কর হার কম হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই শেয়ারবাজারে আসবে
ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী
প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাজেটে শেয়ারবাজারের বিষয়েও কিছু নির্দেশনা থাকে। এগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার। সরকার তার উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে থাকে। আমরা সরকারকে অনুরোধ করি, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ না করে এ অর্থ যেন বন্ড মার্কেট থেকে সংগ্রহ করে। পৃথিবীর সব দেশেই সরকার তার ঘাটতি বাজেট বন্ড মার্কেট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মিটিয়ে থাকে। সরকারের বন্ড মার্কেট ডেভেলপ করলে করপোরেট বন্ড মার্কেট ডেভেলপ হয়। আমাদের শেয়ারবাজার ইক্যুইটিভিত্তিক। এখানে বন্ডের অংশ খুবই কম। করপোরেট বন্ড মার্কেটের যদি উন্নয়ন ঘটে, তাহলে আমাদের সিকিউরিটিজ মার্কেট ডেভেলপ করবে। সিকিউরিটিজ মার্কেটের উন্নয়ন ঘটলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। কারণ আমাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের চাহিদা সিকিউরিটিজ মার্কেট থেকে মেটানো সম্ভব হবে। উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য ব্যাংকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হবে না।
সরকার তার উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন নতুন পৌরসভা সৃষ্টি করা হলে তার ব্যয়ভার কিভাবে নির্বাহ করবে? বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ভার নির্বাহ করার জন্য মিউনিসিপ্যালিটি বন্ড বাজারে ছাড়া হয়। এ বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে পৌরসভার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এ ছাড়া জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্সের মাধ্যমে কিছু অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এভাবেই তারা ব্যয় নির্বাহ করে। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ অর্থের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না। আমরা যদি মিউনিসিপ্যালিটি বন্ড বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে পারতাম, তাহলে পৌরসভাগুলো তাদের ব্যয় নিজেরাই সংকুলান করতে পারত। এতে সরকারের ওপর চাপ অনেকটাই কমে যেত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। আমি প্রস্তাব করব, আগামী অর্থবছরের বাজেটে মিউনিসিপ্যালিটি বন্ড ইস্যু করার ব্যবস্থা রাখা হোক। সরকারের বাজেট ঘাটতি বন্ড মার্কেট থেকে মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে থাকে, তাহলে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। এতে উৎপাদন হ্রাস পাবে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পথে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে। মিউনিসিপ্যালিটি বন্ড ইস্যু করা হলে শুধু যে সরকার লাভবান হবে তা নয়, সব শেয়ারবাজার লাভবান হবে। এতে করপোরেট বন্ড মার্কেট উন্নয়ন হবে। মিউনিসিপ্যাল বন্ড মার্কেট ডেভেলপ করবে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, সরকার তার উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করবে না। সরকার তার প্রয়োজনীয় অর্থ শেয়ারবাজার ও বন্ড মার্কেট থেকে তুলে নেবে। আবার সরকার যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশি অর্থ ঋণ করতে থাকে, তাহলে বাজারে অর্থ সরবরাহ বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। অথচ সরকার যদি শেয়ারবাজার ও বন্ড মার্কেট থেকে তার প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে, তাহলে এসব সমস্যা থেকে বাঁচা যেতে পারে।
সরকার অনেক আগেই এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনও আছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, যারা বড় অঙ্কের অথবা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেবেন, তাদের মোট ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ (সম্ভবত ২৫ শতাংশ) শেয়ারবাজার থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের দেশের ব্যাংক খাত তো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য প্রস্তুত নয়। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য যে অবকাঠামো দরকার, তা সিকিউরিটিজ মার্কেটের আছে। ব্যাংক খাতের সে ধরনের অবকাঠামো নেই। আমি একজন অর্থনীতিবিদ হিসাবে প্রত্যাশা করি, যাদের বৃহৎ অঙ্কের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রয়োজন, তারা যেন শেয়ারবাজার থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করেন। ব্যাংক খাত থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করলে সেখানে ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারে। উদ্যোক্তারা যদি তাদের প্রয়োজনীয় অর্থের একটি অংশ শেয়ারবাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দেবে না। এমনকি খেলাপি ঋণের পরিমাণও সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই সার্কুলার এখনো কার্যকর আছে কিনা জানি না। এ সার্কুলার বাস্তবায়ন করা হলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতে পারে। বিধান আছে, করপোরেট হাউজগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের আগে তাদের অবশ্যই স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে রেটিং নিতে হবে। এ রেটিং গ্রহণের বিষয়টি ভালোভাবে মনিটর করতে হবে, যাতে এ ক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি না থাকে। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ কোম্পানিই ঠিকমতো রেটিং করে না। তারা রেটিং কোম্পানিগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে ভালো রেটিং নিয়ে থাকে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে এলে সবার জন্যই তা লাভজনক হতো। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে তেমন একটা আগ্রহী নয়। কারণ তারা তো সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় ফান্ড পাচ্ছে। সরকার যদি বলত, আমরা আর তোমাদের কোনো ফান্ড দেব না, তোমাদের প্রয়োজনীয় অর্থ তোমাদেরই ব্যবস্থা করতে হবে, তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই শেয়ারবাজারে আসত। তখন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শেয়ার ছাড়তে বাধ্য হতো। অথবা বাজারে বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করত। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান যত দুর্বলই হোক না কেন, এগুলোর প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ও আস্থা আছে। এসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে এলে সার্বিকভাবে শেয়ারবাজার কিছুটা হলেও চাঙ্গা হবে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ব্যাংক খাত থেকে যে অর্থায়ন করা হয়, তা স্বল্পমেয়াদের জন্য। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারের ওপর নির্ভর করে থাকেন। একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় হয়তো ৬ মাস; ব্যাংক যে ঋণ দেবে তার ওপর ৬ মাস পর্যন্ত নির্মাণকালীন সুদ আরোপ করবে। ৬ মাস পর থেকেই পূর্ণ মাত্রায় সুদ চার্জ করতে থাকবে। এ অবস্থায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার কারণে তার যাত্রা শুরু হবে বিরাট অঙ্কের সুদ নিয়ে।
কোম্পানি আইনেই বলা থাকবে একটি কোম্পানির কত শতাংশ শেয়ারবাজারে ছাড়াতে হবে। কোম্পানি আইনে বলা থাকবে, আপনি যদি করপোরেট বডি হন, তাহলে আপনাকে অবশ্যই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করছে। পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হলে তার মাঝে করপোরেট কালচার কাজ করবে না। দেশে যেসব বড় কোম্পানি দেখা যায়, তার বেশির ভাগই পরিবারের লোকজন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ম্যানেজমেন্ট ও ওনারশিপের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের করপোরেট কালচার অনুসরণ করতে হবে।
আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের মাঝে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, তাদের কোম্পানি যদি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়, তাহলে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ কমে যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা আনতে হবে। শেয়ারহোল্ডারদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কাজেই তারা এতসব ঝামেলার মধ্যে যেতে চান না। আর আমাদের দেশে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করা তো খুব সহজ ব্যাপার। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলা নেই। বরং ব্যাংক কর্মকর্তারা বৃহৎ কোম্পানিকে ঋণদানের জন্য উদ্যোক্তাদের কাছে ধরনা দেন। তাহলে আপনি কেন শেয়ারবাজারে যাবেন? দেশের যেসব বৃহৎ কোম্পানি এখনো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি, তাদের তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির ট্যাক্সের হার আরও কমানো যেতে পারে। কর হার কম হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, কালো টাকার সঙ্গে খেলাপি ঋণের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হচ্ছেন, তাদের মধ্যে দুটি শ্রেণি রয়েছে। এদের মধ্যে একশ্রেণির ঋণখেলাপি আছেন, যারা নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। এরা প্রকৃত ঋণখেলাপি। আর একটি শ্রেণি আছে, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করেন না। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তারাই কিন্তু বেশি পরিমাণে কালো টাকার অধিকারী। তারা ইচ্ছা করে নিজেদের খেলাপি দেখাচ্ছে। এরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে তা অন্য খাতে প্রবাহিত করেন। অথবা বিদেশে পাচার করে দেন। কালো টাকা সৃষ্টির জন্যই এরা ব্যাংক থেকে নানা উপায়ে ঋণ গ্রহণ করেন। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে যারা খেলাপি হন এবং কালো টাকা সৃষ্টি করেন, তারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের কিছু করতে পারে না।
কালো টাকার প্রভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই হবে না, আমাদের টোটাল সিস্টেমটা পর্যালোচনা করতে হবে। কেন কালো টাকা সৃষ্টি হয়, কারা কালো টাকা তৈরি করেন, শেষ পর্যন্ত কালো টাকা কোথায় কোথায় ব্যবহৃত হয়-এসব বিষয়ে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব আমাদের দেশের ট্যাক্স নেটওয়ার্ক কত ছোট। অনেকেই নানা কারণে ট্যাক্স প্রদানে আগ্রহী হন না। আবার সবাই যে ট্যাক্স দিতে চান তাও নয়। আমাদের দেশের ট্যাক্স সিস্টেমটাই খুব জটিল। অনেকে ট্যাক্স দিতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়েন। ফলে তারা মনে করেন, ট্যাক্স না দিলে যেহেতু কোনো অসুবিধা হয় না, তাই ট্যাক্স দেওয়ার কোনো দরকার নেই। আসলে এভাবেই কালো টাকা সৃষ্টির রাস্তাগুলোকে প্রসারিত করা হচ্ছে। কালো টাকার মালিকরা ট্যাক্স দিতে আগ্রহী হন না, কারণ আমরা তাদের মনে কোনো ধরনের ভীতি সৃষ্টি করতে পারিনি। বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে কালো টাকার মালিকদের বারবার উৎসাহিত করা হয়েছে। ১০ শতাংশ ট্যাক্স প্রদান করলেই কালো টাকা সাদা করা যায়। কিন্তু যারা নিয়মিত ট্যাক্স প্রদান করেন, তাদের ট্যাক্সের হার অনেক বেশি। এতে নিয়মিত ট্যাক্স প্রদানকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। কিন্তু কাজটি উলটো হওয়াই উচিত ছিল। অর্থাৎ যারা নিয়মিত ট্যাক্স প্রদান করেন, তারা যাতে উৎসাহিত হন সেই ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারছি না। অনুলিখন : এম এ খালেক
ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটস, ঢাকা