একটি প্রচলিত কথা আছে, ‘গরিবের বউ সকলের ভাবি’। প্রকৃত দরিদ্রের ক্ষেত্রে তাৎপর্যগত দিক থেকে কথাটির ভেতর সত্য খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এ সময়ের বাংলাদেশকে নিয়ে, এর গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ধনী দেশগুলো যখন টানাটানি করছে, তখন বিস্মিত হতে হয়। সরকারি ভাষ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে এখন উন্নত দেশের আভিজাত্যে আসন পাততে যাচ্ছি। দৃশ্যমান অগ্রগতিও কম নয়। বিদ্যুৎক্ষেত্রে নানা বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এখন বাস্তব সত্য। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল তৈরি হয়েছে। রেলে চড়ে কক্সবাজার যাওয়া এখন ক্ষণগণনার বিষয় মাত্র। নিকট ও সুদূর অতীতে এ ধরনের উন্নয়নের ছিটেফোঁটার মালিক সরকার গঠন করা কোনো দলই হতে পারেনি। তারপরও রাজনৈতিকভাবে আমরা হয়তো দারিদ্র্য কাটাতে পারিনি। ফলে এতকিছুর পরও বাংলাদেশ যেন রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘গরিবের বউ’ রয়ে গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ ও এর নাগরিক হিসাবে আমাদের এ এক বড় দুর্ভাগ্য।
শুধু দেশের বিরোধী রাজনীতিকদের স্বয়ংক্রিয় বুলি নয়, আন্তর্জাতিক মহল থেকেও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দুর্বল দশা নিয়ে কথা তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে। হতে পারে সেখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মোটিভেশন ভূমিকা রাখছে। কিন্তু দেশের সাধারণ-সচেতন মানুষ কি হতাশ নয়?
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচন তো একান্তই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে মার্কিন প্রশাসন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেন সরাসরি নাক গলানোর সুযোগ পাচ্ছে? সরকারের উচ্চতম পর্যায় থেকে এর বিপরীতে মাঝেমধ্যে শক্ত সমালোচনা শোনা গেলেও মোড়ল দেশগুলো তা আমলে নিচ্ছে না। সরকারপক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। সম্প্রতি সমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হলেও এতে বিদেশি অভিভাবক এবং দেশের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ আশ্বস্ত হতে পারছে না। এ সত্যটি কি সরকার ও সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মূল্যায়ন করছেন?
আজ ১১ জুলাই বাংলাদেশ সফরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জোয়ার। পরিদর্শন দলে আরও বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সরকারি কর্মকর্তা থাকবেন। যদিও ৭ জুলাই পররাষ্ট্র সচিব ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, এ প্রতিনিধিদল নির্বাচন ইস্যুতে আসছে না; কিন্তু নানা তথ্যসূত্রে বোঝা যায়, নির্বাচন ইস্যু আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নির্বাচন ইস্যুতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেনই। টানাপোড়েন যে চলছে, তা মাঝেমধ্যে সরকারের উচ্চতম পর্যায় থেকে মার্কিন প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা আমাদের নিশ্চিত করছে। আর এসব ঘটনা বিএনপি ও এর জোটবন্ধুদের অনেকটা আশাবাদী করে তুলেছে যেন।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, মুখে যত ‘জনগণ’ শব্দ যপ করুক না কেন, বিএনপি জোটের আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব ঘটানোর মতো অবস্থা দেশে নেই। এটা নিশ্চয়ই বোঝার মতো বাস্তব বোধ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। ১৯৬৯-এর কথা দূরে থাক, ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের মতো অবস্থা দেশে তৈরি হয়েছে-এমনটি মুক্তচিন্তার কেউ মানবেন না। তাই বছরের পর বছর আন্দোলনের হুমকিই দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও এর সঙ্গে থাকা ক্ষুদ্র দলগুলো। চার দেওয়ালের ভেতর থেকেই যত আস্ফালন চলছে। এ বোধটি বিএনপি নেতাদের থাকার কথা। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মানুষ আওয়ামী লীগ ও সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ থাকলেও তারা বিএনপির আহ্বানে ছুটে আসবে কোন ভরসায়? বিএনপির শাসনকাল মানুষ দেখেছে। আজ আওয়ামী লীগ আমলের ঘুস-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, সন্ত্রাস প্রভৃতি যত অভিযোগ বিএনপি ও এর সমমনারা করছে-সাধারণ মানুষ এর বাস্তবতা অস্বীকার করবে না। কিন্তু তারপরও বিএনপির প্রতি আস্থা রাখবে কেমন করে? একই কাণ্ড কি কম হয়েছে বিএনপির শাসনকালে? সুস্থ মানুষ কি উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপিয়ে পড়বে?
এ বাস্তবতাই আওয়ামী লীগ ও এর সরকারের ভরসা। কিন্তু এমন রাজনৈতিক দারিদ্র্য কি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও সরকারের কাছে কাম্য ছিল? বরং বিএনপি সরকারের নানা ব্যর্থতার বাস্তবতাকে পুঁজি করে সুশাসনের পথে হেঁটে আওয়ামী লীগ সরকার সাধারণ মানুষের অন্তরের কাছে চলে আসতে পারত। ফলে ২০১৪ ও ২০১৮-এর মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করতে হতো না সরকারকে। আওয়ামী লীগ মুখরক্ষায় যত কথাই বলুক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর দায় দীর্ঘকাল বয়ে বেড়াতে হবে দলটিকে। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিকে মোকাবিলা করার জন্য সততা ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তত চেষ্টা করা। দলীয়করণের মাধ্যমে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষেত্র এবং শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার কাঠামোকে যেভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে এবং হচ্ছে, এর দায় মেটাতে অনেকটা কষ্ট হবে বর্তমান সরকারের। অথচ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব ছিল অচলায়তন ভাঙা। সমমনা সৎ ও প্রাজ্ঞ মানুষদের কাছে টানা যেত সহজেই। ঘুস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া যেত। মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ তেমনটি করতে পেরেছিলেন।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিদগ্ধ মানুষকে দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাজানো যেত। উচ্চশিক্ষাঙ্গন দলীয়করণের থাবামুক্ত রাখার সাহস দেখানো যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এ ধারার কোনো পদক্ষেপ দেখাতে পারেনি এ পর্বের আওয়ামী লীগ সরকার।
রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে এসব ক্ষতকে খুঁচিয়ে দিতে পারত বিরোধী পক্ষ। কিন্তু বিরোধী পক্ষের নেতারা তা পারবেন কেমন করে! গায়ের চাদর সরালে দেখা যাবে, এসব ক্ষত তাদের গায়েও তো দগদগ করছে। ফলে চালুনি যদি সুচের সমালোচনা করে, তবে এর ঢেউ গণমানুষের মর্মে পৌঁছবে না।
এমন দমবদ্ধকর অবস্থা আমাদের শ্রদ্ধেয় রাজনীতিকরা তৈরি করেছেন বলেই উজ্জ্বল ঐতিহ্যের স্নিগ্ধ দেশটি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মোড়লদের কাছে রাজনৈতিক দারিদ্র্যের বিবেচনায় ‘গরিবের বউ’ হয়ে গেছে। সুযোগ আছে বলেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মোড়লিপনা করতে পারছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অভিযোগ বা সন্দেহের বাস্তব ভিত্তি আছে বলেই জোর গলায় তা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
এসব দেখেই বিএনপি আর এর জোটবন্ধুদের হালে পানি এসেছে। নিজেদের রাজনৈতিক দুর্দশা জেনেও তারা সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অর্জন ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে ধনুকভাঙা পণ করেছে। সম্ভবত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যাতে সরকার না করতে পারে, সেজন্য একটি শূন্যতা তৈরির চেষ্টা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাইডেনসহ মার্কিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শব্দচয়নে সামান্য পরিবর্তন আসছে। বিএনপির এক দফার পক্ষে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির পক্ষে তারা সমর্থন দেবে এমন মনে হয় না। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে অপব্যবহার বিএনপি আমলে হয়েছে, তা তো আর মুছে ফেলা যাবে না।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবতা হচ্ছে, সত্যাসত্য নয়, নিজ প্রভুত্ব বজায় রাখাটাই বড় কথা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তারা সরাসরি পাকিস্তানি হানাদারদের সমর্থন দিয়েছিল। আবার মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ডিসেম্বরের শুরুতে যখন পাকিস্তানিদের পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত, তখন নিয়াজির কান্না যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের মনোযোগ কোনোভাবেই আকর্ষণ করতে পারেনি। এ স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতায় মার্কিন আচরণে কিছুটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর এবং এ সূত্রে বাংলাদেশে আসার আগে ওয়াশিংটনে উজরা জোয়ারের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎকারকে আমরা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। আমরা অবাক হব না এর পরে যদি বিএনপি একটি মধ্যস্থতার সুর নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দেয়।
গত ৭ জুলাই প্রকাশিত আরেকটি রিপোর্টের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। গরিবের বউকে নিয়ে এবার টানাটানি করছে রাশিয়াও। রুশ পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপের রাজনীতিকদের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেছে। এতে আওয়ামী লীগের আনন্দিত ও বিএনপির দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান থেকে ঘুঁটি চালাচালি মাত্র।
এসব বাস্তবতা দেখে আমরা এখন দেশের প্রগলভ রাজনীতি থেকে বেরোতে চাই। রাজনীতিকদের চটুল শব্দের গণতন্ত্র নয়, প্রকৃত গণতন্ত্রের ধারায় দেশ ফিরে আসুক। আমরা বিশ্বাস করি, এ ফিরিয়ে আনায় যারা সফল নেতৃত্ব দিতে পারবেন, ইতিহাসে টিকে থাকবেন তারাই। অপরাজনীতি যে দুর্ভাগ্য আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, তা থেকে মুক্ত হয়ে আমরা বিশ্ববাসীর সামনে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে দাঁড়াতে চাই।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com