Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিদ্যুৎ-বাজার পরিস্থিতি সামলে ওঠা চাই

Icon

মোনায়েম সরকার

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুৎ-বাজার পরিস্থিতি সামলে ওঠা চাই

এ নিবন্ধ লেখার সময় প্রধানমন্ত্রী কাতার সফরে ছিলেন। খবর পড়ে বোঝা যায়, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে জ্বালানি আমদানি নির্বিঘ্ন করাও তার এ সফরের লক্ষ্য। কাতার ও ওমান থেকে বাংলাদেশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে। এ দুই দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে। এর আওতায় মূল্যবান এ জ্বালানি আমদানি হচ্ছে। স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি কেনা যায়। মাঝে অনেক দিন এর দাম অত্যধিক বেশি থাকায় বাংলাদেশ তা আমদানি করেনি। সে কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে।

চলতি মাসেই কক্সবাজারের ওপর দিয়ে একটি বড় ঘূর্ণিঝড় হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সেটা মিয়ানমারের দিকে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এতে আবার বিদ্যুৎ পরিস্থিতি হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। কারণ, যে দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে তরল গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে দেশে সরবরাহ করা হতো, তার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো পুনরায় কাজ শুরু করেছে বা করতে যাচ্ছে। তাতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ঘরবাড়িতে মানুষ যেমন কষ্ট পায়, তেমনি কলকারখানা সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। শহর-বন্দরে বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি সন্তোষজনক হলেও গ্রাম এলাকায় পরিস্থিতি ভালো নয়। শহরাঞ্চলে বসবাস করলেও গ্রামের সঙ্গে আমাদের তো কিছু যোগাযোগ আছে। সেখান থেকে লোডশেডিংয়ের যে খবর আসে, তা দুশ্চিন্তা জাগায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব চলাকালে এ পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আরও খারাপ হয়েছিল। এখন আশা করা যায়, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভালো হবে।

এর মধ্যে দুশ্চিন্তা জাগে যখন খবর পাওয়া যায়, যেসব উপকরণ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, সেগুলো নির্বিঘ্নে আমদানি করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে আছে বা পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না। আমাদের বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র তেলভিত্তিক। এসব কেন্দ্রের জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

বকেয়া বিল পরিশোধ করতে না পারায় রপ্তানিকারকরা নাকি নতুন করে তেল সরবরাহ করতে চাচ্ছে না। বিদেশি সংবাদমাধ্যমও যখন এমন খবর প্রচার করে, তখন দেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে পড়ে। এজন্য আমাদের গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে কী হচ্ছে, সেসব তথ্য স্পষ্টভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে-যাতে তারা বিভ্রান্ত না হয়। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে দেশের বিদ্যুৎ সংকট কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা সবাই জানি। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশকে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা নিয়ে অনেকদূর এগিয়েছে, এটি বলাই বাহুল্য। বেসরকারি খাতকে এর সঙ্গে যুক্ত করে, এমনকি প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানি করে বিদ্যুৎ সংকট কাটানোর মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতাও অর্জন করে ফেলেছে। এ কথাও ঠিক, সক্ষমতা অর্জন করলেও তা ব্যবহার করে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। চাহিদার চেয়ে কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করায় লোডশেডিং করতেই হচ্ছে, আর এর কোপ গিয়ে পড়ছে প্রধানত গ্রামাঞ্চলে। গ্রামে বসবাসকারীরাও কিন্তু এ দেশের নাগরিক। কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যুতের চাহিদাও কি বাড়ছে না? গ্রামে কি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করতে হয় না? গ্রামের মানুষের জীবনে সচ্ছলতা আসার কারণেও তাদের বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়ছে। আর একবার কেউ বিদ্যুতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার কি বিদ্যুৎ ছাড়া চলে? গ্রামের মানুষ এখন এলপি গ্যাস ব্যবহার করে। সেখানকার রেস্তোরাঁয়ও এর ব্যবহার বাড়ছে। এগুলো তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের প্রমাণ। বর্তমান সরকারও পল্লি উন্নয়নে বিশ্বাসী। গ্রামাঞ্চলে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। সেখানে ছোট ছোট ব্যবসায়িক উদ্যোগও মাথা তুলে দাঁড়াতে চাচ্ছে। রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভার্টের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। এ অবস্থায় গ্রামেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়ে লোডশেডিং কমিয়ে

আনতে হবে।

কাজেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো এবং তা ধরে রাখার কোনো বিকল্প নেই। এ পথে যত বাধাবিপত্তিই আসুক, তা দূর করতে হবে। ডলারের সংকট থাকলে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো থেকে বাকিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণ আনার ব্যবস্থা করা চাই। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সরকার ঋণ সহায়তা পাচ্ছে। তারা বাংলাদেশের ওপর আস্থা রেখে সহায়তা শুধু অব্যাহত রাখছে না, নতুন করেও সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তি করছে। কোনো কোনো সংস্থার সঙ্গে মাঝে সম্পর্ক খারাপ হয়ে পড়লেও তা আবার মেরামত হচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্ভাবনাময়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ডলারের সাময়িক সংকটে জ্বালানিতে সমৃদ্ধ দেশগুলো থেকে সহায়তা কেন পাবে না? এর মধ্যে অবশ্য দেশের ভোলা অঞ্চল থেকে এসেছে সুখবর। সেখানে একটি বড় গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে। তবে ওখান থেকে গ্যাস সরবরাহ পেতে আরও কিছুটা সময় লেগে যাবে। সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে তাই এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজে ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছিল বলে অনেকে সমালোচনা করেন। সেটা সত্য হলে এ কাজেও অগ্রগতি সাধন করতে হবে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়িয়ে এটা করা গেলে ভালো। নইলে উপযুক্ত বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করে অগ্রগতি আনতে হবে। দেশে জ্বালানি তেল পেলে তো ভালো; এটা না পেলেও আরও গ্যাস পেতে হবে। শুধু বিদ্যুৎ নয়, অন্যান্য পণ্য উৎপাদনেও গ্যাস আমাদের আরও প্রয়োজন। আর দেশের ভেতর থেকে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো গেলে এর আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে।

জরুরি পণ্যে বিদেশনির্ভরতা এবং বিশেষ করে অতিনির্ভরতা কোনো দেশের জন্য যে ভালো নয়, তার প্রমাণ অন্যান্য ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। এটা অনেক সময় অস্থিরতা সৃষ্টিরও কারণ হয়ে ওঠে। বিশ্ববাজারে দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে মাঝে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় এমন সমালোচনা বেড়ে উঠেছিল যে, সরকার বিদ্যুৎ খাতকে এলএনজিনির্ভর তথা বিদেশনির্ভর করে তুলেছে। তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি তেলের বাজারও অস্থির হয়ে উঠেছিল। সরকার সে অবস্থায় ভর্তুকি কমিয়ে এর দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। সেটাও তীব্র সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় এর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তাতে মধ্যবিত্ত নিুমধ্যবিত্ত হয়ে পড়ছে আর নিুমধ্যবিত্ত নাম লেখাচ্ছে গরিবের খাতায়। সরকারিভাবেও এটি কিছুটা স্বীকার করা হচ্ছে। যা ঘটে, তা স্বীকার করাই ভালো। ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে আরও অনেক দেশকেই কি একই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে না? শ্রীলংকা তো দেউলিয়াই হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের অবস্থা এত খারাপ যে, আইএমএফ তাকে আর ঋণ জোগাতে রাজি নয়। তুরস্কের মতো দেশে মূল্যস্ফীতির অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ। এর মধ্যে ভারত তার অবস্থা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এর একটা বড় কারণ সস্তায় পাওয়া রাশিয়ার জ্বালানি তেল। চীনও এ সুবিধা নিয়েছে। ভারত পশ্চিমা আপত্তি উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল কিনে তা পরিশোধন করে আবার পশ্চিমা দেশেই রপ্তানি করে মুনাফা তুলছে। নিজ অর্থনীতিও তারা এর সহায়তায় সচল রেখেছে। তাছাড়া বিশাল ভারত অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমন অনেক ক্ষেত্রে তারা অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক। পার্শ্ববর্তী দেশ হিসাবে আমরাও প্রয়োজনে তার কাছ থেকে বিভিন্ন কৃষিপণ্য আমদানি করি। যেমন-এই মুহূর্তে ভারত থেকে চিনি, পেঁয়াজ ও আদা আমদানি করা গেলে দেশে এসব পণ্যের বাজারে যে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, তা কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যেত। ভারতে এসব পণ্যের দাম অনেক কম বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এখানে চিনির বাজার রমজানের আগে থেকে অস্থির। সরকার যে দাম ধরে দিচ্ছে, তা কার্যকর হচ্ছে না। পেঁয়াজ ও আলুর ফলন ভালো হওয়ার পরও কেন লাফাতে লাফাতে দাম বেড়ে গেল, তার কারণ অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। এখন পেঁয়াজ নাকি আমদানি করতে হবে। কিছু চিনি সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করবে বলে জানিয়েছে সরকার। সে ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, চলতি বাজারের চেয়ে দাম অনেক কম। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এভাবে দামের কোনো হিসাবও মেলানো যাচ্ছে না। তখন অনেকে এমন আক্ষেপও করতে থাকেন যে, দেশে কি কোনো প্রশাসন নেই? ওষুধ ও বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকার খবরও মানুষকে যারপরনাই উদ্বিগ্ন করছে। এগুলো দেখভালের জন্য যেসব কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তাদের জবাবদিহি করতে হবে অবশ্যই। এর মধ্যে সরকারকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতিও সামাল দিতে হবে। মাসখানেকের মধ্যে পরিস্থিতি সন্তোষজনক হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। তার কথা যেন সত্য হয়। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ছে। তাতে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে বলে মনে হয় না। বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি তেলের সরবরাহও স্বাভাবিক রাখতে হবে। প্রয়োজনে রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে তেল আমদানি নির্বিঘ্ন করতে হবে। কলকারখানাসহ জীবনযাত্রা পূর্ণমাত্রায় সচল রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। সামনে বাজেট। আশা করব, আগামী দিনগুলো আরও ভালোভাবে অতিবাহিত হয়, তেমন পদক্ষেপ নেবেন অর্থমন্ত্রী। জনগণকে সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে হবে।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম