Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাজেটের স্বরূপ ও বাস্তবতা

Icon

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজেটের স্বরূপ ও বাস্তবতা

ফাইল ছবি

বায়ান্ন বছর বয়সি বাংলাদেশের বাজেট বিশাল হবে, টাকার অঙ্কে তো বটেই বক্তৃতার বহরেও। যা নিজে লিখতে হয় না, পড়তেও হয় না, মিডিয়া প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়ার জন্যও কেউ না কেউ থাকে। এটা বলা এজন্য যে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটটি একটা নির্বাচনি ইশতেহারে পরিণত হয়েছে। হবেই নাই বা কেন? সামনে যে নির্বাচন। রক্ষে যে মিডিয়া ছিল, সেই-ই সুন্দর করে উপস্থাপন করে সনাতন বাজেটের জাত-কুল-মান বজায় রেখে চলেছে। আর আছে সিপিডি, তারা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র মতো বাজেটের ওপর রাত জেগে বিশ্লেষণপত্র রচনা করে। তাদের বিশ্লেষণে ধার আছে, কিন্তু না শুনলে কি যায় আসে? যাদের জন্য বাজেট, তারা এসবের কিছু জানে না।

প্রায় তিন হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের অসাধারণ নাগরিকের দেশে কেউ যখন হতাশ হয়ে বলে ‘কোনো রকমে খেয়ে-পরে বাঁচতে চাই’; তখন ব্ল–মবার্গ, রয়টার্সের মতো বিশ্ব চিন্তার চৌবাচ্চারা বাংলাদেশের ক্ষমতায়নের রিলে রেসে মেডেল বিতরণে ব্যস্ত। হিসাব মিলছে না, মিলানো যাচ্ছে না। কাজীর খাতায় থাকলেও, গোয়ালের গরুর হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। বাজেট বানানো, কণ্ঠ ভোটে পাশ করানো, তারপর যে যার মতো ঠকানো, পটানো, গোটানো সবই চলতে থাকবে- আসছে বছরে নতুন আরেকখান বাজেট আসা পর্যন্ত। এ বাজেটের স্বরূপ ও বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক, কিন্তু তাতে কী?

যেমন ধরা যাক, বাজেটের অর্থের জোগান পেতে সরকার আগের চেয়ে বেশি ব্যাংকমুখী হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকার চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ চলতি বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি বাড়বে। যদিও অর্থনীতির সাধারণ সূত্র হচ্ছে, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে তার প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। কারণ, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরকার টাকা ছাপিয়ে মেটায়। টাকা ছাপালে তখন বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ে। যে মূল্যস্ফীতি কোনো রকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চাওয়া মানুষদের কাছে সাক্ষাৎ যম। বড় কর্তারা বলছেন ‘ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হচ্ছে, পুরো অর্থবছরে তা নেও য়া হলে মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ টাকাগুলো উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করাই সরকারের উদ্দেশ্য।’

পক্ব কেশ বুদ্ধিজীবী, টাকওয়ালা আমলা এমনকি পাঁচ ক্লাস পাশ করা, সেও বোঝে, জানে ও শিখেছে যে- বেশি ব্যাংক ঋণ মানেই বেশি টাকা ছাপানো। আর বেশি টাকা ছাপানো মানে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা। শুধু তাই নয়, এতে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্মসংস্থানব্যবস্থা। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে নগদ টাকা দিয়ে বরং দারিদ্র্যকে টিকিয়ে রাখা, কর্মসংস্থান, সুচিকিৎসা ও মানসম্পন্ন শিক্ষা দ্বারা সৃষ্ট সক্ষমতাই যে সামাজিক সুরক্ষার সোপান; সেটার বাপের নাম ভুলিয়ে দেওয়ার আয়োজনই চলছে।

যেমন ধরা যাক, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈশ্বিক সংকট, ডলার সংকট, ব্যবসা-বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ নানামুখী চাপ সঙ্গে করে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে ডলার সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর বিপরীতে দেওয়া শর্ত পালন করতে গিয়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে, সঙ্গে লোডশেডিংও। যার প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। এ ছাড়া ব্যাংক, আর্থিক ও রাজস্ব খাতে ব্যাপক সংস্কার আনতে, প্রতি বছর দশমিক ৫ শতাংশ হারে করদাতা বাড়াতে হবে। আর মাত্র ছয় মাস পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

বহুমুখী চাপের মুখে এ নির্বাচন সামনে রেখে জনগণকে সামান্য হলেও স্বস্তি দেওয়াই উদ্দেশ্য বিধেয় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন একটি ধারণা দাঁড় করতে চাওয়া যে, ধারাবাহিকতা থাকলেই এসব করা হবে। বাজেটের দলিলপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বিশাল আকারের রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে বাড়াতে হবে করের আওতা। এজন্য নিুআয়ের মানুষকেও করের আওতায় আনার পরিকল্পনা আঁটা হয়েছে। যদিও বিশ্লেষকরা এমন সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন।

শোনা যায়, প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল আগামী অর্থবছরের জন্য একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট প্রণয়নের; যার আকার হবে পৌনে ৮ লাখ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন; অর্থবছরের শেষ দিকে এসে দেখা গেল বড় বাজেট তৈরির জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা সংকুলান করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে নির্বাচনি বছরের বাস্তবতার নিরিখে। কারণ এ সময় সিন্ডিকেট ভাঙার পরিবর্তে তাদের তোষণের প্রয়োজন পড়বে, শুল্কহার বৃদ্ধি যতটা সম্ভব কম করাই হবে কায়েমি স্বার্থবাদীদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিমানের কাজ। ফলে সরকারের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজটি যে সংস্থাটি করে, সেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষে বড় বাজেটের অর্থ জোগান দেওয়া আদৌ সম্ভব হবে না জেনেও উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর পথ ধরা হয়েছে।

করের আওতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তের খুশি ধরে রাখতে গিয়ে নিুমধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও টার্গেট করার মতলব আঁটা হয়েছে। ভাবা হয়েছে উচ্চবিত্তরাই তাদের, নিুবিত্তের বাঁচা মরাকে আমলে নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। সে কারণেই বাজেট বক্তৃতায় বিগত দেড় দশকের উন্নয়ন অভিযাত্রার সাফল্য গাঁথা আছে, বিদেশিদের প্রশংসার সারণি সারমর্ম আছে; কিন্তু দৃশ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর পটভূমির কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে, তা মোকাবিলার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের নির্ভার মনে হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় কৌশল বাস্তবায়নের রোডম্যাপও নেই। বিগত দেড় দশকের সাফল্যকে সাক্ষী রেখে ‘উন্নয়নের দেড় দশক : স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ স্লোগান দিয়ে চলমান বাজেটই ঘোষণা করা হয়েছে নির্বাচনের বছরে। ভাবখানা এ বায়ান্ন বছর বয়সি বাংলাদেশের আগের সাঁইত্রিশটি বছর ছিল অনুন্নয়নের (এমনকি সরকারের ১৯৯৬-২০০০ সময়কালও)।

দশ বছর চাঁদা দিয়ে ‘সর্বজনীন’ (!?) পেনশন প্রাপ্তির লোভ দেখানোকে প্রচারণায় আনা হয়েছে এবার। যাই হোক, স্ব-সৃষ্ট নানাবিধ সংকটে নিমজ্জিত অর্থনীতিকে উদ্ধারের দায়কে পাশ কাটিয়ে বিশাল সরকারি ব্যয় বন্ধ বা কম করার পরিবর্তে ব্যয়বহুল নতুন নতুন মেগা প্রকল্প শুরু করার ব্যয়বহরের বিশাল বপু দেখিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে, সুশাসনবর্জিত উন্নয়নই অব্যাহত রাখতে হবে। অতি সম্প্রতি মুডির মানদণ্ড অবনমনে বিশ্ব বাণিজ্যে বিনিয়োগে, ঋণ কিংবা অনুদান প্রাপ্তিতেও মরাকটাল পরিস্থিতি সামনে আসার ব্যাপারে কোনো উদ্বেগ বাজেটে নেই।

আগামী বাজেটের রূপরেখায় সরকারের পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা; যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বা ৬০ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকার বেশি। পরিচালন ব্যয়ের হিসাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ বাড়ছে ৩৫ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। সংকট সত্ত্বেও উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা; যা চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত জিডিপির চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ রয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বৈশ্বিক সংকটেও এ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা যদিও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীরা বলছে, বৈশ্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আগের তুলনায় হ্রাস পাবে। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ধরে রাখার সেই চেষ্টা টানা প্রায় দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে; যা এখন প্রায় ২ অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই। মূল্যস্ফীতির এ চাপকে ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে আগামী বাজেটেও। স্বরূপ ও বাস্তবতার এই ব্যবধান বোঝা যাবে সময়ের অবসরে।

আইএমএফ’র শর্তানুযায়ী প্রতি বছর ০.৫ শতাংশ হারে করদাতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ২০২৬ সালে মধ্যে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চূড়ান্ত উত্তরণের জন্য আরও কিছু বাধ্যবাধকতাও মানতে হবে; যার বহুমুখী প্রভাব হিসাবে জনগণের ঘাড়ে করের চাপ বাড়বে। এদিকে এনআইডি কার্ডের অধিকারী সবাইকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। তবে যাদের টিআইএন রয়েছে অথচ তারা ন্যূনতম আয় যোগ্য কর সীমার নিচে, এমন ব্যক্তিদের সবাইকে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা হারে আয়কর প্রদানও বাধ্যতামূলক করতে চাওয়া হয়েছে এ বাজেটে। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বিপরীতে দেওয়া ৩৮ রকমের শর্তারোপ করেছে আইএমএফ। এর ফলস্বরূপ ইতোমধ্যে একাধিকবার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাজেটের পর খুবই কম সময়ের মধ্যে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণাও আসতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের খেলাপি কমানো ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনতে এ খাতে আরও কয়েকটি সংস্কার আনতে হবে সরকারকে। বছর কয়েক আগে ব্যাংক কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়ার কথা এখন আর উচ্চারিতই হয় না। এটা এ জন্য কিনা যে, সবাইকে এ বার্তা দেওয়া যে, ব্যাংক বা আর্থিক খাতে এমন কিছু ঘটেনি বা ঘটানো হয়নি যে কারণে ব্যাংক কমিশন গঠন করার দরকার হবে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম