ডেঙ্গু কি মহামারিরূপে আবির্ভূত হবে?
ড. মো. তানভীর রহমান, ডা. মো. রনি ইবনে মাসুদ ডা. মো. সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
দেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬০ সালে, ঢাকায়। সেসময় ডেঙ্গুকে ‘ঢাকা ফিভার’ বলে ডাকা হতো। সময়ের পরিক্রমায় গড়িয়েছে প্রায় ৬২ বছর। প্রকোপ তেমন ছিল না বলেই শনাক্ত হলেও এর গুরুত্ব ততটা ছিল না। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এর তাণ্ডব চোখে পড়ার মতো। দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০০০ সালে। সে বছর প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মানুষ ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়।
শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র মোটামুটি একই রকম ছিল। গত দশকের শেষভাগ থেকে এ দশকের শুরু পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়াকে নাড়িয়ে দেয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। বর্তমানে পৃথিবীর ১২৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুজ্বর। বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে এবং ৪০ হাজার মানুষ এতে মারা যায়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় দেশগুলোর স্থানীয় অঞ্চলগুলো (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়া) বিশ্বের মোট ডেঙ্গুর ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের আনুমানিক অর্ধেকেরও বেশি ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ায়।
এ তো গেল দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র। বাংলাদেশের সর্বশেষ পাঁচ বছরের চিত্র দেখলে এর ভয়াবহতা আরও পরিষ্কার হবে। ২০১৮ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ছিল ০.২৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে ০.১৮ শতাংশ, ২০২০ সালে ০.৫০ শতাংশ, ২০২১ সালে ০.৩৭ শতাংশ, ২০২২ সালে ০.৪৫ শতাংশ এবং ২০২৩-এর ১৭ জুলাই পর্যন্ত ০.৫৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ২৮১ জন রোগী মারা যায়। এর আগে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। ২০২০ সালে ৭ জন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জন মারা যায়। চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা হয়, যখন দেখা যায় ২০২৩-এর জুলাইয়ের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪৭-এ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল ব্রিফিং অনুযায়ী, গত জুন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ৯৫৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, আর ২৯ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩৮ হাজার ৪২৯ জন। এ হিসাবে আগের মাসের তুলনায় প্রায় সাতগুণ বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে জুলাইয়ে। শুধু যে আক্রান্তের হার বেড়েছে তা নয়, মৃতের হারও বেড়েছে অনেকটাই। গত জুলাইয়ে মারা গেছে ২০০ জন। এখন দেখার বিষয় এ বছরের বাকি সময় ডেঙ্গু পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়।
প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন বাংলাদেশে ডেঙ্গুর এত প্রকোপ? এর সম্ভব্য কিছু কারণ লক্ষণীয় :
জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থান : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিরক্ষরেখা এবং উপক্রান্তীয়/ক্রান্তীয় পরিবেশের কাছাকাছি। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মতো ডেঙ্গু ভেক্টরের জন্য আদর্শ আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। এখানকার তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা মশার বংশবৃদ্ধি এবং ভাইরাস সংক্রমণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে বর্ষাকালে প্রচুর জমে থাকা পানি মশার প্রজননক্ষেত্র হিসাবে কাজ করে।
দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব : দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় দুর্বল অবকাঠামো গড়ে উঠছে, যা নিষ্কাশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৬.৫ কোটি মানুষ বসবাস করছে। সেই হিসাবে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ১১৯ জন। উপরন্তু আমরা দেখছি, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব প্রধানত ঢাকা নগরীতে বেশি, যার একটি কারণ হতে পারে এ শহরে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ২৩ হাজার জন।
কার্যকর ভেক্টর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অভাব : অপর্যাপ্ত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ মশা নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা, যেমন: ফগিং, লার্ভিসাইডিং ও প্রজনন স্থান নির্মূল পদ্ধতি মশার সংখ্যা বৃদ্ধি ও ডেঙ্গুর বিস্তারে ভূমিকা রাখে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের অনেক পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বরাবরের মতোই দেখা যায় ডেঙ্গু নির্মূলে শুধু চিকিৎসার ওপর জোর দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা : বাংলাদেশ সব সময় তার প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস আসার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঘন ঘন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কারণে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অতীতেও এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। একাধিক ডেঙ্গু সেরোটাইপ এখনো সেকেন্ডারি ইনফেকশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতার কারণ। অন্য অনেক দেশের মতো প্রথম ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন সিওয়াইডি-টিডিভি বাংলাদেশে চালু করা হয়নি; কারণ এতে সেরো-নেগেটিভ ব্যক্তি এবং নয় বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে আরও গুরুতর রোগের ঝুঁকি রয়েছে।
জনসচেতনতার অভাব : ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক মানুষ এখনো সচেতন নয়। সম্প্রতি ঢাকা শহরে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মাত্র ৫২ শতাংশ মানুষের ডেঙ্গু সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান আছে। বাকি ৪৮ শতাংশ মানুষ এখনো ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতন নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে বা নির্মূলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তা না হলে আগামী দিনে করোনার মতো ডেঙ্গুও মহামারিতে রূপ নিতে পারে। যেহেতু ভৌগোলিকভাবে আমরা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছি, সেহেতু জনমনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে যেখানে-সেখানে পানি জমিয়ে রাখা বন্ধ করতে হবে। নিয়মিত বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করতে হবে। সর্বোপরি এডিস মশা নিধনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা করতে হবে, প্রয়োজনে দেশি-বিদেশি গবেষকদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করতে হবে, যাতে ডেঙ্গু নির্মূলের কিংবা ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কারের পথ সুগম হয়।
প্রফেসর ড. মো. তানভীর রহমান, ডা. মো. রনি ইবনে মাসুদ, ডা. মো. সাইফুল ইসলাম : শিক্ষক, ডিপার্টমেন্ট অব মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন, ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ