গত ১২ জুলাই মাঠের বিরোধী দল বিএনপির যে সমাবেশটি রাজধানীতে হয়েছে, তেমন সমাবেশ এর আগেও তারা করেছেন। গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশটির কথা আমাদের মনে আছে। তা ঘিরে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছিল। আর বিএনপিকে দলীয় কার্যালয়ের সামনের এলাকার বদলে অন্য স্থানে করতে হয় সমাবেশটি। এবার অবশ্য তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই সমাবেশ করতে পেরেছেন তারা নিজেদের পছন্দসই স্থানে।
কাছাকাছি আরেকটি স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ‘শান্তি সমাবেশের’ আয়োজন করে। তবে এবার রাজনীতিসচেতন মানুষ সংঘাতের আশঙ্কা করেছিল কম। তারা জানে, এ সময়ে রাজধানীতে অবস্থান করছিল ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিনিধিদল। তাদের সফরের মূল এজেন্ডাও বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন। এদের উপস্থিতিতে আমাদের রাজনীতির বিবদমান দুপক্ষের কোনোটিই সংঘাতে জড়াতে উৎসাহী হবে না বলে সবাই ধরে নিয়েছিল। তাদের সামনে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি আর জনসমর্থন দেখাতেও উভয়পক্ষ এদিন সচেষ্ট ছিল মনে হয়।
তবে বিএনপির সমাবেশটিই ছিল মূল ঘটনা। আওয়ামী লীগের সমাবেশ ছিল এর পালটা কিছু। দীর্ঘদিন ধরেই তারা এমনটি করে এলেও এর যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারেননি। বিএনপি সমাবেশের নামে নৈরাজ্য করবে এবং আওয়ামী লীগকে তা ঠেকাতে কাছাকাছি কোথাও হাজির থাকতে হবে, এটাই হলো ‘যুক্তি’! কোনো দল নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশই কেবল তা মোকাবিলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, একথা বারবার বলেও পালটা সমাবেশ আয়োজন থেকে ক্ষমতাসীনদের নিবৃত্ত করা যায়নি। ১২ জুলাই সেটা আবার ঘটানো হলো দেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে। এটি কোনোভাবেই সরকারের জন্য ইতিবাচক হলো না।
বিএনপি তার সমাবেশ ঘিরে দীর্ঘদিন পর মাইকিং ও রাজধানীর মহল্লায় মিছিল করতে পারলেও তাদের সমাবেশস্থলে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের গতি ধীর করে রাখায় সেটিও তাৎক্ষণিকভাবে খবর হয় অনলাইনে। দায়িত্ব পালনরত সংবাদকর্মীদেরও ওখান থেকে খবর পাঠাতে অসুবিধার মুখে পড়তে হয়েছিল। ব্যাপকভাবে না হলেও সমাবেশে আসতে বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও নৌপথে বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। হয়েছে কিছু ধরপাকড়। তারপরও দুপক্ষ শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করায় মানুষ হাঁফ ছেড়েছে এবং আগামীতে এ ধারা অব্যাহত থাকার ব্যাপারে তাদের অন্তত একাংশে কিছুটা আশাবাদ গড়ে উঠবে হয়তো। এটা তো কম নয়।
ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের ভেতর থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি সেদিন মানুষে মানুষে সয়লাব করে ঢাকা শহর অচল করে দিতে পারেনি। তাদের সমাবেশ আগের মতোই ‘ফ্লপ’ করেছে। দলটিকে তিরস্কার করে বলা হয়ে থাকে, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে তারা বরাবরই ব্যর্থ। এ-ও বলা হয়ে থাকে, তারা কখনোই তেমন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন না। ফলে সরকারের পতন ঘটার কোনো শঙ্কা নেই বলে তারা সিদ্ধান্ত টেনে বসে আছেন।
সব ক্ষেত্রে একইভাবে সরকারের পতন ঘটে কিনা, এ প্রশ্ন অবশ্য কেউ জোরালোভাবে তুলছেন না। বিএনপি আন্দোলন রচনায় কেন এখনো ব্যর্থ, তার মূল্যায়নও বড় একটা হয় না। বিএনপির মধ্যেও সেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তা হাজির করার প্রয়াস কম পরিলক্ষিত। টানা তিন মেয়াদ রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা একটি সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হতে তাদের মধ্যে একটা হতবিহ্বল অবস্থা তৈরি হয়েছে বললেও ভুল হবে না। দলীয় চেয়ারপারসনের কারাবাস এবং দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিদেশে অবস্থান করে দল পরিচালনার চেষ্টা কিছু সমন্বয়হীনতারও জন্ম দিয়েছে।
এ অবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে সহযাত্রীদের প্রভাব বেড়েছে বিএনপিতে। এটা এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত যে, ২০১৮-র চরম বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের পৌরহিত্যে। সে নির্বাচনের আগে আসন ভাগাভাগির একটি সমঝোতা হয়েছিল বলেও খবর পাওয়া যায়। সেটিও কার্যকর হতে দেওয়া হয়নি। কারা দেয়নি, সে প্রশ্নও জোরালোভাবে উঠতে দেখা যায় না।
ওয়ান-ইলেভেনে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিএনপি। আলাপ উঠলে অবশ্য ওই ঘটনায় আখেরে বেজায় উপকৃত আওয়ামী লীগ নেতারাও কম সমালোচনা করেন না ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের। ২০০৮-র নির্বাচনেও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ কতটা ছিল বা আদৌ তৈরি হয়েছিল কিনা, সে প্রশ্ন রয়েছে। তারপরও সেটি একটি নির্বাচন ছিল এবং বিএনপি এর ফল অগত্যা মেনে নিয়ে সংসদে গিয়েছিল। এর আগে কয়েকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও সংসদ কিন্তু এখানে কখনোই কার্যকর হয়নি। তারপরও বলতে হয়, সেখানে জনগণের ইচ্ছার একটা প্রতিফলন তথা জনপ্রতিনিধিত্ব ছিল।
তবে সেটি বারেবারে ফিরে পাওয়ার আশা প্রচণ্ডভাবে মার খায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ঘটনায়। এর আইনগত দিক নিয়ে এখানে আলাপ করব না। সেটি যোগ্য বিশেষজ্ঞদের কাজ। এটুকু শুধু বলব, এর পরবর্তী রাজনীতি পল্লবিত হয়েছে ওই ঘটনা ঘিরেই। কিছুদিন আগে যুগান্তরে লেখা এক নিবন্ধে এমন পর্যবেক্ষণ অবশ্য তুলে ধরেছিলাম যে, ২০১৪ ও ২০১৮-র নির্বাচনে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলে আজকের রাজনৈতিক পরিণতি হয়তো এড়ানো যেত। তার মধ্যে রয়েছে বিএনপির নির্বাচন বর্জন ও তা প্রতিহত করার মরণপণ প্রচেষ্টা। আর ছিল পরবর্তী নির্বাচনটি প্রশাসনের সহায়তায় খুবই খারাপভাবে সম্পন্ন করে ফেলার ঘটনা। আর তাতে পরস্পরের ভুল সংশোধন ও নতুন করে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার সুযোগটিও হাতছাড়া হয়ে যায়।
প্রশ্নবিদ্ধ ও গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে দু-দুটি মেয়াদ কেবল বিএনপির ওপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করেছে, তা নয়। এতে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ, বিশেষত দেশটির রাজনৈতিক অগ্রগতি। ক্ষমতাসীন দল আর সরকারও কিন্তু রাজনৈতিক অগ্রগতির কথা বড় একটা বলে না। তারা বলেন, ‘অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতির’ কথা। কম গণতন্ত্র আর বেশি উন্নয়নের বয়ানও বিক্ষিপ্তভাবে হাজির করার চেষ্টা পান তাদের কেউ কেউ। তবে এ সময়কালের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়েও সমালোচনা কম নেই। এতে দুর্নীতি একটি বড় অনুষঙ্গ হয়ে ওঠাতেই সত্যি বলতে সমালোচনা বেড়েছে।
দুর্নীতি কোন দেশে নেই বা এটা নির্মূল করা যায় কিনা, এমন সব দুর্বল যুক্তিজাল বিস্তার করে দুর্নীতির ভয়াবহতা আড়ালের চেষ্টা অবশ্য নেওয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে দৃশ্যমান আর বড় দুর্নীতি বোধহয় জনগণের ভোটাধিকার বিনষ্ট হয়ে যাওয়া। গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে এদেশে ভোটাধিকারটিই ছিল মুখ্য। এর বলেই জনগণ কিছুটা হলেও মনে করতে পারত দেশটি তার এবং এখানে তার কিছু বলার রয়েছে। অন্তত মেয়াদ শেষে ব্যর্থ কিংবা অবিশ্বস্ত শাসকদের ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেওয়ার সুযোগ তার ছিল। সেটাও বাতিল হয়ে যাওয়ায় এর ভেতর দিয়ে তার অন্যান্য ক্ষমতায়নের পথও যেন বন্ধ হয়ে যায়। যারা বলে থাকেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেই কি গণতন্ত্র এসে যাবে, তারা সম্ভবত বোঝেন না বা আড়াল করতে চান এ বাস্তবতা যে, জনগণের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করার এ হাতিয়ারটাই ছিল শুধু। আর এ প্রেক্ষাপটেই এখন চিন্তা করে দেখতে হবে সামনের নির্বাচনকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করার প্রশ্নটি।
কে এই প্রশ্ন তুলছে, সেটা তাই বড় বিবেচ্য নয়। একমাত্র বিবেচ্য তো নয়ই। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও কিন্তু বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮-র মতো হবে না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ওগুলো ‘মডেল’ নয়। তাহলে মডেল কোনটি? ন্যূনতম কেমন নির্বাচন হলে জনগণ তার ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে বলে ভেবে আশ্বস্ত হতে পারবে? নির্বাচনে পরাজিত পক্ষও (কিছুটা আপত্তিসহ) তা মেনে নিয়ে সংসদে গিয়ে বসবে? এ আলাপের সূত্রপাত করলে এবং নিম্নতম সততার সঙ্গে সেটি এগিয়ে নেওয়া হলে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হব যে, ক্ষমতা ছাড়তে একেবারেই অনিচ্ছুক কোনো সরকারের অধীনে কাঙ্ক্ষিত সে নির্বাচন সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে কারও ‘প্রতিশ্রুতি’ বা ‘অঙ্গীকার’ অন্তত বিরোধী দলের সমর্থক বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কিছুটা বিশ্বাস হয়তো জাগত, ২০১৮-র কথিত নির্বাচনি সমঝোতা কার্যকর করা গেলে। এমনও বলা হয়ে থাকে, খোদ প্রধানমন্ত্রী ওটা বাস্তবায়নের পক্ষে থাকলেও ‘অলিগার্কদের’ একটি চক্র বিদেশি সহায়তায় তা বানচাল করে দিয়ে দেশকে ঠেলে দেয় সম্পূর্ণ ভিন্নদিকে। নইলে ওই সমঝোতা বাস্তবায়নের ভেতর দিয়েও গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের একটা সুযোগ হয়তো সৃষ্টি হতো। দলীয় সরকারের অধীনে একটি তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকারের কিছুটা মূল্য থাকত তখন।
ভূরাজনৈতিক বা যে কারণেই হোক, আমেরিকাসহ পশ্চিমা প্রভাবশালী মহলও অব্যাহতভাবে চাইছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনটি সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য হোক। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ইত্যাদি যত শব্দই ব্যবহৃত হোক; সারকথা হলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কিংবা পশ্চিমা মহল নয়; জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। তার কাছে গ্রহণযোগ্য হলে নির্বাচনটি সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এদেশে কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি, এমন তো নয়। এ দাবি উপেক্ষা করে যারা কথা বলছেন, তারাও একসময় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের শর্ত পূরণে মরণপণ আন্দোলনে নেমে তখনকার অনিচ্ছুক সরকারকে সংবিধানে সংশোধনী আনতেও বাধ্য করেছিল।
এদেশেই গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের স্বার্থে সংবিধানের আওতার বাইরে গিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল এবং সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলো উপনীত হয়েছিল এক ঐতিহাসিক সমঝোতায়। প্রশ্ন হলো, আমরা বর্তমান সংকটের স্বরূপটি উপলব্ধি করতে পারছি কিনা আর সেখান থেকে বেরোনো জরুরি মনে করি কিনা। এ অবস্থায় সামনের নির্বাচনটি যেনতেনভাবে সম্পন্ন করে ফেলার চেষ্টা হলে রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে। অর্থনীতির হালহকিকত কিন্তু ভালো নয়। দেশ অধিকতর রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হলে অর্থনীতিও বাঁক নিতে পারে বিপজ্জনক দিকে।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক