প্রাথমিকে শিখন ঘাটতি দূর করার উপায়
মো. সিদ্দিকুর রহমান
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। তারা বাংলা পড়তে পারে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় এনসিটিবি পরিচালিত এ গবেষণা জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের পক্ষ থেকে রইল অভিনন্দন। করোনা মহামারি সারা বিশ্বকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। শুধু প্রাথমিক নয়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
প্রাথমিকে যাদের করোনা মহামারিজনিত কারণে শিখন ঘাটতি ছিল, বর্তমানে সেসব শিক্ষার্থী ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিখন ঘাটতি দূর করার প্রয়াসে অনলাইনে ও টিভিতে পাঠদানের পাশাপাশি অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেছেন। সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা থাকায় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকদের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। করোনা-পরবর্তী সময়ে শিখন ঘাটতি দূর করার নামে শ্রেণির কার্যক্রমের শেষে ১৫ মিনিটের একটি ক্লাস রাখা, বিভিন্ন সময়ে ছুটি কমিয়ে প্রাথমিকের সঙ্গে অন্যসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির বৈষম্য করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও শিখন ঘাটতির অপবাদ থেকে মুক্তি পায়নি প্রাথমিক শিক্ষা। পানির স্বাভাবিক ধর্ম হলো তা নিচের দিকে গড়ায়। অনুরূপভাবে শিখন ঘাটতির এ অপবাদ প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর বর্তায়।
এত বিশাল মন্ত্রণালয়, মহাপরিচালকের দপ্তরসহ সবাই যেন ধোয়া তুলসীপাতার মতো পবিত্র। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষে’র মতো সব দোষ যেন প্রাথমিক শিক্ষকদের। সমাজের উচ্চবিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দটি করে না। বিষয়টি অনেকটা ‘ভাসুরের নাম উচ্চারণ করা উচিত নয়’-প্রবাদের মতো।
শিখন ঘাটতি দূর করার কতিপয় চ্যালেঞ্জ
১. শিক্ষক সংকট: প্রাথমিকের শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। বিগত সময়ে দীর্ঘ প্রায় ৩ বছর পর ৩৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল। এ সময়ক্ষেপণ প্রক্রিয়া অনেকটা ‘নদীর একূল গড়ে ওকূল ভাঙে’ প্রবাদের মতো। সুনামগঞ্জসহ দেশের সর্বত্র শিক্ষক সংকটে নিমজ্জিত। প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষকের সংকটে প্রাথমিক শিক্ষা চলছে, অনেকটা দৌড়ের ওপর। অপরদিকে ২/১ জন বিশিষ্ট শিক্ষক ছুটি বা অফিসিয়াল কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে গিয়ে হারিয়ে যায় শিখন ঘাটতি দূর করার স্বপ্ন।
২. হতদরিদ্রের নিচে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে : শিক্ষাবান্ধব সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক অর্জনের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভবন, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন নজর কাড়ার মতো। অথচ বেসরকারি-সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা ভর্তিসহ সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুদৃশ্য ভবন যেন শিক্ষার্থী সংকটে তালগাছের মতো একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চবিদ্যালয়, কলেজগুলো শুরু হয় প্লে/নার্সারি থেকে। শিশুর স্বর্গের পাঠশালার মতো সুসজ্জিত ও শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমারোহের পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে আজ যেন ‘উপর দিয়ে ফিটফাট ভিতর দিয়ে সদরঘাট’ প্রবাদের মতো। এ ছাড়াও যত্রতত্র গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন/ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। এতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী হিসাবে সর্বনিম্ন স্তরের গরিব অভিভাবক বা অভিভাবকহীন শিক্ষার্থীদের টেনে এনে বিদ্যালয়ে কোনো রকম পড়াতে হয়। দারিদ্র্যের কারণে বাবা-মাকে পারিবারিক প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে হয় বিধায় তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ে সময় দিতে পারে না। ফলে শিখন ঘাটতির ব্যাপকতা থেকে যায়।
৩. বিদ্যালয়ের সময়সূচি : সারা দেশে বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ও ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দুপুর ২টার আগেই পাঠদান কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। ফলে তারা দুপুরে গোসল করে গরম ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকালবেলা খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ পেয়ে থাকে। প্রাথমিক দীর্ঘ সময়সূচি এদেশের সর্বস্তরের অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের কাছে বিরক্তিকর। অধিকতর শিক্ষাদানের প্রয়াসে মানসিক-শারীরিক বিকাশ ও সুস্থতা এ সময়সূচির অন্তরায়। ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে শিক্ষাবান্ধব সরকারের নানা প্রশংসনীয় কার্যক্রম যেমন-উপবৃত্তি, পুষ্টিকর বিস্কুট, শিশুবান্ধব বিদ্যালয়ের পরিবেশ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক-সবকিছু যেন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
বিদ্যালয়ের পিরিয়ডের সময়সূচি : প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিটি পিরিয়ডের সময় ৫০ থেকে ৩০ মিনিট। নাম-ডাকাসহ কুশলাদি বিনিময়সহ স্বল্প সময়ে শিক্ষার্থীদের বলার ও লেখার ক্ষমতা অর্জন করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ অবস্থায় শিক্ষকরা সাধারণত শ্রেণিকক্ষে আসা-যাওয়াসহ কোনো রকম পাঠ সম্পর্কে আলোচনা করে আগামী দিনে বাড়ির পড়া ও কাজ দিয়ে শ্রেণির কার্যক্রম শেষ করেন। শিক্ষার্থী বাড়ি গিয়ে ক্লান্ত শরীরে বিকালবেলা খেলাধুলাবিহীন বেশিরভাগ শিশু সন্ধ্যার পর ঘুমিয়ে পড়ে। ছয়টি বিষয়ে বাড়ির পড়া বা কাজ না করায় অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা শিখন ঘাটতি রেখেই কোনো ক্লাস টপকাতে থাকে।
শিখন ঘাটতি দূর করার কতিপয় পরামর্শ : ১. শিক্ষক সংকট শূন্য সহিষ্ণুতায় নামিয়ে আনা প্রয়োজন। ২. বেসরকারি-সরকারি কলেজ, উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা বিলুপ্ত করতে হবে। যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন বা ইবতেদায়ি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। ৩. শিক্ষকের ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। ৪. প্রতিটি ক্লাসের সময়সূচি কমপক্ষে ১ ঘণ্টা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী সমস্বরে পাঠ্যাংশ কমপক্ষে পাঁচবার পড়ার ব্যবস্থা ও কঠিন শব্দের উচ্চারণ শ্রেণিতে শেখাতে হবে। শিক্ষার্থীর পড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ৫. প্রতিদিন চারটি পিরিয়ডের বেশি পাঠদান হলে শিক্ষার্থীর ওপর বেশি চাপ পড়বে। হাইস্কুল-কলেজ, কিন্ডারগার্টেনের মতো দুপুর ২টার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ছুটি দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা বাড়িতে গিয়ে গোসল সেরে দুপুরে গরম খাবার খেতে পারে।
দুপুরে খাবার খেয়ে বিশ্রাম বা ঘুমিয়ে ফুরফুরে মেজাজে সুস্থ ও সুন্দর দেহে বিকালবেলা খেলাধুলা, বিনোদন করার সুযোগ পায়। রাতে শিক্ষক যে পড়া স্কুলে পড়িয়েছেন, শিক্ষার্থী সে পড়া একটু দেখবে। যেখানে শিক্ষার্থী বুঝতে অক্ষম হবে, সে পড়া শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখে নেবে। রাতে টিভিতে শিক্ষার্থী নাটক, শিক্ষামূলক বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপভোগ করবে। ৬. প্রত্যেক বিদ্যালয়ে পাঠাগারে শিশু শিক্ষার সহায়ক পর্যাপ্ত বই ও খবরের কাগজ থাকবে। শিক্ষার্থীকে পাঠাগারে বই বা পত্রিকার পড়ার জন্য শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সময় ও সুযোগ প্রতিনিয়ত থাকতে হবে। সর্বোপরি তৃণমূলের শিক্ষকদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে শিখন ঘাটতি দূর করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে সব ষড়যন্ত্র দূর হবে।
মো. সিদ্দিকুর রহহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ