়েছি। এগুলো বাস্তবায়িত হলে ২-৩ বছরের মধ্যে আবাসন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছি। শিক্ষার পরিবেশ অতীতের যে কোনো সময়ের থেকে এখন কিছুটা হলেও বেশি।

যুগান্তর : লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের বসার জায়গার সংকুলান হয় না। বন্ধের দিনগুলোতেও লাইব্রেরি নিয়মিত সময়ের মতো খোলা রাখার দাবি অনেক শিক্ষার্থীর-এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ থাকবে কি?

ড. মাকসুদ কামাল : শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে চাইলে প্রত্যেক হলে লাইব্রেরি আছে, নির্দিষ্ট স্পেস আছে। প্রত্যেক বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে লাইব্রেরি আছে। ছুটির দিনে যেন হল, বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি ও সেমিনার কক্ষ খোলা রাখা হয়, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা এবং শনিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এখন খোলা থাকে। সেমিনার লাইব্রেরি খোলা রাখার জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের কাজে লাগাতে চাই, যার ফলে কিছু এমপ্লয়মেন্টের ব্যবস্থা হবে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, সায়েন্স লাইব্রেরিতে স্থান সংকুলান হয় না এটা সঠিক নয়। কারণ, বিসিএস চাকরির প্রস্তুতির জন্য বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে যান। সকাল থেকেই ব্যাগ দিয়ে লাইব্রেরির সিট দখল করে রাখেন। এতে বাড়তি চাপ পড়ে। এ অবস্থাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটি নিয়েও আমরা ভাবছি।

যুগান্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। তবে প্রায়োগিক ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে অনেকেই হোঁচট খাচ্ছে। প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না। এজন্য বিভাগগুলোর পাঠদান পদ্ধতির সংস্কার বা অন্য কোনো উদ্ভাবনী চিন্তা আছে কি?

ড. মাকসুদ কামাল : মেধার বিবেচনায় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই, বরং অগ্রসর। এ শিক্ষার্থীদের জন্য যদি প্রায়োগিক শিক্ষা আরও বেশি জোরদার করা যায়, তাহলে খুব সহজেই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা নেতৃত্ব দিতে পারবে। এজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম পরিবর্তনের পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে সিলেবাস, পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন হয়। আউটকাম বেজড কারিকুলামের মাধ্যমে নিড বেজড এডুকেশনের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিকল্পনা আমাদের আছে। তা না হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এ যুগে জনমিতির লভ্যাংশ আমরা পাব না। এজন্য সিলেবাসে স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মানবিক বিষয়গুলো অক্ষুণ্ন রেখে করপোরেট এজেন্সি ও ইন্ডাস্ট্রিগুলোর প্রয়োজনীয়তা সিলেবাসে যুক্ত করা হবে। অনেক বিভাগ ও ইনস্টিটিউট এ প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু করেছে। আমরা সবাইকে এর আওতায় নিয়ে আসব। আমরা ইতোমধ্যে ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকুভেশন ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছি। ইনোভেশন টিম বেশকিছু সৃজনশীল কাজ করেছে। আমরা উদ্ভাবনী চিন্তা ও কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পদক্ষেপ নিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে গবেষণা ও উদ্ভাবনীতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. মাকসুদ কামাল : ধন্যবাদ।

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম