বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়
ড. দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫-২৬ অক্টোবর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশন আয়োজিত প্রথম গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে যোগ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ব্রাসেলস সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম বৈঠকে উপস্থিত থাকা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একদিকে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, অন্যদিকে বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও জাপানের প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য রাখেন।
ইইউ কর্তৃক গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম সম্প্রতি চালু করা হয়েছে। ইইউ এটিকে একটি কৌশল হিসাবে উপস্থাপন করেছে। এটি বিশ্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একটি অভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। গ্লোবাল গেটওয়ে হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে যে ধরনের অবকাঠামো রয়েছে, যে ধরনের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যে ধরনের সমস্যা আছে, সেগুলো মোকাবিলা করার একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। সেই উদ্যোগটি এসেছে ইইউ থেকে এবং এটিকে কৌশল বলা হচ্ছে এজন্য যে, এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলকে যুক্ত করা হবে। সেখানে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করে বিশ্বের যোগাযোগ, সাপ্লাই চেইন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, আধুনিক টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করা হবে। গ্লোবাল গেটওয়ে ধারণার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, এটি টেকসই উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেবে, পাশাপাশি ইউরোপের যে মূল্যবোধ, তার ওপর আলোকপাত করবে।
ইইউর এ উদ্যোগটি আন্তর্জাতিক হলেও ইউরোপের একটি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করেই এটি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এখানে ছয়টি কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে-বিশ্বকে সবুজ জ্বালানি ও গ্রিন হাইড্রোজেনে রূপান্তর করা, শিক্ষা ও গবেষণা, ক্রিটিক্যাল কাঁচামালের ওপর জোর দেওয়া, যোগাযোগ করিডর নির্মাণ, স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা এবং ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণ করা। ইইউর এ উদ্যোগটি জি-সেভেনের ‘পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের’ সঙ্গেও যুক্ত এবং বলা যায়, এ দুটি উদ্যোগই প্রায় একই ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রহণ করা হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের গেটওয়েকে অনেক ব্যাপক পরিসরে বিবেচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে জি-সেভেন উদ্যোগটিতে মূলত অবকাঠামোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গ্লোবাল গেটওয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের বাইরেও অন্যান্য সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপরে আলোকপাত করা হয়েছে। ধারণাগতভাবে বিষয়টিকে এভাবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে গ্লোবাল গেটওয়ের একটি ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। এটিকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি বিকল্প হিসাবেও অনেকেই বিবেচনা করতে পারে। এই প্রথম গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের উদ্বোধনী বক্তৃতায় ইইউর প্রেসিডেন্ট ওরসোলা সরাসরি বলেছেন, এ উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে একটি বিকল্প বিশ্বের সামনে নিয়ে এসেছে এবং সেটি বিআরআই’র মাধ্যমে একচেটিয়া প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা। ফলে এটিকে ভূ-রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জায়গা থেকেও বিবেচনার সুযোগ আছে।
এ ফোরামে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বক্তব্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বিআরআই’র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, পাশাপাশি গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামেরও প্রতিষ্ঠাকালীন সভায় যুক্ত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির যে ভারসাম্য, সেটি আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতে দেখি। এ ভারসাম্য শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের যত অর্জন, যেমন বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতি, বাংলাদেশের জিডিপির আকার গত ১৫ বছরে ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে, দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে, একইসঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নেও ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে-এ বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ, যেটি কৌশলগতভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে এবং একইসঙ্গে এটি অর্থনৈতিক ও যোগাযোগের আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, যা আঞ্চলিক যোগাযোগের একটি অন্যতম বাহন। প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, এ অঞ্চলের স্থলবেষ্টিত যে অঞ্চল অর্থাৎ নেপাল, ভুটান ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল, তাদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। মিয়ানমার থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং তা মিয়ানমারের গণহত্যার কারণেই সংঘটিত হয়েছে। মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না এবং এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সংকট তৈরি হয়েছে এবং মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্ত লঙ্ঘন থেকে শুরু করে অনেক ধরনের উসকানি দিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে না গিয়ে বরং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখার এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুদ্ধের পথে না গিয়ে শান্তি ও সমঝোতার পথে কাজ করছে এবং সেভাবেই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছে। গ্লোবাল গেটওয়েকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটি বিশ্বে স্থায়ীভাবে শান্তি ও টেকসই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হতে পারে।
বলা যায়, বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতার দিকে যাচ্ছে। ইইউর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কিছুদিন আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশে সফর করার সময় এয়ারবাসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ চুক্তির আওতায় ১০টি সুপরিসর বিমান কেনা হবে, যার মূল্য প্রায় ৩.২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের উদীয়মান এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার জন্য এ এয়ারক্রাফট কেনার চুক্তি। এ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার দে ক্রুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার বেটেলের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করেছেন। ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তবে এ সম্মেলনের মাধ্যমে ইইউ থেকে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগের তথা বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো, ইইউর সঙ্গে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা এবং একে শুধু সাহায্য বা বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আরও ব্যাপক পরিসরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, যার জন্য বর্তমান সময়টি অত্যন্ত উপযুক্ত।
বস্তুত বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক বর্তমানে অনেক বেশি অংশীদারত্বমূলক এবং এটিকে একটি উইন উইন কাঠামোর মধ্যে বিবেচনা করা যেতে পারে এবং তা ঘটছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইইউর সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা হচ্ছে। এ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার একটি বড় বিষয় বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতি বাস্তবায়ন। এ জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার আলোচনা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ এবং ইইউ বিশ্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণে কাজ করতে পারে। ইইউ অঞ্চলে একটি বড় ধরনের শ্রম সংকট তৈরি হয়েছে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক প্রেরণের বিষয়ে কাজ করতে পারে। ২০২৩ সালের বিশ্ব বাস্তবতায় ইইউ তার নিজস্ব অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে এবং বিশ্বের তথাকথিত দ্বিমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি চর্চা, কৌশলগত সার্বভৌমত্ব বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনাময় উদীয়মান অর্থনীতির সঙ্গে, শক্তিশালী নেতৃত্বের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে এবং তা গোটা বিশ্বের জন্যই একটি ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
সার্বিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর ব্রাসেলস সফর বিশ্ব রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্মেলনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি অনুসরণ করে, তার আরেকটি নিদর্শন প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেছেন। ইইউর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করার অনেক সম্ভাবনা আছে এবং বাংলাদেশের অর্জন ও সম্ভাবনার কথা তিনি তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্রাসেলস সফর বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়