Logo
Logo
×

বাতায়ন

সব বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা

Icon

ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সব বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা

দুটি বর্ণের খুব ছোট একটি নাম বাবা; কিন্তু বাস্তবতায় তার গভীরতা আর বিশালতা সীমাহীন। আদর-শাসন, স্নেহ-মায়া-মমতা, সন্তানকে ভালো রাখতে নিজের প্রাণটুকুও যিনি দিতে প্রস্তুত থাকেন, তার নাম বাবা। প্রত্যেক বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু, যার ঋণ পরিমাপ করার ক্ষমতা সন্তানদের প্রকৃতি দেয়নি।

মা দিবস কয়েকশ’ বছর ধরে পালন করা হচ্ছে, কিন্তু বাবা দিবসটি অনেক নতুন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে বাবা দিবস পালন শুরু হয়। মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল, এটি বোঝানোর জন্যই এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। মা দিবস বা বাবা দিবস সন্তানের চোখের সামনের পর্দাটি খুলে পিতা-মাতার প্রতি তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে মা দিবস বা বাবা দিবসের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। মোট কথা, আমাদের পরিবার তথা সমাজে বাবার যে গুরুত্ব তা আলাদাভাবে তুলে ধরাই বাবা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য।

বাবার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর জন্যই প্রতি বছর ‘বিশ্ব বাবা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকে যার শুরু। বাবা দিবস হলো বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের একটি অন্যতম দিন। আমাদের বিশ্বস্ততার জায়গা হলো মা-বাবা। এ পৃথিবীতে তাদের মতো আপনজন আর কেউ নেই। তারা আমাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত।

সব ধর্মেই বাবার সন্তুষ্টির কথা বলা হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উহ্’ শব্দটিও বলো না, তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সঙ্গে আদবের সঙ্গে কথা বলো। তাদের সম্মুখে করুণভাবে, বিনয়ের সঙ্গে নত থাকবে। আর এরূপ দোয়া করতে থাকবে, হে আমার পরওয়ারদেগার, তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন, যেরূপ তারা আমাকে লালন-পালন করিয়াছেন শৈশবকালে” (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩, ২৪)।

প্রিয় নবি করিম (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। আর সে বেহেশত অর্জন করার পূর্বশর্ত হচ্ছে তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, নরম ভাষায় কথা বলা, সম্মানের চোখে দেখা।’ পিতা-মাতা সবসময় সন্তানের কল্যাণের কথা ভাবেন। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে কোনো সন্তান কখনো সফলতার পথে এগিয়ে যেতে পারে না। মা-বাবার অবাধ্য সন্তানের ধ্বংস অনিবার্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে’ (তিরমিযি-১৮৯৯)।

শাস্ত্রে বলা হয়-‘পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহী পরমং তপঃ। পিতরী প্রিতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা। অর্থ-পিতাই ধর্ম, পিতাই স্বর্গ, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে খুশি করলে সব দেবতা খুশি হন।

সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসা চিরন্তন। বাবা মানে ভরসার জায়গা, পরম নির্ভরতার প্রতীক, এক সাগর ভালোবাসা। বাবা মানে উত্তপ্ত সূর্যের নিচে সন্তানের শীতল ছায়া, নির্ভরতার আকাশ, নিরাপত্তার চাদর। বাবা সন্তানের মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়ার মতো, যার স্নেহ অবারিত ধারায় শুধু ঝরতেই থাকে। বাবা সব সন্তানের কাছেই পরম পূজনীয়, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু। বাবার ছায়ায় বড় হওয়া সন্তান জানে কতটা নির্ভরতায় বেড়ে উঠেছে সে, আবার জীবন কত কঠিন, তা জানে বাবাহীন বড় হওয়া সন্তানরা। যার বাবা নেই একমাত্র সে-ই জানে বাবা না থাকার বেদনা। বাবা শব্দটি পৃথিবীর সর্বত্র নিখাদ ভালোবাসার সঙ্গেই উচ্চারিত হয়। কারণ সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় বাবাকে। বাবার রূপে ফুটে ওঠে কখনো শাসন, কখনো ভালোবাসা।

আসলে মা দিবস নিয়ে মানুষ যতটা উৎসাহ দেখাত, বাবা দিবসে মোটেও তেমনটা দেখাত না, বরং বাবা দিবসের বিষয়টি তাদের কাছে ততটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছেই মা দিবস বা বাবা দিবস পালনের বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পায় না। তবে ধীরে ধীরে অবস্থা পালটায়, ১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য একটা বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন।

অবশেষে ১৯৬৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন সিদ্ধান্ত নেন, প্রতি বছর জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস হিসাবে পালন করা হবে। ছয় বছর পর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এটিকে আইনে পরিণত করেন। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস হিসাবে পালিত হয়।

সন্তানের জন্য বাবার ভালোবাসা অসীম, অকৃত্রিম, স্বার্থহীন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি ঘটনা সবাইকে হতচকিত করে। বাবরপুত্র হুমায়ুন জটিল রোগে আক্রান্ত হলেন, বাঁচার কোনো আশা রইল না। সম্রাট বাবর রোগগ্রস্ত পুত্র হুমায়ুনকে বাঁচাতে আল্লাহ্তায়ালার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তার নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষার। হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠেন, আর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সম্রাট বাবর। এমন স্বার্থহীন যার ভালোবাসা, সেই বাবাকে সন্তানের খুশির জন্য জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। বাবা দিবসে সন্তানদের সামনে সুযোগ আসে বাবাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা জানানোর। সমাজে ও পরিবারে বাবাদের যে অবদান, বাবা দিবস পালনে নিজের সন্তানের মূল্যায়নে বাবারাও কিন্তু বেশ পুলকিত বোধ করেন।

অনেক সন্তানই আছে, যারা পিতা-মাতার দেখাশোনার প্রতি খুব একটা মনোযোগী নয়। সংসারের জন্য কত কষ্টই না করতে হয় একজন বাবাকে। তিনি তার সন্তানকে জীবনের সব উত্তাপ থেকে সামলে রাখেন। অথচ সেই বাবাকে অনেকেই কষ্ট দিতেও দ্বিধা করে না। সন্তানের সঙ্গে বাবার যে নিবিড় সম্পর্ক, তা আমাদের সমাজে কতটুকু বিদ্যমান? বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক সন্তান তাদের বাবাকে বোঝা ভাবে। পিতার বুকফাটা তীব্র যন্ত্রণার আর্তনাদ না শোনার মতো সন্তানও আছে এ সমাজে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে বাবা সন্তানদের মানুষ করেন, সব সঞ্চয় ব্যয় করেন, হাজারও কষ্ট সয়ে তিলে তিলে যে সন্তানকে বড় করেন, যে বাবা-মা এক সময় নিজে না খেয়েও সন্তানের মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, জীবন সায়াহ্নে এসে বৃদ্ধ বয়সে তাদের অনেকেই অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েন। তারা নিজেদের জীবনের সব ধনসম্পদ, সময় বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, রাখেননি নিজের জন্য কিছুই, তারাই আজ সন্তানের অবহেলা-অযত্নের কারণে, কখনো কখনো দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে আশ্রয় নেন বৃদ্ধনিবাসে। দেখা যায়, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল সন্তান নৈতিকতার অবক্ষয়ের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাবাকে ত্যাগ করে ফেলে যাচ্ছে এসব বৃদ্ধাশ্রমে, তাদের খরচ দেওয়া তো দূরে থাক, একবার গিয়ে খবরও নেয় না। আস্তাকুঁড়ে আবর্জনা ফেলার মতো একবার বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এসেই মনে করে দায়িত্ব শেষ।

করোনা মহামারির সময় তাদের দুর্ভোগের মাত্রা যে কত বেড়ে গিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। খবরে দেখা গেছে, বৃদ্ধ মা-বাবাকে রাস্তায় ফেলে চলে গেছে সন্তান। এক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তার স্ত্রী, পুত্র, মেয়ে সবাই মিলে তাকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখেন। তিনি যাতে ঘর থেকে বের হতে না পারেন, সেজন্য বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে রাখেন। মৃত্যুর আগে তিনি অনেক ডাকাডাকি করলেও কেউ দরজা খোলেনি, এমনকি তাকে খাবার পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত লোকটি মারা গেলেন, মারা যাওয়ার পর পরিবারের কেউ তাকে শেষ দেখা দেখে দাফনটুকু করতেও আসেনি, পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে দাফন করেন।

আরও একটি ঘটনার অবতারণা করছি। এক বাবা একজন পুত্রসন্তান পেতে অস্থির, তার স্ত্রী পরপর নয়টি কন্যাসন্তান জন্ম দেন। এর পরের সন্তানটি হয় পুত্র, বাবা পরম শান্তির সঙ্গে পুত্রসন্তানের মুখ দেখে আনন্দে আত্মহারা হন। ধীরে ধীরে ছেলেটি বড় হতে থাকে, সব মেয়ের বিয়ে হয়, তারা স্বামীর বাড়িতে চলে যায়। এক সময় বাবা যখন অকর্মণ্য বৃদ্ধ অবস্থায় পতিত হন, ওই আদরের ছেলেটাই বাবাকে বোঝা মনে করতে থাকে। কোনো একসময় বাবা একটি ছোট্ট আবদার করে বসেন, এতে ছেলেটি ক্ষিপ্ত হয়ে বাবাকে মারতে মারতে বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে ফেলে আসে। যে বাবা তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ছেলেকে (অ)মানুষ করে তোলেন, শেষ বয়সে এই তার প্রতিদান!

নানা কারণে একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, আর তাতে স্থান হচ্ছে না বাবা-মায়ের। ঝামেলা এড়াতে বয়স্ক বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাদের দিনগুলো কত কষ্টে কাটে, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়াটাও অনেকে প্রয়োজন মনে করেন না। সন্তান নিজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা-মাকে নিঃশেষ করে তাদের শেষ বয়সে ছুড়ে ফেলার জন্যই এরকম একটা বৃদ্ধাশ্রম হয়তো দরকার ছিল।

সন্তানের পক্ষ থেকে বিশ্ব বাবা দিবসে সব বাবার প্রতি রইল সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শুভ কামনা। ছোট-বড়, অখ্যাত-বিখ্যাত সবার কাছেই বাবা অসাধারণ। নির্ভরতা-ভরসার গভীর সম্পর্কের নাম বাবা। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা সবারই প্রথম চাওয়া আর পাওয়া। সন্তানের প্রতি বাবার যেমন ভালোবাসা, তেমনি বাবার প্রতিও সন্তানের হৃদয়ে পুঞ্জীভূত থাকুক গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ। প্রত্যেক সন্তান একটা বয়স পর্যন্ত নিজের সফলতা অর্জনের পেছনে সংগ্রাম করে, যে সংগ্রামটা তার বাবা এত বছর সন্তানের জন্য করে এসেছে। কিন্তু প্রত্যেক বাবার সৌভাগ্য হয় না তার সন্তানের সফলতা দেখে যাওয়ার। বিশ্বের সব বাবা ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন-এটাই আল্লাহতায়ালার দরবারে প্রার্থনা। তিনি যেন আমাদের প্রিয় বাবা-মাকে দীর্ঘায়ু দান করেন এবং সুস্থ রাখেন। হে আল্লাহ, আমি সফল না হওয়া পর্যন্ত আমার বাবাকে বাঁচিয়ে রেখো।

ডা. এবিএম আবদুল্লাহ : ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম