এ বাজেটে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না
ড. মাহবুব উল্লাহ
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্য, কর্মসংস্থানের অভাব, বেসরকারি খাতে অপ্রতুল বিনিয়োগ, ডলার সংকট, গ্যাস ও কয়লার অপ্রতুল জোগানে জ্বালানি সংকট, অর্থ পাচারের ফলে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ, রিজার্ভ সংকট, অসহনীয় মূল্যস্ফীতি, প্রবাসী আয় প্রবাহে অস্থিরতা এবং মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় ভেঙে জীবনযাপনের পুঞ্জীভূত সংকটের মধ্য দিয়ে পেশ করা হলো নতুন আর্থিক বছরের বাজেট।
এতসব সংকটের চাপেও অর্থমন্ত্রী পেশ করেছেন ঢাউস আকারের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ৩৫ শতাংশ। বিরাট অঙ্কের এ ঘাটতি মেটানোর জন্য যে ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়েছে, তা হলো ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ হিসাবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে প্রাপ্তি ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। দেশীয় সূত্র থেকে যে ঋণ আসবে তার উৎস হলো ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য একেবারেই সন্তোষজনক নয়। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ মানে টাকা ছাপানো। টাকা ছাপিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা হলে মূল্যস্ফীতি আরও লাগাম ছাড়া হয়ে উঠবে। মধ্যবিত্ত, নিুবিত্ত ও গরিব মানুষের দুরবস্থা বাড়বে। যারা দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করেছিল তারা আবারও দরিদ্র হয়ে যাবে। দরিদ্ররা হবে হতদরিদ্র। রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্য ধরা হয়েছে, ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থা প্রশ্নাতীতভাবে দুর্বল। এ ব্যবস্থা অতীতে প্রায়ই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কীভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে এত বিশাল অঙ্কের রাজস্ব প্রাপ্তি সম্ভব হবে তা ভেবে কূল পাই না। বিগত অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ১০ মাসে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। অনুরূপ ঘাটতি নতুন অর্থবছরে হবে না, তার জন্য আস্থা পাব কোথায়? আইএমএফ’র ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে নতুন অর্থবছরে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। এটাও কি সম্ভব হবে?
বিদেশি ঋণ থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বিদেশি সূত্র থেকে আসবে বলে ভরসা করা যায় না। মুডি’স রেটিংয়ে বাংলাদেশের ঋণ মানে অবনমন ঘটেছে। মুডিসের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাহ্যিক দুর্বলতা ও তারল্য ঝুঁকি এবং এর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার বিষয়টি চলমান সংকটের সময়ে উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের সভরেন ক্রেডিট প্রোফাইল “বি-১’ রেটিং’র সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
গত অর্থবছরের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ৫৬ শতাংশ এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি ৩১ শতাংশ কমেছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, শিল্প খাতের বিকাশ শ্লথ হয়ে পড়েছে। এমনকি শিল্প খাতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে এমন কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না।
বিগত অর্থবছরে চলা বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এখনো কাটেনি। ২৪ মে ২০২২ থেকে বিভিন্ন সালে ২৪ মে ২০২৩ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। ২৪ মে ২০২৩-এ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯.৯৬ বিলিয়ন ডলার। ২৪ মে ২০২২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪২.২৯ বিলিয়ন ডলার। মধ্যবর্তী সময়ে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে দেশে বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পায়রার প্রথম ইউনিট। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির বিলও যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে এসব পণ্যের আমদানি। ডলারের তীব্র সংকটের মধ্যেই সরকার ঘোষণা করেছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট। ১ জুন ২০২২-এ ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৯ টাকা, ৩০ মে ২০২৩ ডলারের বিনিময় হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮.৫০ টাকা। বাংলাদেশের মতো একটি আমদানিনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কী ধরনের সংকটে পড়তে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
কর রিটার্ন দাখিল করেন, কিন্তু করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তিদের ওপরও ন্যূনতম কর আরোপ করার প্রস্তাব করেছে সরকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রকর্তৃক প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার বিপরীতে সরকারকে ন্যূনতম কর প্রদান করে সরকারের জনসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ। ‘এ ধরনের অংশীদারত্বমূলক অংশগ্রহণ দেশের সক্ষম জনসাধারণের মাঝে সঞ্চারণের লক্ষ্যে করমূল্য সীমার নিচে আয় রয়েছে অথচ সরকার হতে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এমন সফল করদাতার কর ২০০০ টাকা করার প্রস্তাব করছি’-বললেন অর্থমন্ত্রী। যে ৩২ লাখ ব্যক্তি আয়কর রিটার্ন জমা দেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৮ লাখের করযোগ্য আয় নেই। এ ৮ লাখ ব্যক্তির ওপর ন্যূনতম কর ধার্য করা হলে সরকারের বাড়তি ১৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে। ন্যূনতম করের নিয়মটি যদি সব টিআইএনধারীর ওপর প্রয়োগ করা হয়, তবে ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে। মাত্র ১৬০ কোটি টাকার জন্য ন্যূনতম আয়কর ধার্য করাকে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এ ধরনের করারোপ অনৈতিক ও অন্যয্য। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন, ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে কোনো কর দিতে হবে না। বর্তমানে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের জন্য কোনো কর দিতে হয় না। ৫০ হাজার টাকা ছাড় দেওয়াতে ন্যূনতম কর প্রদানের সীমা খুব একটা সহনীয় হয়ে উঠবে বলে মনে হয় না। কারণ বাজার ভয়ানক চড়া। মূল্যস্ফীতির আঘাতে সাধারণ মানুষ জর্জরিত। যাদের অনেক টাকা আছে অথচ সে অনুপাতে কর দেন না, অথবা যারা কালো টাকার মালিক তাদেরকে কর জালে আনার জন্য ভালো কোনো প্রস্তাব দিলে অর্থমন্ত্রী প্রশংসিত হতেন। যা হোক, আপাতত সে প্রশংসা করা গেল না বলে দুঃখিত।
ড. মাহ্বুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ