Logo
Logo
×

বাতায়ন

ফাঁকিবাজিরও সীমা থাকা উচিত

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফাঁকিবাজিরও সীমা থাকা উচিত

প্রতীকী ছবি

আমি খুবই বিস্মিত হলাম। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকায় শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাব্যবস্থা-এমন অনেককিছুই দেখাশোনা ও জানাবোঝার সুযোগ হয়েছে। এমনকি অবসর নেওয়া সত্ত্বেও এখনো। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা আগে আর কখনো হয়নি আমার। একেবারে অবিশ্বাস্য, আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম দেখে। দশ-বিশ বছর আগে যেমনই হোক, এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন ও হলে দায়িত্ব পালনেও সম্মানী পাওয়ার বন্দোবস্ত রয়েছে। তাহলে আর এমন ফাঁকিজুকি কেন? কী এমন ব্যস্ততা-ত্রস্ততা! মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে কেন এমন অভিনব প্রতারণা? কার সঙ্গে-শিক্ষার্থী, নিজের, নাকি মহান পেশাটির সঙ্গে? এমন লোক শিক্ষকতায় ঢুকল কী করে।

আমার একসময়কার ছাত্রের জেলা সদরে একটি প্রিন্টিং প্রেস আছে। অবসর সময়ে ওখানে গেলে ওর বাবার দেখা পাই। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাছাড়া মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করে আমার অনেক আগে অবসর নিয়েছেন। প্রায় সময়ই শিক্ষা-শিক্ষার্থী-শিক্ষক, শিক্ষকতাসহ নানা বিষয়ে কথা হয় আমাদের মধ্যে।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে (২০২৩)। প্রেসের হাসানকে লক্ষ করলাম, কম্পিউটার অন করে একটি মোটা আকৃতির বই খুলে একের পর এক পৃষ্ঠা মিলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে অন্য একটি লেখা কাগজের মধ্যেও চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। প্রায়ই কাছাকাছি বসে থাকায় হাসান টাইপের কাজ করার সময় কমল ভাই কিংবা আমার কাছে প্রয়োজনে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে নেয়। সেদিন হাসান বেশ ত্যক্ত-বিরক্ত। এমনিতেই সরকারি কলেজের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ; তার ওপর আবার ‘টেডি প্রশ্নপত্র’ (!) তৈরি করে দেওয়া। হাসান যা বলল : তিনদিন আগে একটি মোটাগাইড বই আর একটি ‘পাণ্ডুলিপি’ ধরিয়ে দিয়ে গেছেন এক কলেজশিক্ষক। রসায়ন বিষয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির প্রশ্নপত্র করে দিতে হবে। হাসান কিছুটা বুঝতে না বুঝতেই হন্যে হয়ে বের হয়ে গেলেন ওই শিক্ষক। এখন কাজে হাত দিয়ে প্রমাদ গোনে হাসান। এদিকে শিক্ষকের কাছ থেকে কাজ সম্পন্ন করে রাখার তাগিদ আসতে থাকে।

হাসানের হাত থেকে কাগজটি (পাণ্ডুলিপি) হাতে নিয়ে আমি তাতে চোখ বোলাই। কী লেখা আছে তাতে? সবার উপলব্ধির জন্য এখানে হুবহু তা তুলে ধরলাম :

একাদশ শ্রেণি : যে কোনো ৩টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পূর্ণমান- ৩০।

১ নং প্রশ্ন : পৃষ্টা ৫২ এর ১ নং প্রশ্ন

২ নং প্রশ্ন : পৃষ্টা ৩৫২ এর ৫ নং প্রশ্ন

৩ নং প্রশ্ন : পৃষ্টা ৩৪৮ এর ১ নং প্রশ্ন

৪ নং প্রশ্ন : পৃষ্টা ৭৭২ এর ২ নং প্রশ্ন

৫ নং প্রশ্ন : পৃষ্টা ৭৮৩ এর ১ নং প্রশ্ন

‘সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন’ কথাটি উল্লেখ না থাকলেও আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি ২০ (২০ নম্বর) সংখ্যাটি উল্লেখ থাকায়। এখানে লেখা আছে :

৪০০ পৃষ্টায় ১ হতে ১০ নং পর্যন্ত

৪০১ পৃষ্টায় ১১ হতে ১২ নং পর্যন্ত

৮২৮ পৃষ্টায় ১৩ হতে ২০ নং পর্যন্ত।

সাদা কাগজের (প্রশ্নপত্রের পাণ্ডুলিপি!) একই পৃষ্টায় লেখা দ্বাদশ শ্রেণির প্রথমপত্র অংশে লেখা রয়েছে :

১ নং প্রশ্ন : ৩৫৮ পৃষ্টার ১ নং প্রশ্ন

২ নং প্রশ্ন : ৩৬০ পৃষ্টার ১ নং প্রশ্ন

৩ নং প্রশ্ন : ৩৬০ পৃষ্টার ৭ নং প্রশ্ন

৪ নং প্রশ্ন : ৩৬৪ পৃষ্টার ৩ নং প্রশ্ন

৫ নং প্রশ্ন : ৩৭০ পৃষ্টার ৪ নং প্রশ্ন

৬ নং প্রশ্ন : ৩৬০ পৃষ্টার ৬ নং প্রশ্ন

৭ নং প্রশ্ন : ৩৬৪ পৃষ্টার ৭ নং প্রশ্ন

৮ নং প্রশ্ন : ৩৬২ পৃষ্টার ৪ নং প্রশ্ন।

দ্বাদশ শ্রেণির দ্বিতীয়পত্র অংশ

১ নং প্রশ্ন : ৭৭৩ পৃষ্টার ৩ নং প্রশ্ন

২ নং প্রশ্ন : ৭৭৭ পৃষ্টার ২ নং প্রশ্ন

৩ নং প্রশ্ন : ৭৭৯ পৃষ্টার ৩ নং প্রশ্ন

৪ নং প্রশ্ন : ৭৭৯ পৃষ্টার ৬ নং প্রশ্ন

৫ নং প্রশ্ন : ৭৭৯ পৃষ্টার ৮ নং প্রশ্ন

৬ নং প্রশ্ন : ৭৭৫ পৃষ্টার ৬ নং প্রশ্ন

৭ নং প্রশ্ন : ৭৭৫ পৃষ্টার ৭ নং প্রশ্ন

৮ নং প্রশ্ন : ৭৭৫ পৃষ্টার ৮ নং প্রশ্ন।

এরপর বহু নির্বাচনী (এমসিকিউ) প্রশ্ন। দ্বাদশ শ্রেণির প্রথম পত্রের অংশে শুধু উল্লেখ রয়েছে : ‘MCQ- 25’। এছাড়া আর কোনো নির্দেশনা দেওয়া নেই। দ্বিতীয়পত্রের অংশে লেখা রয়েছে : MCQ- 25। এখানে নির্দেশনা দেওয়া আছে : ৮২৯ পৃষ্টার মডেল ৫০-এর সব প্রশ্ন।

ফাঁকিবাজিরও একটা সীমা থাকা উচিত। সরকার থেকে নামমাত্র ‘অনুদান’ আর যার যার প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য বেতনে স্কুল-কলেজে দায়িত্ব পালন করছেন আমাদের শিক্ষকরা। কায়ক্লেশে জীবনযাপন করলেও সততা, আদর্শ ও দায়িত্ব পালনে তারা ছিলেন খুবই মজবুত। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে টাকা বরাদ্দ ছিল তাদের ভাবনারও অতীত। ছিটেফোঁটা হলেও এর রেশ আমরাও অনেকটা দেখে এসেছি। হাল জমানায় প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতার পরিমাণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আজ বেশ উল্লেখ করার মতো। তা সত্ত্বেও প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পেশাগত দায়িত্ব পালনে একেকজনের এ কেমন ফাঁকিজুকি! উল্লিখিত ‘টেডি প্রশ্নপত্র’ প্রণয়ন করার ঘটনাটি কি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের? আমার তা মনে হয় না। এটিকে কেবল খামখেয়ালিপনা না, বড় অপরাধ বলে বিবেচনা করার পক্ষপাতী আমি। এমন বিষয় অধ্যক্ষ কিংবা প্রধান শিক্ষকদের কি একেবারেই অজানা অথবা ধারণার বাইরে? প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে চাই সঠিক দেখভাল ও তদারকি।

 

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম