Logo
Logo
×

বাতায়ন

ডেঙ্গু নিয়ে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা ও গবেষণা প্রয়োজন

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডেঙ্গু নিয়ে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা ও গবেষণা প্রয়োজন

ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এডিস মশার প্রকোপ গত পাঁচ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তবে খোদ রাজধানীতে এর ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি।

এর মধ্যে আবার এ জুলাই মাসকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৯ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জনই ঢাকার বাসিন্দা। মৃত্যুর দিক বিবেচনায় গত ৫ বছরের মধ্যে একদিনে এটাই সর্বোচ্চ।

এ ছাড়াও উল্লিখিত দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৭৯২ জন। এ বছরে এই নিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৬। এর মধ্যে চলতি জুলাই মাসের ১৮ দিনেই মারা গেছে ৯৯ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৯২। এর মধ্যে শুধু জুলাই মাসের ১৮ দিনেই ভর্তি হয়েছে ১৭ হাজার ৮১৪ জন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মাসওয়ারি হিসাব নিলে দেখা যাবে, গত জানুয়ারিতে ভর্তি হয়েছিল ৫৬৬ জন রোগী, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে এক হাজার ৩৬ জন এবং জুন মাসে পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন রোগী। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুনের তুলনায় জুলাই মাসের ১৮ দিনে ভর্তির সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও জুলাই মাসের ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জানুয়ারি মাসে মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের, ফেব্রুয়ারিতে তিনজনের, এপ্রিল ও মে মাসে দুজন করে। সুতরাং, জুলাই মাসে মৃত্যুর সংখ্যা ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এবার বেড়েছে ভয়াবহভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বর্ষাকালে এডিসের প্রাদুর্ভাব বাড়ে; কিন্তু আচরণগত পরিবর্তনের ফলে এটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। রূপ বা চরিত্র বদলে ফেলায় চলতি বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এডিস মশার চরিত্র বদলকেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশে মশার জীবনচক্র বদল নিয়ে ২০২১ সাল থেকে গবেষণা চলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা সব ধরনের পানিতেই বংশবিস্তার করতে পারে; যদিও এতদিন বলা হয়েছে, এডিস মশা কেবল পরিষ্কার পানিতেই বংশবিস্তার করে। গবেষণায় পাওয়া তথ্য বলছে, সুয়্যারেজ, ড্রেন, এমনকি সমুদ্রের নোনা পানিতেও এডিস মশা ডিম পাড়তে সক্ষম এবং জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। জমে থাকা এক সেন্টিমিটার পানিতেও মশার বংশবৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুষ্ক অবস্থায় এডিস মশার ডিম ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত জীবিত থাকে। সামান্য পানির সংস্পর্শে এলেই সেটি ফুটে লার্ভা তৈরি হয়। আরেকটি পরিবর্তন হলো, আগে এ মশা সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়াত, এখন সব সময়ই কামড়াচ্ছে। তবে রাতে কামড়ানোর পরিমাণ কম। এডিস মশা বিকাল ৪টায় যতটা সক্রিয়, রাত ৯টাতেও ততটাই সক্রিয়।

ডেঙ্গু সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা, ইউরোপীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (ইসিডিসি) জানিয়েছে, এ বছর ৮ জুন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ২২ লাখ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে। সংখ্যার আধিক্যের ধারা অনুযায়ী দেশগুলো হলো-ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু ও আর্জেন্টিনা। এর পরের সারিতে আছে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, আফগানিস্তান, লাওস, কম্বোডিয়া, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, মালদ্বীপসহ ১০০টি দেশ। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এই যে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর অনুপাতে বাংলাদেশে মৃত্যুহার বেশি। তাছাড়া মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও অপূর্ণতা রয়েছে। মৃত্যুর আনুপাতিক হার বৃদ্ধি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেনের বক্তব্য হলো, গত ২৩ বছর ধরে ডেঙ্গুকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও তা মূলত মৌসুমিকেন্দ্রিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ ছিল। কোনো রোগকে নিযন্ত্রণে রাখতে হলে যে অবস্থান থেকে কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন, তা করা হয়নি। রোগীর অনুপাতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। কারণ রোগীরা শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার আওতায় আসছেন। আর রোগী ও মৃত্যুর যে সংখ্যা আমরা জানছি, তা হাসপাতালভিত্তিক। এর বাইরে যেসব রোগী রয়েছে এবং মৃত্যু হচ্ছে, তা হিসাবের বাইরে থাকছে। কৌশলগত পর্যবেক্ষণের ঘাটতি রয়েছে।

দেশে প্রথম ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুকে গুরুত্ব দেয় সরকার। যদিও বিশ্বে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয় ১৭৮০ সালে। ১৯৫০ সালে এ রোগটি ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে বিস্তার লাভ করে। এরপর ১৯৬৩ সালে ভারতের কলকাতায় এবং ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। সে সময় ডেঙ্গুকে ঢাকা ফিভার নামে অভিহিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ রোগকে মূলত ২০০০ সাল থেকে গুরুত্ব দিতে থাকে। সে বছরই পাঁচ হাজার ৫০০ রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে ৯৩ জনের মৃত্যু ঘটে। গত ২২ বছরে আড়াই লাখেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং মারা গেছে ৮৫০ জন রোগী।

মানবজাতির কোনো স্তরই সমস্যার বাইরে ছিল না। কিন্তু প্রতিটি সমস্যার সমাধান করেই গড়ে উঠেছে আজকের সভ্য সমাজ। এখনো নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। একটির সমাধান হলে আরেকটি সমস্যা এসে সামনে দাঁড়ায়। একটি বিবেচনাপ্রসূত সমাজের কাজ হলো সমস্যা-সংকটের প্রকৃত কারণ উদঘাটন এবং তা নিরসনের প্রকৃত উপায় খুঁজে বের করা। একই সংকটে একই পরিমাণে বারবার আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে ব্যর্থতাকে দায়ী করা যায়। ডেঙ্গুও তেমনি একটি সমস্যা। এ থেকে উত্তরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।

সমস্যার সমাধানে আমাদের কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে সুনির্দিষ্টভাবে। দেশে রোগ ব্যবস্থাপনার কারণে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ। তার মতে, আমাদের আইইডিসিআরকে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির মতো করা উচিত ছিল। রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় ঘাটতি রয়েছে। প্রতিটি জেলায় রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য আইইডিসিআরের কেন্দ্র থাকা উচিত। ভাইরাস প্রতিনিয়তই চরিত্র বদলায়। আজকে যে ডেঙ্গু দেখছি, তা আগে দেখা যায়নি। ফলে গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু মৌসুমি রোগ বিবেচনায় নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। একই সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে বড় আকারে নিতে হবে। যেসব রোগী মারা যাচ্ছে, তারা কেন মারা যাচ্ছে, চিকিৎসার কোন পর্যায়ে মারা যাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। রোগীদের বেশির ভাগই মারা যাচ্ছে যথাসময়ে চিকিৎসার আওতায় না আসায়।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ে একটি দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা ও গবেষণা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু স্বল্পকালে এ রোগ প্রতিরোধে আমাদের কী করা উচিত এর একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ কাজে সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বাধ্যতামূলকভাবে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সরকারের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু নির্মূলের নামে সিটি করপোরেশন যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করছে, তাতে কোনো ফল আসছে বলে মনে হয় না। এতে জনগণ তাদের সহায়তা করছে না। দেশের সব সিটি করপোরেশনের উচিত হবে এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করে জনগণকে নিয়ে মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা। জনপ্রতিনিধিদের এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশে যত কীটতত্ত্ববিদ আছেন, তাদের সারা দেশেই কাজে লাগাতে হবে। কীটতত্ত্ববিদদের নেতৃত্বে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম সবখানে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর সঙ্গে হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে জনবল নিয়োগ ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে। তা না হলে কোনোভাবেই ডেঙ্গু নির্মূল করা সম্ভব হবে না এবং আমাদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে তৎপর হবে।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম