Logo
Logo
×

বাতায়ন

আমদানিনির্ভর হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে!

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমদানিনির্ভর হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে!

যুগান্তরে প্রকাশিত সবশেষ লেখায় আলুর দামের প্রসঙ্গে বলেছিলাম, কিছু আলুও কি আমদানি করতে হবে? এরপর সপ্তাহখানেকও যায়নি, সরকারকে আলুর দাম বেঁধে দিতে হলো। সঙ্গে ডিম ও পেঁয়াজের। বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে সুফল মেলে কি? সেটা কার্যকর করতে তোড়জোড় করা হলে হিতে বিপরীতও ঘটে থাকে। মাত্র কদিনেই কিন্তু দেখা গেল, সুফল তেমন মিলছে না। বাজার পরিদর্শনকারীরা চলে গেলেই আবার ‘স্বাভাবিক দামে’ বেচতে শুরু করছে ব্যবসায়ীরা। তাদের বক্তব্য-কম দামে আনতে না পারলে কমে বেচব কিভাবে? সঙ্গে অন্যান্য খরচও তো আছে।

খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যেও অতিমুনাফার প্রবণতা রয়েছে অবশ্য। এদিকে পাইকার, আমদানিকারকরা কম হারে মুনাফা করলেও একযোগে বেশি বিক্রি করায় তাদের অন্যভাবে পুষিয়ে যায়। তাদের মধ্যে গিয়ে সরকারি লোকজনকে চোটপাট করতেও দেখা যায় কম। এবার অবশ্য হিমাগারে আলু বেচাকেনার খোঁজ নিতে গেছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি। স্বভাবতই কিছু অনিয়ম খুঁজে পেয়েছেন। কিছুদিন আগে ডাব ব্যবসায়ীরা নজিরবিহীন কাণ্ড করেছিলেন ডেঙ্গু রোগীর স্বজনদের টার্গেট করে। অবনতিশীল ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে ডাবের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েও গিয়েছিল। হুজুগে কোনো কিছুর চাহিদা দ্রুত বাড়লে তার দাম সেভাবেই বেড়ে যায়। ডাবের ক্ষেত্রে এটা হয়েছিল। আমরা দেখেছি এ ব্যাপারেও ভোক্তা অধিদপ্তরকে তৎপর হতে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত। যেসব পরিবারে করোনার চাপ গেছে, তাদের মধ্যে আবার ডেঙ্গু হানা দিলে চিকিৎসা ঘিরে বিপদে পড়ার কথা। বিশেষত বেসরকারি হাসপাতালে গেলে খরচের কোপ গিয়ে পড়ছে পরিবারগুলোর ওপর। অনেককে গ্রাম থেকে রোগী নিয়ে আসতে হচ্ছে রাজধানীতে। আমরা তো সেবা খাতকে শহরাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করেছি। খাতটি এ মুহূর্তে রোগীর চাপ নিতেও ব্যর্থ।

এ অবস্থাতেই আবার দেখা যাচ্ছে নিত্যপণ্যের দামে নতুন করে ঊর্ধ্বগতি। সরকার কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও সেটা কার্যকর করা যাচ্ছে না। পোলট্রি ডিমের ক্ষেত্রে দাম বেঁধে দেওয়ার পর আবার এটা আমদানির অনুমতি দিতে হলো। আপাতত চার কোটি পিস আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠানকে। এরা ক’মাস আগে ডিম আমদানির অনুমতি চাইলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্মত হয়নি। তখনো ডিমের বাজারে থেকে থেকে বাড়ছিল দাম। ব্যবসায়ীরা অনেক সময় ভালো বুঝতে পারে পরিস্থিতি। বুঝতে পেরেই বোধহয় আমদানির অনুমতি চেয়েছিল। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে একজন ব্যবসায়ী। তিনিও কিছুদিন আগে বললেন, প্রয়োজন হলে ডিম আমদানি করা হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেছিলেন, এর প্রয়োজন নেই। ডিমে আমরা উদ্বৃত্ত। আমরা তো আলুতেও উদ্বৃত্ত বলে দাবি করা হয়। সীমিতভাবে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর আলুর বাজারও গোলমেলে দেখে এখন বলা হচ্ছে, ‘প্রয়োজনে বর্ডার খুলে দেওয়া হবে!’

বর্ডার তো আর খুলে দেওয়া যায় না। আর খুলে দিলেই দরকারি জিনিসপত্র আসতে শুরু করবে না। আমরা যা আনতে চাই, তারা ওই সময়ে সেটা নাও দিতে পারে। তখন দূরের দেশ থেকে আনতে হয়। সেক্ষেত্রে সময় লাগে বেশি; খরচও। যেমন বলা হচ্ছে, ভারত থেকে ডিম আনা না গেলে আজারবাইজান থেকে আনতে হবে। ওখান থেকে আর কী কী আনি? এমন অনেক দেশ তো আছে, যাদের সঙ্গে আমাদের ঠিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই। আজারবাইজান থেকে আমদানি প্রক্রিয়া নাকি জটিল। যা হোক, কিছু ডিম আমদানি করা হবে-এটা মূলকথা। আমরা যে কখনো ডিম আমদানি করিনি, তা অবশ্য নয়। সংকট উপস্থিত না হওয়ায় হয়তো ভুলে গিয়েছিলাম, ২০১২ সালে দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় কিছু ডিম আনতে হয়েছিল। তাতে বাজার শান্ত হয়ে আসে। তবে এবার বাজার কতটা শান্ত হবে, বলা মুশকিল। কারণ ডিমের উৎপাদন নাকি অনেক কমে গেছে। এ অবস্থায় আবার চাহিদা বেড়ে গিয়ে থাকলে দাম তো বাড়বেই।

দীর্ঘ করোনাকালে ডিমের দাম কম ছিল। সেটা বেশিদিন আগের কথাও নয়। তখন কি চাহিদা কমে গিয়েছিল? নাকি এর পরে বেশকিছু খামার বন্ধ হয়ে যায়? ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম কিন্তু দীর্ঘদিন বাড়েনি। এ অবস্থায় নাকি কোনোমতে টিকে ছিল ছোট খামারিরা। বড়দের কথা আলাদা। তাদের উৎপাদনশীলতা বেশি। একসঙ্গে তারা মুরগির বাচ্চা আর ফিডের ব্যবসাও করে। একটায় না হলেও অন্যটা দিয়ে পুষিয়ে যায়। যা হোক, দফায় দফায় তাপপ্রবাহেও নাকি মুরগি মারা গেছে অনেক। তাপপ্রবাহে মানুষের কষ্ট, তাদের রোজগার হ্রাসের কথা আমরা বলি। কিন্তু মুরগির খামারিদের অনেকে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা অত খেয়াল করি না। এখন ডিমের ঘাটতি সামনে আসায় বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। এও বলা হচ্ছে, প্রয়োজনে বেশি করে আমদানির ব্যবস্থা হবে। তবে এ সূত্রে বার্ড ফ্লুসহ রোগব্যাধি যেন না আসে, সে শর্ত মানতে বলা হয়েছে। দ্রুত আর অপেক্ষাকৃত সস্তায় ডিম আমদানি সম্ভব হলেও ভারতের একাধিক রাজ্যে বার্ড ফ্লুর উপস্থিতি রয়েছে। সেটা এখানে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া যাবে না। তাই ভালো হতো আমদানি করতে না হলে। বরং আলু আমদানি কিছুটা নিরাপদ। রাশিয়ায় আলু রপ্তানি অবশ্য আটকে গিয়েছিল আমরা এর মান রাখতে পারিনি বলে। তাই আলু আনলেও কিছু সতর্কতা মেনেই কাজটি করতে হবে।

আলুর উৎপাদন-সংক্রান্ত তথ্যেও নাকি বাড়াবাড়ি রয়েছে। পেঁয়াজের উৎপাদনও আমরা বাড়িয়ে বলেছিলাম বলে খবর ছিল। এর হিসাব তো যথাযথভাবে করা হয় না। এসব পণ্যে অপচয় বেশি। বীজ হিসাবে সংরক্ষণের জন্যও কিছুটা রেখে দেওয়া হয়। পেঁয়াজের মতো সবজি শুকিয়েও কমে যায়। আবার চাহিদার হিসাব করতে গিয়ে দেশে উপস্থিত রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যের জোগান দেওয়ার বিষয়টি নাকি অনেক সময় আমরা বিবেচনায় নিই না। সরকারও রেশন কার্যক্রম চালাতে কিছু খাদ্যপণ্য কেনে। একটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির চাপে অন্যটির চাহিদা বেড়ে গেল কিনা, সেটাও দেখতে হয়। যেমন, ডিমের চাহিদা বাড়তে পারে মানুষ গোমাংস কিনতে পারছে না বলে। ব্রয়লারের দাম মাঝে হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। তখন চাষের মাছের দামও বেড়ে যায় এর চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল বলে। প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণে মানুষকে তো কিছু না কিছু খেতে হয়। কাঁচাবাজারে গিলা-কলিজা, এমনকি মুরগির পা বিক্রি হতে দেখা যায়। দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হলে এসবের চাহিদা বাড়ে। আলুর দাম যে এবার এতটা বাড়ল, তার কারণ হতে পারে গ্রীষ্মকালীন সবজির চড়া দাম। শীতকালীন সবজি উঠতে অনেক দেরি। অবশ্য কিছু সবজি আছে-সব মৌসুমেই কমবেশি মেলে। তবে আলু উঠতে আরও তিন-চার মাস।

এবার আলুতে কৃষক কি কিছু মুনাফা করতে পেরেছিল? হিমাগারে যারা আলু রেখে মুনাফা করে, তাদের মধ্যে কিছু কৃষকও থাকে। তবে তারা সম্পন্ন কৃষক। তারা বীজের জন্যও আলু সংরক্ষণ করে। আলুর দাম গেল বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া দেখে দুঃখ হতে পারে ভেবে যে, গরিব কৃষক যদি এর অর্ধেকটাও পেত! তার তো উৎপাদিত খাদ্যশস্য ধরে রাখার সুযোগ নেই। দ্রুতই তার নগদ অর্থ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের কারণে কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা, সেটা অবশ্য খতিয়ে দেখা চাই। কৃষক পরিবারের অনেক সন্তান তো বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাচ্ছে। তাতে ভোগব্যয় শুধু নয়, সঞ্চয়ও বাড়ছে গ্রামে। কৃষিতে এর প্রভাব জানা প্রয়োজন। পণ্য ধরে রাখার সুযোগ যদি এ সুবাদে তার বেড়ে গিয়ে থাকে, সেটা সুখবর।

আমাদের কিছু কৃষক কিন্তু বাণিজ্যিক চাষাবাদে ঝুঁকছে। বিচিত্র পণ্য উৎপাদন করছে তারা-মুনাফা বিচার করে। এবার আলুর দাম বৃদ্ধি, এমনকি এটা আমদানি করতে হতে পারে বলে আওয়াজ কৃষককে আরও বেশি আলু ফলাতে আগ্রহী করে তুলতে পারে। তবে আমাদের আলুর উৎপাদন ব্যয় নাকি বেশি। এটা কমাতে উদ্যোগী হতে হবে। খালি উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, কম ব্যয়ে ফসল ফলাতে পারতে হবে। আমরা তো গোমাংসের উৎপাদন বাড়িয়ে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হয়েছি। কিন্তু খামারে গরু পালন যে ব্যয়বহুল, সেটা খেয়াল করিনি। সে কারণে মাংসের দাম এত বেড়েছে যে, সহনীয় দামে মানুষকে খাওয়াতে মহিষের মাংস আমদানিতে জোর দেওয়া হচ্ছে এখন।

আমদানিনির্ভর হওয়ার প্রশ্নে সতর্কও হতে হবে। বিশেষত জরুরি খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেবে ঝুঁকি। যেমন, চালের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর হওয়া যাবে না। এতে আমরা ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলে যে দাবি করি, তা কিন্তু ঠিক নয়। কিছু চাল আমরা আমদানি করি। গম তো সিংহভাগ আমদানিই করতে হয়। ভোজ্যতেল ও চিনির প্রায় পুরোটা আমদানি করি। এ দুটি পণ্য আবার আনে মাত্র কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে সিন্ডিকেশনের প্রবণতা থাকা স্বাভাবিক। গম এনে যারা আটা-ময়দা বানায়, তারাও এরাই। বিশ্ববাজারে এমন বেশকিছু পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এলেও দেশে কেন সেভাবে কমছে না, এর ভালো ব্যাখ্যা নেই। ডলারের চড়া দামের কথা বলে অবশ্য একটা জবাব দেওয়ার চেষ্টা থাকে, যা পুরোটা কভার করে না। দেশে পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধি সব ধরনের পণ্যের দামে প্রভাব ফেলছে, সেটাও সত্য। পণ্য বাজারজাতকরণে বেশি বেশি হাতবদল এবং পথেঘাটে চাঁদাবাজির ঘটনাও আড়াল করা যাবে না। সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সবখানেই। এর অভাবে ব্যাংক আর জ্বালানি খাতের মতো পণ্যবাজারও অস্থির হয়ে উঠতে পারে।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম