এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার ঘনত্ব দেশে দিনদিন বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে ডেঙ্গু ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহার। বিশেষজ্ঞরা বলেই চলেছেন মশা দমনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগের কথা।
সেই সূত্র ধরেই বলছি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগের শুরুতে যা নির্ধারণ করা প্রয়োজন তার কথা। এডিস মশার জীবনচক্র চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। তা হলো-ডিম, লার্ভা, পিউপা ও এডাল্ট। এ চারটি ধাপের তিনটি ধাপই অতিক্রান্ত হয় পানিতে। আর পানিতে অতিক্রান্ত তিনটি ধাপের সবচেয়ে দুর্বল ধাপ হলো লার্ভা। এই লার্ভা আবার চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। ১ম ইন্সটার, ২য় ইন্সটার, ৩য় ইন্সটার ও চূড়ান্ত ইন্সটার। এ চার ধাপের লার্ভার মধ্যে আবার ১ম ইন্সটার সবচেয়ে বেশি দুর্বল ধাপ। ডিম ফোটার পর এ ধাপটি ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তারপর খোলস পরিবর্তন (মন্টিং) করে ২য় পর্যায় বা ইন্সটারে পৌঁছে। এভাবে চারটি পর্যায় পার করে পিউপাতে পরিণত হতে ৬-৭ দিন সময় লাগে।
এ লার্ভার পর্যায়ে এরা অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে। জলাধারে পানিতে সামান্য ঢেউও এরা অনুভব করতে পারে, এমনকি পানির উপরিভাগ দিয়ে কোনো ছায়া অতিক্রম করলেও এরা সংবেদনশীল হয়ে জলাধারের তলদেশে অবস্থান নেয়। তাই লার্ভি সাইড প্রয়োগের সময় অবশ্যই এ বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি। আর সে জন্যই প্রজনন স্থল বা জলাধারের পরিমিতি (আকার) সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান পরিকল্পনা প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। বিভিন্ন ধরনের ওয়েট কনটেইনারের পরিমাপ ও অবস্থান তাদের মশা উৎপাদনশীলতার হারকে প্রভাবিত করে। আর তাই এ উৎপাদনশীলতার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করেই লার্ভা নিধন পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ যেসব ফ্যাক্টর জলাধার বা পানি ধারণ পাত্রে মশক উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, সেসব ফ্যাক্টর অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা পানি সংরক্ষণ করতে বাধ্য হয়। সেক্ষেত্রে কী ধরনের পাত্রে পানি ধরে রাখা হচ্ছে-পাত্রটি কি ঢাকনাযুক্ত, নাকি ঢাকনাবিহীন ইত্যাদি। আবার এ জমে থাকা পানি ব্যবহারের পর সম্পূর্ণরূপে পাত্রটি খালি করে সঠিকভাবে ডিটারজেন্ট বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার ও শোধন করা হচ্ছে কিনা, তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
কী ধরনের উপাদান দিয়ে জলাধার তৈরি তার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সাধারণত সাত ধরনের উপাদানে তৈরি কৃত্রিম পাত্রে মশার উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে। সেগুলো হলো-প্লাস্টিক, রাবার, ধাতব, সিমেন্ট, সিরামিক, কাচ, মাটি ইত্যাদি। উপাদানের ওপর ভিত্তি করে পাত্রগুলোর প্রাচুর্যতার স্থান নির্ধারণ করে যদি লার্ভি সাইড প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়, তাহলে অবশ্যই সফল ও আশানুরূপ ফলাফল মিলবে।
কৃত্রিম পাত্রের পাশাপাশি প্রাকৃতিক মশক উৎপাদন ক্ষেত্রগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করা খুবই জরুরি। কারণ গাছের ছিদ্র, বাঁশের স্টাম্প বা পাতার এক্সাইলের মধ্যে জমে থাকা পানি এডিস মশার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এখন ডেঙ্গু আর শহরের কোনো রোগ নয়। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস। আর ভাইরাসের বাহক এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রও সমানতালে গ্রামে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামের মানুষ আগে চাপকল ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় পানির অভাব পূরণ করত। বর্তমানে চাপকলের পরিবর্তে যেমন সাব-মার্সিবল পাম্প ব্যবহার হচ্ছে, একই সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে মানুষ পানি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করে জমানো পনির পরিসর বৃদ্ধি করেছে। আবার গ্রামের মধ্যেও পাকা ও সেমিপাকা বাড়িঘরের সংখ্যা আগের তুলনায় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব বাড়ি তৈরির সময় নিচের ফ্লোর পানিতে ডুবে থাকার কারণে মশকের প্রজনন স্থানের পরিসর ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে শহরের সঙ্গে গ্রামের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাই ভাইরাস ও মশা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বেড়েছে। কারণ এডিস মশার ডিম ডেসিকেশন প্রতিরোধের মাধ্যমে ডিমের সজীবতা এক বছরের অধিক সময় পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রাখতে পারে। আর এ সুবিধায় মশার ডিম বিভিন্ন প্রকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে ধুলাবালির সমন্বয়ে মিশে শহর থেকে সহজেই প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে পারে। শহরে শুধু এডাল্টি সাইড ও লার্ভি সাইড ব্যবহার করা হয় নির্দিষ্ট মশা ও লার্ভাকে নিধন করার জন্য। কিন্তু গ্রামে বিভিন্ন ধরনের পেস্টিসাইড, ফানজিসাইড, হার্বিসাইড, একারি সাইড ইত্যাদি বিষাক্ত পদার্থের যথেচ্ছ ব্যবহার মশার প্রজননক্ষেত্রকে আগে থেকেই প্রতিরোধী করে তুলেছে। তাছাড়া উপরিউক্ত বিষাক্ত পদার্থগুলো মশার লার্ভার প্রিডেটর ও প্যাথোজেনকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করে মশার লার্ভার জন্য একেবারেই অভয়ারণ্য তৈরি করে রেখেছে।
আরও একটি ভয়ের ব্যাপার হলো, গ্রামের মানুষ বেশির ভাগ সময় খালি গায়েই থাকতে পছন্দ করে। তারা কখনই মশকুইটো রিপেলেস্ট ব্যবহার করে না। তাই ভাইরাসের প্রসার দ্রুতই ঘটার আশঙ্কা অনেক বেশি।
সব বিবেচনায় গোটা দেশ আজ অজানা আশঙ্কায় নিপতিত। যারা পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের কাজে ভূমিকা রাখছেন, তাদের অবশ্যই যথাযথভাবে মশার প্রজননক্ষেত্রের সঠিক পরিমিতি মাথায় রেখেই কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে নির্ভুল পরিসংখ্যান ও পরিমিতির একমাত্র নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেন মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদরা। আর এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে পারে গণমাধ্যম। তাই সবার সমন্বিত অংশগ্রহণেই দূরীভূত হবে শঙ্কা; আসবে সুদিন।
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)