নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়াবে
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রথমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের একটা নাজুক অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইসরাইল-হামাস সংঘর্ষ। এর ফলে বৈশ্বিক সংকট আরও কত তীব্র হবে কে জানে! পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ভদ্র ভাষায় বলেছেন, অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে। এখন আমরা অভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। বহিরাগত সমস্যার সমাধান দিতে দিতেই আমরা নাকাল, অভ্যন্তরীণ সমস্যা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে! এ এক নতুন অনিশ্চয়তা, গভীর অনিশ্চয়তা। এ সমস্যার কারণ জাতীয় নির্বাচন, যা হওয়ার কথা ২০২৪ সালের শুরুতে। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন একটি রুটিন বিষয়-ক্ষমতা বদলের হাতিয়ার। কিন্তু বিরোধী দল এবং সরকারি দলের বর্তমান অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, কপাল আমাদের খারাপ। কে ক্ষমতায় আসবে, কে আসবে না এটা পরের কথা। ঠিক হবে আগামী নির্বাচনের পর। কিন্তু সেটা রাজনৈতিক বিষয়। এ মুহূর্তে সমস্যা দেখা দিচ্ছে অর্থনীতি নিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। ইতোমধ্যেই ২৮ তারিখে একদফা সমস্যা গেছে। বিরোধীদলীয় ও সরকারদলীয় পালটাপালটি সমাবেশ ছিল সেদিন। বিরোধীদলীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালের ভেতরেও আক্রমণ হয়েছে। একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। খবরে প্রকাশ, আরও দু-একজন নিহত হয়েছেন। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ২৯ তারিখ ছিল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। রাস্তায় গাড়ি ছিল কম। গাড়ি-বাস পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। স্কুল-কলেজ ছিল প্রায় বন্ধ। অফিসে লোক সমাগম ছিল কম। চারদিকে থমথমে একটা অবস্থা। কী হবে, কী হতে পারে-এ আলোচনা সর্বত্র। তবে কি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাবস্থায় আমরা ফিরে যাব? আবার কি চলতে থাকবে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি?
এ সবের মধ্যেই সর্বত্র আলোচ্য বিষয় প্রথমে দ্রব্যমূল্য, মানে মূল্যস্ফীতি। এ দুদিনেই দেখা যাচ্ছে পেঁয়াজ, আলু, ডিমের দাম বেড়েছে আবার। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের মতো এবং তা সরকারি হিসাবেই। এর মধ্যে আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের উপরে। টিসিবি খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করছে। সরকারি ধান সংগ্রহ অভিযান চলছে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের পরিবহণ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা কাঁচাবাজারে জিনিসপত্রের দাম আবার বৃদ্ধি করছে। ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। এ কারণে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাদের চোখে-মুখে অন্ধকার। বিরোধী দল ঘোষিত ৩ দিনের ‘অবরোধ’ কর্মসূচি চলছে। অবরোধ মানে সামগ্রিকভাবে সারা দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হওয়া। যদি এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হয়, বিরোধী দলগুলো যদি তাদের ‘সর্বাত্মক’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে, তাহলে বলাই বাহুল্য, অর্থনীতি হবে বিপর্যস্ত।
আগেই উল্লেখ করেছি, বর্তমান কর্মকাণ্ডের প্রথম বলি হবে দ্রব্যমূল্য। এর পরিণাম সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট। তারপর ক্ষতিগ্রস্ত হবে একে একে অর্থনীতির সব সূচক। আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, ব্যাংক আমানত, রাজস্ব আদায়, শিল্প উৎপাদন, খেলাপি ঋণ-সব ক্ষেত্রেই ঘটবে সূচকের অবনমন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশের উপরে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষ হয়েছে সেপ্টেম্বরে। এখন চলছে দ্বিতীয় প্রান্তিক। শুরু হয়েছে জাতীয় করমেলা, সংক্ষিপ্ত আকারে। এ মাসে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। কারণ এ মাসেই ‘রিটার্ন’ জমা দেওয়ার কাজ শেষ হবে। যদি পরিস্থিতি অস্বাভাবিক থাকে, তাহলে বলাই বাহুল্য, রাজস্ব আদায় বিঘ্নিত হবে। দেখা যাচ্ছে, জুলাই-সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি। ঘাটতি হচ্ছে ৮ হাজার কোটি টাকার উপরে। ফলে সরকারের ব্যয় সংকুলান হচ্ছে না। এর মধ্যে যদি চলমান সংকট দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে রাজস্ব পরিস্থিতি নাজুক হবে। সরকারি ব্যয় কম হচ্ছে রাজস্বের অভাবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) টাকা খরচ করা যাচ্ছে না। আগামীতে চলমান সংকটে এডিপির কাজ নির্বিঘ্ন হতে হবে।
ভীষণ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি আয় এবং রিজার্ভ পরিস্থিতি। টানা ৩ মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। ৪১ মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স ছিল সর্বনিু ১৩৪ কোটি ডলার। রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হলে হুন্ডিওয়ালারা আরও বেশি করে ডলার বিদেশে ধরে রাখার প্রবণতা দেখাবে। রপ্তানি আয়েও সুখবর কম। আমাদের পাঁচটি প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে চারটির রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে প্রথম প্রান্তিকে। তৈরি পোশাক খাত এখনো ঠিক আছে, তবে এতে প্রবৃদ্ধির হার নগণ্য। দেশের ভেতরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাস্তাঘাট বন্ধ থাকলে, চট্টগ্রাম বন্দরের কাজ বিঘ্নিত হলে রপ্তানির কাজ চলবে কী করে? এমনিতেই বিদেশিরা আগের মতো পণ্যের অর্ডার দিচ্ছে না। তারাও অপেক্ষা করছে-দেখছে আমাদের কী অবস্থা। এ অবস্থায় কি রপ্তানি বৃদ্ধির আশা করা যায়? ইতোমধ্যেই ২৮ ও ২৯ তারিখে বন্দরের কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। রাস্তাঘাট ছিল অস্বাভাবিক। আগামী দিনে কী হবে তা কেউ জানে না। এদিকে আমদানির অবস্থা কী? আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর দেশ। কাঁচামাল থেকে শুরু করে শিল্পপণ্য, মূলধনী পণ্য, ভোগ্যপণ্য-সবই আমরা আমদানি করি। এর মধ্যে চাল-গমও আছে। ডলারের অভাবে আমদানি বাণিজ্য সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বাজারে এর প্রভাব লক্ষণীয়। ২০২২ সালের জুলাই-আগস্টে পণ্য আমদানি হয়েছিল ১০৭১ কোটি ডলারের। ২০২৩-এ এসে একই সময়ে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৬৩ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। রপ্তানিতে স্থবিরতা, রেমিট্যান্স হ্রাস, বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের ধীরগতির ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারে এসে ঠেকেছে। অথচ বছর দেড়েক আগেও এর অঙ্ক ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এবং আমাদের প্রক্ষেপণ এক্ষেত্রে ছিল বেশ উঁচুতে। এই নাজুক ডলার পরিস্থিতিতে দিন দিন ডলারের দাম বাড়ছে। এখন প্রশ্ন, যদি ডলারের দাম আরও বাড়ে এবং বর্তমান রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে?
আগামী নির্বাচনের আরও ২ মাস বাকি। জাতীয় অর্থনীতির জন্য এ সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টা হচ্ছে অর্থবছরের প্রথম ৬ মাস। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় রাজধানীতে গাছ কাটা হয়েছে, রেলে আগুন দেওয়া হয়েছে, লঞ্চ-স্টিমারে আগুন দেওয়া হয়েছে, বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে, এমনকি স্কুলঘর পর্যন্ত আগুনে পুড়েছে। এ ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে বেশ কিছুদিন। ওই অনিশ্চয়তার দিন কাটিয়ে অর্থনীতি মোটামুটি চলছিল-যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বেশ কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। যদি ওইদিন আবার ফিরে আসে, তাহলে অর্থনীতির অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
এদিকে ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। আমানত বাড়ছে না, কিন্তু ঋণের চাহিদা বাড়ছে। প্রদত্ত ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। খেলাপি ঋণ দিন দিন বাড়ছে। বহু ব্যবসা বন্ধ হয়ে আসছে। ছোট ছোট ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। মানুষ টাকা ব্যাংকে রাখতে চাইছে না। দেশে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় এবং তা অব্যাহত থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষ আরও ব্যাংকবিমুখ হবে। সরকার এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ রয়েছে। যদি নতুন আমানত না আসে, তাহলে ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দেবে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের কর্মহীনতা বাড়ছে। রিকশাওয়ালাসহ এ ধরনের শ্রমজীবীদের দৈনিক রোজগার হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে এখন কাজ নেই। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পেলে; হরতাল-অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হবে। কর্মহীনতা বাড়বে। মানুষের রোজগার আরও কমবে। ফলে গরিব আরও গরিব হবে। লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নতুন করে চলে যাবে। মধ্যবিত্ত ভীষণ কষ্টে পড়বে। সবাই খরচ কমাচ্ছেন। কিন্তু আয়হীন অবস্থায় খরচ কমানোর আর কোনো সুযোগ নেই। ভোগ কমানোর উপায় নেই। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিশুরা, গ্রামের ছেলেমেয়েরা। তারা এমনিতেই পুষ্টির অভাবে ভুগছে। যদি রাজনৈতিক সংকট অব্যাহত থাকে, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
দেখা যাচ্ছে নির্বাচন নিয়েই সমস্যা। দুঃখের কথা, স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হতে চলল, আজও আমরা নির্বাচনি ইস্যুটার ফয়সালা করতে পারলাম না। সংবিধান ক্ষতবিক্ষত। এভাবে একটি জাতি এগোতে পারে না। দৃশ্যত উন্নতি ঘটতে পারে, কিন্তু তা টেকসই হওয়া কঠিন।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়