Logo
Logo
×

বাতায়ন

চামড়াশিল্প নিয়ে হালকা আলোকপাত নয়

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চামড়াশিল্প নিয়ে হালকা আলোকপাত নয়

ফাইল ছবি

বেশ কবছর কুরবানি দেওয়া গরু-ছাগলের চামড়ার উপযুক্ত দাম মিলছে না। এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন হলেও তেমন উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। ঈদুল আজহায় পশু কুরবানি সম্পন্ন হওয়ার কদিনের মধ্যেই হাতবদল হয়ে এর চামড়া চলে আসে ট্যানারিতে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্যানারি থাকলেও এর সিংহভাগকে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে সাভারের হেমায়েতপুরে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ট্যানারিশিল্প নগরী’। জামালপুরে এমন আরেকটি ট্যানারিপল্লি গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। সেটি না হওয়া পর্যন্ত পশুর চামড়া প্রক্রিয়াকরণে হেমায়েতপুরের ট্যানারিশিল্প নগরীর কার্যক্রমই বেশি আলোচিত হবে। ২০০৩ সালে এটি গড়ে তোলার কাজ শুরু হলেও তা এতদিনেও সম্পন্ন হয়নি। বিশেষত কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) এখনো পুরোপুরি কার্যকর করতে না পারাটা বেদনাদায়ক। কুরবানি ঈদের পর যখন ওই ট্যানারিপল্লির কারখানাগুলো একযোগে চালু হয়, তখন সিইটিপি আরও অকার্যকর হয়ে পড়ে। আগে হাজারীবাগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা ট্যানারিগুলোর যথেচ্ছ কর্মকাণ্ডে দূষিত হতো বুড়িগঙ্গা; এখন হেমায়েতপুরে দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরী। নদীর আর রেহাই নেই! সেখানে ট্যানারির কঠিন বর্জ্যও নিক্ষিপ্ত হচ্ছে নির্ধারিত স্থানের বাইরে এবং তাতে মাটিসহ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

ট্যানারিশিল্পে দূষণের বিষয়টি সামনে চলে আসে এজন্য যে, এ ইস্যুতে মার খাচ্ছে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাত। এর সম্ভাবনা ধরে এগোনো তো পরে-অর্জিত অবস্থান অটুট রাখাও কঠিন হচ্ছে। এ খাতে বড় আর বিকাশমান যে বাজার রয়েছে ইউরোপে, সেখানে আমাদের সিংহভাগ প্রতিষ্ঠান সরাসরি চামড়া রপ্তানি করতে পারছে না। কিছুটা পারলেও দাম পাচ্ছে অনেক কম। চামড়াজাত পণ্যের বড় ব্র্যান্ডগুলো শর্তারোপ করায় এবং তা পরিপালনে এগোতে না পারায় এ খাতে আমাদের রপ্তানি আয়ের উত্থান-পতনও দেখতে হচ্ছে বেশি। দীর্ঘ করোনাকালেও খাতটি নিয়ে কম ভুগতে হয়নি। রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশকেও নিশ্চয় কমবেশি ভুগতে হয়েছে। অতঃপর আমদানিকারক দেশগুলোয় নতুন করে ভোক্তার চাহিদা বেড়ে ওঠায় রপ্তানিকারকদের জন্য তৈরি হয়েছে সুখবর। চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার বেড়ে ওঠার যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে, তাও উৎসাহব্যঞ্জক। প্রশ্ন হলো, আমরা এর কতটা ধরতে পারব? চামড়াজাত পণ্যের বদলে ‘নন-লেদার’-সামগ্রীর চাহিদাও কম তৈরি হচ্ছে না। দাম এখানে বড় বিবেচ্য। এ ধরনের পণ্যকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন এবং এর মানোন্নয়নের চেষ্টাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বল্প-আয়ের মানুষের কাছে পশুর চামড়ায় তৈরি পণ্য বিলাসদ্রব্য বলেও বিবেচিত। এ অবস্থায় কম দামে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে যারা যতখানি এগিয়ে যাবে, তাদের ‘মার্কেট শেয়ার’ তত বাড়বে বলেই ধারণা। মুশকিল হলো, আমাদের চামড়াজাত পণ্য উৎপাদকদের উলটো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে ক্রেতাগোষ্ঠীর শর্ত মানতে গিয়ে। তাতে কষ্টার্জিত বিদেশি মুদ্রাই কেবল ব্যয় হচ্ছে না; উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে, কমছে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। এ প্রশ্নও বেশি করে উঠছে যে, দেশে এত পশুর চামড়া আহরণের পরও কেন সেটা আমদানি করতে হচ্ছে? এখানে আবারও আসে পরিবেশসম্মতভাবে এ খাত পরিচালনায় আমাদের ব্যর্থতার দিকটি।

এদেশের মাত্র দুটি ট্যানারি নাকি এখন পর্যন্ত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) কাঙ্ক্ষিত সনদ পেয়েছে। হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত কোনো ট্যানারিই এখন পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব হিসাবে ক্রেতাগোষ্ঠীটির সনদ পায়নি। ২০০৫ সালে যাত্রা করা এলডব্লিউজির সদস্য সংখ্যা এখন হাজারেরও বেশি। বৈশ্বিক চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজারে তার নির্দেশিত মানদণ্ড মেনে চলতে না পারলে আমরা যে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ব, সেটা সহজেই অনুমেয়। পরিবেশবান্ধবসহ তাদের শর্ত মেনে আস্থা অর্জন করতে পারলে ভালো দাম পাওয়াসহ বিক্রি বাড়ানো কত সহজ, তার উদাহরণও দেশে রয়েছে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে একটি বিজনেস গ্রুপের ট্যানারি প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করছে। এর ক্রয়াদেশের অভাব হচ্ছে না; ভালো দামও পাচ্ছে। ইউরোপে জুতা রপ্তানিকারক দেশীয় প্রতিষ্ঠানও ওই পরিবেশবান্ধব ট্যানারির চামড়া কিনে ব্যবহার করছে। নইলে এটা তাদের আনতে হতো বিদেশের কোনো সনদপ্রাপ্ত ট্যানারি থেকে। চট্টগ্রামের ওই ট্যানারির পরিচালক সহযোগী দৈনিককে বলেছেন, পরিবেশবান্ধব ট্যানারি গড়ে তোলায় বিদ্যুৎ, গ্যাস আর পানিও কম লাগছে। তার মানে, উৎপাদন ব্যয় কমেছে। কম উৎপাদন ব্যয়ে ভালো দাম পেলে মুনাফা নিশ্চয় বেড়ে যায়।

এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বাড়াতে পারলে দেশে-বিদেশে ফিনিশড লেদার রপ্তানি বাড়ানো যাবে এবং তাতে বিশেষত রপ্তানি আয় যাবে বেড়ে। যারা ইউরোপসহ বিভিন্ন বাজারে চামড়াজাত পণ্য পাঠান, তারা তখন দেশ থেকেই প্রয়োজনীয় চামড়া কিনতে পারবেন ক্রেতাগোষ্ঠীর শর্ত মানতে গিয়ে। দেশেও চামড়াজাত পণ্যের বাজার কম বড় নয় এবং এটা ক্রমবর্ধমান। এ বাজারে আমদানিকৃত পণ্যও কম বিক্রি হচ্ছে না। নন-লেদার পণ্যও ভালোই আমদানি হচ্ছে। এ অবস্থায় খাতটিতে বিদেশি বিনিয়োগও আসতে পারে। চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন এখনো শ্রমনিবিড় এবং এ কাজে আমাদের একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মজুরি আবার তুলনামূলকভাবে কম। এ অবস্থায় চীন, ভিয়েতনামের মতো দেশ থেকেও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ উড়ে আসতে পারে এদেশে। তাতে পোশাকশিল্পের পর একটা বড় ম্যানুফ্যাকচারিং খাত এখানে বিকাশ লাভ করতে পারে। বৈশ্বিক চামড়াজাত পণ্যের বাজারে আমাদের হিস্যা বেড়ে উঠতে পারে, যা এখন সামান্যই। দেশীয় চাহিদা অনুযায়ী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন বাড়ানো গেলে এক্ষেত্রে আমদানির বিকল্পায়নও কঠিন হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, এ খাতের যথেষ্ট কাঁচামাল দেশ থেকেই মিলছে। অনেক দেশকে ফিনিশড লেদার তৈরির জন্য আধা প্রক্রিয়াজাত চামড়া আমদানি করতে হয় কিংবা বেশ দাম দিয়ে ওটা কিনে আনতে হয়। আমাদের তা করার প্রয়োজন অন্তত এখন পর্যন্ত নেই যদি ট্যানারিশিল্পটাকে পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারি।

এটা করা প্রয়োজন বিনা পরিশ্রমে পাওয়া নিজেদের নদীনালা আর পরিবেশরক্ষার জন্যও। এ লক্ষ্যে বিনিয়োগ করা হলে তার রিটার্নও কম মেলে না। পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রেও এটা দেখতে পাওয়া গেছে। ওই খাতে অবশ্য কর্মপরিবেশ নিরাপদ করাটা ছিল মুখ্য ইস্যু, যে বিষয়ে সিংহভাগ নিয়োগদাতাই ছিলেন উদাসীন। ভয়াবহ কিছু দুর্ঘটনার পর পণ্য আমদানিকারকদের চাপেই মূলত এ জায়গায় অগ্রগতি আসে। তাতে আমাদের পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; বরং আমেরিকা-ইউরোপের বাজারে তার হিস্যা বাড়িয়ে তুলতে পেরেছে। বেড়েছে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও। দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। একটা সময় পর্যন্ত এখানে উৎপাদিত চামড়ার ভালো বাজার কিন্তু ছিল। দেশীয় রপ্তানি পণ্যের নাম করতে বললে মুখস্থ বলে দেওয়া হতো-পাট, চামড়া, চা। পরে পোশাকশিল্প এসে এগুলোকে পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে যায়। এটা আমাদের অর্থনীতি ও সমাজে বড় রূপান্তরও ঘটায়। তবে মনে রাখতে হবে, এ খাতটি আবার আমদানিনির্ভর। চামড়ার ক্ষেত্রে চিত্রটা বিপরীত। এর কাঁচামাল আমরা পাচ্ছি দেশ থেকেই এবং তার মান ভালো। এখন ট্যানারিগুলোকে পরিবেশবান্ধব করা গেলে ক্রেতাগোষ্ঠীর শর্তে চামড়ার যেটুকু আমদানি করতে হয়, সেটাও এড়ানো যাবে। ইউরোপে রপ্তানিতে ব্যর্থ হয়ে যে বিপুল আধা প্রক্রিয়াজাত চামড়া চীনসহ বিভিন্ন দেশে পাঠাই এবং কম দাম পাই, সে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসাও তখন কঠিন হবে না।

শুরুর কথাটায় ফিরে আসা যাক। কুরবানি ঈদে যে বিপুল পরিমাণ পশুর চামড়া হাতে আসছে, যেটা নাকি সারা বছরে আহরিত চামড়ার অর্ধেক, এর উপযুক্ত দাম পাওয়াটাও সহজ হবে ট্যানারিশিল্পকে মানসম্মত করা গেলে। কাজটি এর মধ্যে এগিয়েও যেত, যদি সরকার হেমায়েতপুর প্রকল্প বাস্তবায়নে এইভাবে ব্যর্থ না হতো। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা সেই ২০০৩ সালে গৃহীত এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সফল হয়েছে বলা যাবে না। একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সিইটিপি নির্মাণ এবং তা কার্যকরভাবে ব্যবহারে সংস্থাটির ব্যর্থতার পক্ষে কোনো যুক্তি খাড়া করানো যাবে না। এ প্রকল্পের অর্ধেকটাই নাকি ব্যয় হয়েছে সিইটিপি প্রতিষ্ঠায়, যা বিশেষভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে কুরবানি ঈদের সময়। বছরের অন্য সময়েও কি এটা নিক্ষিপ্ত সব ক্ষতিকর তরল বর্জ্য পরিশোধনে সক্ষম? কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। ট্যানারি বর্জ্য মুরগি ও মাছের খাবারে মেশানোর অভিযোগ নিষ্পত্তিও কি করা গেছে? শুধু বিদেশি ক্রেতাদের শর্ত পালন তো নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশে জনস্বাস্থ্য রক্ষার প্রশ্ন।

আমরা যেন আলাদা করে পশুর কাঁচা চামড়ার দাম নিশ্চিত করতেও এগিয়ে আসি। কুরবানি ঈদ বাদে বছরের অন্য সময়েও কি এর উপযুক্ত দাম মেলে? মিললে গরু-ছাগলের মাংসের দামও হয়তো এভাবে বাড়ত না। একটা সময় কুরবানি ঈদে কাঁচা চামড়ার যে দাম মিলত, এখন মিলছে তার অর্ধেক। ছাগলের চামড়ার কোনো দামই নেই। এতে করে সরাসরি বঞ্চিত হচ্ছে এর দামটা যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী পেত, তারা। তাদের বঞ্চিত করতেই এ আয়োজন-এমন তীব্র অভিযোগও শোনা যায়। ট্যানারির পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক বাজারে কম দাম পেলে তারা বেশি দামে চামড়া কিনবেন কীভাবে? এক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা দরকার, বিশেষত কুরবানি ঈদে একযোগে বিপুল জোগান পাওয়াতেই পানির দামে চামড়া কেনার সুযোগটা তারা লুফে নিচ্ছেন কি না। কাঁচা চামড়ার রপ্তানি বন্ধ রেখে এবং সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে একটা সংরক্ষিত বাজারে এদের মুনাফা শিকারের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে কি না, সে তির্যক প্রশ্নও উঠছে। এ অবস্থায় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতটি নিয়ে হালকার ওপর আলোচনা করে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়াটা শেষ বিচারে আত্মঘাতী হতে বাধ্য।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম