কোথায় শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ও মানসম্পন্ন শিক্ষা?
মনজু আরা বেগম
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একটা দেশ বা জাতির মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। বলা যায়, সভ্যতা বিকাশের মূল হাতিয়ারই শিক্ষা। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে দেশ যত বেশি এগিয়ে, সে দেশ বা জাতি তত বেশি উন্নত। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানে শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি নয়। মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রের অগ্রগতি আশা করা যায় না। সুশিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন প্রথমত পারিবারিক শিক্ষা এবং দ্বিতীয়ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার সুস্থ সুন্দর পরিবেশ। প্রাথমিক শিক্ষাটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে সন্তানরা যা শিখবে তাই পরবর্তী জীবনে প্রতিফলিত হবে। তাই প্রাথমিক শিক্ষার ভিতটা মজবুত করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষিত হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, ভূরিভূরি জিপিএ ফাইভ পেয়ে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ভালো ভালো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছুটছে। মা-বাবাও সন্তানদের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করছে, কিন্তু সত্যিকার মানুষ হিসাবে কজন বেরিয়ে আসছে? আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের নিয়মশৃঙ্খলা, আচার-আচরণ, পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান, নাগরিক সচেতনতা তৈরি, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কীভাবে সেবা যত্ন, সম্মান প্রদর্শন করবে, একজনের বিপদে অন্যরা কীভাবে এগিয়ে আসবে ইত্যাদি ছোট ছোট সাধারণ বিষয় শেখানো হচ্ছে কিনা সেদিকে সুদৃষ্টি রাখা অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য শুরু হয় সেই প্রাথমিক স্তর থেকে। জীবনের শুরুতেই তারা একটা বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাকাঠামোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের সংবিধানে ১৭নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ কিন্তু সংবিধানের সে ধারা কি যথাযথভাবে কার্যকর করা হচ্ছে? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে। টকশো হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শিক্ষার উন্নয়ন ও মানের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা অনেক পেছনে পড়ে আছি। আমাদের শিক্ষা পাশ-ফেলের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রকৃত শিক্ষা বা জ্ঞানার্জন হচ্ছে না। পাশের সংখ্যা বাড়ছে, জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত বা জ্ঞানী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমছে। যার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়তই পাচ্ছি। সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। একটা ভালো রেজাল্ট, একটা ভালো সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য অভিভাবকরা হন্যে হয়ে ছুটছেন, সন্তানদেরও সেই শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞানার্জন করছে কিনা, তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে কিনা, সেটা দেখার বা বোঝার মতো সময় বা মানসিকতা আমাদের অনেকেরই নেই।
আমরা সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্নীতি স্বজনপ্রীতিসহ নষ্ট রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছি। এ অবস্থা বা পরিবেশের মধ্যে থেকেও অনেক ছেলেমেয়ে বাবা মায়ের সুষ্ঠু তদারকিতে সত্যিকার অর্থে জ্ঞানার্জন করে বেরিয়ে আসছে, কিন্তু তাদের সেই মেধাকে দেশে যথাযথ ক্ষেত্রে এবং যথাযথভাবে কাজে না লাগানোর ফলে অনেকে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। এর ফলে দেশ তার মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ ও জ্ঞানী সন্তানদের হারাচ্ছে। এভাবে দেশ একসময় মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হবে। এছাড়া প্রবীণ বয়সে বাবা-মায়েরাও সন্তানদের সেবাযত্ন বা তাদের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার কারণ ইন্টারনেট’ শীর্ষক দৈনিক যুগান্তর কর্তৃক প্রকাশিত এক জরিপে জানা গেছে, জীবনে কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয় ৭২.২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ৮.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, তাদের মানসিক সমস্যার পেছনে ইন্টানেটের ভূমিকা রয়েছে। ইন্টারনেটে সময় ব্যয় তাদের স্বাভাবিক জীবনে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এদের অনেকেই ইন্টারনেটে পর্নো ছবি দেখে, গেম খেলে, সাইবার ক্রাইম করে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন, দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু শিক্ষিতের হার কমছে। শিক্ষার মান, শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতাবহির্ভূত কার্যকলাপ, পাঠদান পদ্ধতি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে অনেকে ড্রপ আউট হয়ে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, অসামাজিক কার্যকলাপ করছে, মাদকে আসক্ত হচ্ছে। ফলে জীবনের শুরুতেই তারা অন্ধকার জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে। আমরা উন্নত দেশগুলোর অনেক কিছুই অনুকরণ করি। কিন্তু আগামী প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে তাদের উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থাকে অনুকরণ বা অনুসরণ করছি না। এর একটা কারণ হতে পারে, আমাদের যারা নীতিনির্ধারক, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন বা থাকেন, তাদের অধিকাংশের সন্তানরাই দেশের বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করছে। দেশে শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষার মান উন্নত হলো, না রসাতলে গেল এসব নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। খুব কমসংখ্যক ছেলেমেয়েই অভিভাবকের সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠছে। যেসব সন্তান সুন্দরভাবে গড়ে উঠছে তাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু দেশের বিশালসংখ্যক ছাত্রছাত্রী-ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত নই। এরা পরিবার বা সমাজের সম্পদ না হয়ে যে বোঝা হয়ে উঠছে, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নষ্ট বা ধ্বংস করার একটি অন্যতম কারণ। নষ্ট রাজনীতি ছাত্রছাত্রীদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অর্থ আর অস্ত্র দিয়ে গডফাদাররা নিরীহ কোমলমতি সন্তানদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। আর নিজেদের সন্তানদের এসব নোংরা রাজনীতির অসুস্থ পরিবেশ থেকে দূরে রাখার জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমাদের মধ্যে দেশাত্মবোধের অভাব। আমাদের কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। যা বলি তা করি না, আর যা করি তা বলি না। সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার শপথবাক্য পাঠ করেছে। যা সত্যি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ প্রতিষ্ঠানে সেরা এবং মেধাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরাই লেখাপড়া করতে আসে। এসব মেধাবী ছেলেমেয়ে তাদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে পরিবার এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। রাজনীতির নামে আর কোনো আবরারকে, বিশ্বজিৎ, বা রাউফুন বসুনিয়ার মতো সন্তানদের অকালে প্রাণ দিতে হবে না। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশের অভাবে খালি হয়ে যাচ্ছে কত মায়ের বুক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ হলে কোনো বাবা-মা সন্তানকে লেখাপড়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাবেন না। আর কোনো সন্তানকে লাশ হয়ে ঘরে ফিরতে হবে না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ সাহসী পদক্ষেপের জন্য জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে রাজনীতির নামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, অস্ত্র্রের ঝনঝনানি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমরা উন্নত দেশের অনেক কিছুই অনুকরণ করি, কিন্তু তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে অনুসরণ করছি না। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের সত্যিকার মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য আদর্শ এবং অন্যতম সেরা শিক্ষাব্যবস্থা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি দেশের কল্যাণের কথা চিন্তা করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের মানসম্পন্ন বেতন কাঠামো প্রণয়ন এবং প্রকৃত মেধাবীদের এ পেশায় নিয়োজিত করে মানসম্পন্ন শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ মানসম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া উন্নত জাতি গঠন তথা টেকসই উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মনজু আরা বেগম : সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
monjuara2006@yahoo.com