
প্রিন্ট: ০৯ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৩ পিএম
শিগগিরই দেশে বন্যার আশঙ্কা করেছিলেন তিনি

বিমল সরকার
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
আরও পড়ুন
বাঙালিদের মধ্যে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের (১৮৭৩-১৯৬২) মতো মেধাবী ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ খুব কমই লক্ষ করা যায়। ৮৯ বছরের জীবনে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় তিনি ‘গলি থেকে রাজপথে’ বিচরণ করে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কেবল যোগ্যতা আর বিচক্ষণতা নন, তার দূরদৃষ্টিও ছিল অসামান্য।
রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘শেরেবাংলা’ এবং ‘হক সাহেব’ নামে সমধিক পরিচিত। জন্মস্থান বরিশালের প্রত্যন্ত চাখার গ্রাম, একদম কাদামাটি থেকে উঠে আসা মানুষ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টিতে নেতৃত্বদান করেছেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন স্তরে কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেক আকর্ষণীয় পদ অলংকৃত করেন। বয়সের ভারে শেষ জীবনে অবশ্য অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি।
ঘটনাটি যেমন করুণ, তেমনি হাস্যকরও। হায়রে রাজনীতি! আসলে রাজনীতির নামে সমাজে সময় সময় কত নিষ্ঠুর ও হাস্যস্পদ ঘটনাই না সংঘটিত হয়! এমনই একটি ঘটনার কথা জানা যায় শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের শেষ জীবনের।
১৯৫৮ সাল। সামরিক শাসন তখনো জারি হয়নি পাকিস্তানে, জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূন। পাকিস্তানের রাজনীতি উত্তপ্ত তো একেবারে শুরু থেকেই। ইতোমধ্যে ৯২ (ক) ধারা বলে পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে বরখাস্ত এবং প্রদেশে প্রেসিডেন্টের শাসন জারি করা হয়েছে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে ১১ জুলাই ১৯৫৮ শুক্রবার ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করে পিকেএসপি (পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি)। জনসভার সভাপতি নিখিল পাকিস্তান কেএসপি প্রধান হামিদুল হক চৌধুরী।
তখন ভরা বর্ষা। আষাঢ়ের শেষ অথবা শ্রাবণ মাসের শুরু হলেও মেঘের কোনো আনাগোনা না থাকায় সেদিন আকাশ ছিল বেশ পরিষ্কার। নেতারা যথারীতি একে একে সভাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু বিকাল ৪টায় নির্ধারিত জনসভাটি লোকসমাগম না হওয়ায় কিছুতেই শুরু করা যাচ্ছে না। মাইকে ঘোষণা দিতে দিতে ইতোমধ্যে ৩০ মিনিট পার। এভাবে আরও ১৫ মিনিট। ডাকাডাকি করে শেষপর্যন্ত শুরু হলো জনসভার কাজ। কিন্তু হলে কী হবে, এ যেন ‘জন’ ছাড়া জনসভা!
ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে নেতাদের অন্যরকম বোধোদয় হয়। তাদের দৃষ্টি পড়ে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের দিকে। শেরেবাংলা এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। একে তো বার্ধক্য, তার ওপর শরীরে ভর করেছে নানা রোগব্যাধি। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালের কেবিনে অবস্থান করে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু কেএসপি নেতাদের ‘জনসভা’টিকে যে করেই হোক ‘সাফল্যমণ্ডিত’ করে তোলা চাই। সভা রেখেই তারা ছুটে গেলেন হাসপাতালে। সন্ধ্যার ঠিক আগে কয়েকজন ধরাধরি করে সভামঞ্চে এনে উপস্থিত করালেন বর্ষীয়ান এ নেতাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীর দেওয়া বর্ণনা থেকে জানা যায়, বেশ কয়েকটি দিন হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিলেও শেরেবাংলার শরীর-স্বাস্থ্যের সর্বশেষ যে পরিস্থিতি এবং যেভাবে তাকে ধরাধরি করে সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাতে দর্শকের মধ্য থেকে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে ‘নির্মমতা’র অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। একইসঙ্গে আনা হয় রাজনীতির নামে মহান নেতার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অভিযোগও। বক্তৃতা তো দূরের কথা, শেরেবাংলার পক্ষে উঠে দাঁড়ানোই সম্ভব না। এমন পরিস্থিতিতে চেয়ারে বসে হলেও সমবেত ‘জনগণের’ (অল্পসংখ্যক লোক) উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার জন্য তার সামনে মাইক্রোফোন এগিয়ে দেওয়া হয়।
অসুস্থ নেতা চেয়ারে বসেই কাঁপা ও ক্ষীণকণ্ঠে এমনভাবে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন, বেশিরভাগ শ্রোতার পক্ষেই তা বোধগম্য হয়নি। বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমি এখন কঠিন রোগে শয্যাশায়ী। ঢাকায় আমার দুটি বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি এখন আপনাদের চাইতেও গরিব হয়ে পড়েছি। ডাক্তারের পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তাই হাসপাতালে গিয়েছি।’ বক্তৃতার এক জায়গায় বলেন, ‘হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেন, সভায় যেতে যেতে আমি মারা যাব, কিন্তু তারা (সভার উদ্যোক্তারা) বলেন যে বাঁচেন আর মরেন, সভায় আপনাকে যেতেই হবে।’
কাঁপা কাঁপা গলায় শেরেবাংলা আরও বলেন, ‘তা সত্ত্বেও আমি কর্তব্যের খাতিরে সভায় এসেছি। ১৭ বছর বয়সে রাজনীতি শুরু করেছি, এখন বয়স ৮৭। সবসময়ই আমি কথা অনুযায়ী কাজ করেছি।’ সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইলেকশন বড় মজার জিনিস। এই সময় যে যাই বলেন তাই সত্য।’ ফজলুল হক কোনোরকমের ভূমিকা ছাড়াই এ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ‘শিগগিরই দেশে দারুণ বন্যা হবে।’
বক্তৃতায় তিনি চলমান রাজনীতি, ৯৩ ধারা অথবা সংসদীয় গণতন্ত্র, এমনকি কেএসপি সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য করেননি। বর্ষীয়ান নেতার সেদিনের বক্তৃতায় অসংলগ্ন কথাবার্তা লক্ষ করে অনেক শ্রোতাই তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করতে থাকেন।
শেরে বাংলার বক্তৃতা কোনোরকমে সম্পন্ন হলো। এবার সভাপতি কেএসপি প্রধান হামিদুল হক চৌধুরীর বক্তব্য দানের পালা। কিন্তু তিনি মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ঘোর বিপত্তি দেখা দেয়। শ্রোতারা দু-চারজন করে সভাস্থল ত্যাগ করতে শুরু করে। মাঠ শূন্য হওয়ার উপক্রম হওয়ায় পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করে তড়িঘড়ি তিনি সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
‘শিগগিরই দেশে দারুণ বন্যা হবে’-শেরেবাংলার এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করার মাত্র তিন মাসের মাথায় (৭ অক্টোবর ১৯৫৮) প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জার নেতৃত্বে দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক শাসন জারির বিশ দিনের মধ্যে (২৭ অক্টোবর ১৯৫৮) ইস্কান্দর মির্জাকে হটিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের সর্বময় কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। আইয়ুব খান, গণঅভ্যুত্থান, ইয়াহিয়া খান, সাধারণ নির্বাচন, ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, স্বাধীনতার ডাক, নৃশংস গণহত্যা, মহান মুক্তিযুদ্ধ। অপরিমেয় ক্ষতি ও ত্যাগ, এভাবে আমাদের স্বাধীনতা।
মনে পড়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিক শেরেবাংলার সেই স্মরণীয় উক্তিটির কথা-শিগগিরই দেশে বন্যা হবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘ ও ঘনঘোর অন্ধকার দেখে মহান নেতা সেদিন তার আশঙ্কাটি ব্যক্ত করেছিলেন। অপ্রিয় সত্য হলো, এ নেতার ভবিষ্যদ্বাণীটি দেখতে দেখতেই ফলে যায়। সুদীর্ঘ পাঁচ-ছয় দশকেও কথিত ‘রাজনৈতিক বন্যার’ ধকলটি কাটিয়ে ওঠা যায়নি।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, কলাম লেখক