যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে কার জন্য কী বার্তা
হাসান মামুন
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন ভিসানীতি নিয়েছে, সেটি জানা গেল বেশ একটু দেরিতে এবং বাংলাদেশ সরকারের কারও কাছ থেকে নয়, বরং তাদের তরফ থেকে। সরকার কেন জানায়নি, সেটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ বিশেষ নীতি গ্রহণের বিষয় জানাতে কেন দেরি করল, তার সদুত্তর এখনো মেলেনি।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদারে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সরকারের ঘোষিত অঙ্গীকার রয়েছে। বাইডেন প্রশাসন আয়োজিত গণতন্ত্র সম্মেলনে পরপর দুবার বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, সেটিও স্মরণ করা যায়। বাংলাদেশে উল্লেখ করার মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সচল থাকলে ঘটনা নিশ্চয়ই ভিন্নধারায় বইত।
এ ধরনের পৃথক ভিসানীতি অন্তত গৃহীত হতো না। এর একটি ধারাবাহিকতাও রয়েছে। বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাবের ক’জন কর্মকর্তার ওপর সুনির্দিষ্ট অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসে আছে যুক্তরাষ্ট্র। সেটি প্রত্যাহারে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে কম প্রয়াস চালানো হয়নি। তবে র্যাবসহ পুলিশের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে বলে মনে হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আসেনি, সেটিও ঠিক।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ঘন ঘন বাংলাদেশ সফরে এসেছেন এবং ওখান থেকেও তারা এদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার ওপর বারবার জোর দিয়েছেন। নির্বাচনের আর মাত্র ক’মাস বাকি। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞার সতর্কবার্তা সংবলিত নীতি ঘোষণা করে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার বিষয়ে তার সিরিয়াসনেসই প্রকাশ করলো। ইইউ’র পক্ষ থেকেও আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার বিষয়ে একই ধরনের বক্তব্য প্রদান ছিল অব্যাহত।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এমন অবস্থান কিংবা দেশের ভেতর থেকে আসা চাপেও যদি এরই মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে আস্থা জাগিয়ে তোলা যেত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন ভিসানীতির মতো পদক্ষেপ সম্ভবত নিতে হতো না। বাংলাদেশের গণতন্ত্র জোরদার করাই এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য, তা কিন্তু বলা যাবে না। নিজস্ব স্বার্থসংবলিত অন্য লক্ষ্যও রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এসব নিয়ে আজকাল খোলামেলা আলোচনাও হয়ে থাকে। সেটাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে বর্ণনার প্রবণতাও কমে এসেছে-যেহেতু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়মবিধি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ক্রমে উন্নত হচ্ছে।
নিজস্ব আইনের আওতায়ই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসানীতি নিয়েছে এবং সে বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কোনো দেশের ক্ষেত্রে এমন নীতি গ্রহণের দৃষ্টান্ত নেই, সেটি বলেও যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করা যাচ্ছে না। গত ক’বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আরও কয়েকটি দেশের নির্বাচন ঘিরে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ এখন সেসব দেশের কাতারভুক্ত হলো, এটি বলাই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ বরং চিহ্নিত হয়েছে বিশেষভাবে; কেননা এই প্রথম কোনো দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক’মাস আগে তা সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কা করে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলো। বাংলাদেশে কখনো মানসম্মত নির্বাচন হয়নি, তা কিন্তু নয়।
পরপর চারবার অন্তর্বর্তীকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের এক অভিনব ব্যবস্থার আওতায় কম-বেশি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে প্রতিবারই রাষ্ট্রক্ষমতায় ঘটেছে পালাবদল। এ ধারায় ছেদ ঘটায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন। এ দুটি নির্বাচন নিয়ে যত কম আলোচনা করা যায়, ততই ভালো। ক্ষমতাসীন দলকেও এ দুই নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় অস্বস্তি বোধ করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের তরফ থেকে বরং বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন অবশ্যই পূর্ববর্তী দুটির মতো হবে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ব্যক্ত করেছেন অঙ্গীকার। সমস্যা হলো,
এ নিয়ে বিশেষত মাঠের বিরোধী দলকে আশ্বস্ত করা যাচ্ছে না-যারা ২০১৮-এর নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে অংশগ্রহণ করে প্রতারিত হয়েছেন বলে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে বোঝা যায়, তারাও আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রশ্নে সরকারের বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। বরং এ বিষয়ে শঙ্কা রয়ে যাচ্ছে বলেই সেটি দূর করতে তারা নিলেন নতুন ভিসানীতি।
র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হওয়ার প্রেক্ষাপটে নতুন করে আরও কঠিন কোনো নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাও কিন্তু করা হচ্ছিল। অতি উৎসাহী লোকজন বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার শঙ্কার কথাও বলছিলেন। এ অবস্থায় ভিসা নিষেধাজ্ঞার সতর্কবার্তা সংবলিত নীতি গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র কেন এগিয়ে এলো, সেটাও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা অনেক দেশেই কার্যকর হয়নি লক্ষ্য অর্জনে। তাতে ওইসব দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত শাসকশ্রেণির লোকজন ও ক্ষমতাবানদের নির্বাচনে সুশীল আচরণে বাধ্য করতেই নেওয়া হয়েছে ওই নীতি। ইতোমধ্যে এর প্রভাবও পড়তে দেখা গেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। একাদিক্রমে তিন দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দল ও তার সহযোগী প্রশাসনে তো বটেই, এমনকি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বিরোধী দলেও এ নিয়ে দুশ্চিন্তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেননা নির্বাচন সহিংসভাবে প্রতিহত করার বিষয়টিকেও অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে। ২০১৪ নির্বাচন প্রতিহত করতে তারা তো সহিংস বিক্ষোভে নেমেছিলেন।
ওই ধরনের আন্দোলন করে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে তাতে সংগঠনই উলটো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এতে বিধিবদ্ধ ও কার্যকর আন্দোলন রচনার শক্তিও তারা হারিয়ে ফেলেছেন পরবর্তীকালে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ভিসানীতি অনুযায়ী আগামী নির্বাচন বর্জন করতে পারলেও সহিংস উপায়ে তা প্রতিহত করার রাস্তায় তারা যেতে পারবেন না। অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না অগ্রহণযোগ্য হবে, সে বিষয়েও স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা নেই। কোনো দলনিরপেক্ষ ব্যবস্থা নির্বাচনকালে হলে তাতেও তারা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। কিন্তু এমন ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন হলে যে পরিণতি হতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে, সেটি মেনে নিতে ক্ষমতাসীন দল রাজি নয়। বিদ্যমান সাংবিধানিক বিধিবিধানের বাইরে যাওয়ার কথা তাই তারা মোটেও চিন্তা করছেন না।
তারা বোধহয় এখন দেখাতে চাইবেন, দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। সদ্যসমাপ্ত গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে এর একটি প্রমাণ বলে তারা তুলে ধরতে চাইছেন। পরবর্তী সিটি নির্বাচনগুলোও একই ধারায় সম্পন্ন করে হয়তো দেখাতে চাওয়া হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে তাদের সদিচ্ছা! তবে সবাই বুঝে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের তফাৎ। স্থানীয় নির্বাচনেও মাঠের বিরোধী দল অংশ নিলে কী হতো পরিস্থিতি, সেটি বিভিন্ন সময়ে ভালোই লক্ষ করা গেছে। তবে বিরোধী দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন অব্যাহত রাখলেও এর পাশাপাশি তারা শান্তিপূর্ণ ধারায় আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চাইছেন। ক্ষমতাসীনরা পালটা কর্মসূচি দিলেও এবং অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সঙ্গে নিয়ে নিজেরা আন্দোলন দমনে নেমে গেলেও বিরোধী দল চেষ্টা করছে সহিংস আন্দোলনে না যেতে।
ক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির পর তাদের এ সতর্কতা আরও বাড়বে। সরকার পক্ষকেও দলীয় আর প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী দলের কর্মসূচি বানচালের চেষ্টা বাদ দিতে হবে। নইলে এটিও বিবেচিত হবে নির্বাচনের পরিবেশ বিনষ্ট করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা বলে। সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দলের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়ন করে তাকে রাজনীতিতে প্রান্তিক বানিয়ে রাখার চেষ্টার কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও কম জানা নেই। এ বিষয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সময়ে সময়ে রিপোর্ট দিয়েছে এবং কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছে সরকারের জন্য বিব্রতকর প্রতিবেদন। রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিব্রতকর খবরও প্রচার হতে দেখা যায়।
অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারে একদল ক্ষমতাবানের অতিশয় প্রভাবশালী হয়ে ওঠার কারণেই এসব ঘটছে কিনা, সে প্রশ্নও রয়েছে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের ওপরই প্রধান দায় বর্তেছে আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার।
তাদের মূল দাবি আদায় না হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিএনপি নির্বাচনে না এলেও জনগণের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে এবার সরকারকে। নির্বাচন কমিশন এবং ওই সময়ে তার অধীনে থাকা প্রশাসনকে জোগাতে হবে সর্বাত্মক সহায়তা। এটি এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও নিবিড় নজরদারিতে থাকবে।
বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ ধারায় আন্দোলন কর্মসূচি পালনের সুযোগও তাদের দিতে হবে। মিডিয়াসহ বিভিন্ন পক্ষের তথ্য আর মতপ্রকাশের অধিকারও জোরদার করতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে অঙ্গীকারাবদ্ধ যে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আগ্রাসী ধারাগুলো সংশোধন করা হবে অচিরেই। যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ভিসানীতিতেও এ তাগিদ ভেতরে ভেতরে রয়েছে।
এগুলো সত্যি সত্যি ঘটলে নির্বাচনের আগে জনঅংশগ্রহণ ও জনমতের যে চাপ সৃষ্টি হবে, তা সরকারের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হতে পারে। আমরা তো এখনো স্পষ্টভাবে জানি না, ইতঃপূর্বে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনে যারা বেআইনি ও অনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাদেরও যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতির আওতায় আনতে এগিয়ে আসবে কিনা। বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং এতে সব রাজনৈতিক দল ও ভোটারের অংশগ্রহণ শোচনীয়ভাবে কমে আসার প্রধান দায় তো তাদেরই। সামনের দিনগুলোয় এসব প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হবে বলেই মনে হয়।
নয়া ভিসানীতির আওতায় কারও ক্ষেত্রে জারি করা নিষেধাজ্ঞা তার পরিবারের সদস্যদের ওপরও বর্তাবে। এটি ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের জন্য কঠিন বার্তা বৈকি। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ, যেমন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এসব নিষেধাজ্ঞার অনুসরণে নিজেরাও ব্যবস্থা নিলে তারা আরও বিপদে পড়ে যেতে পারেন এজন্য যে, তারা তো ওইসব দেশেই নিজেদের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়েছেন। একথাও ঠিক, নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে এগোতে পারে। জনপ্রত্যাশাও এক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা রাখবে নিশ্চয়ই।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক